বাংলাদেশিদের টাকায় দুবাইয়ে এমটিএফই’র মাসুদের বিলাসী জীবনযাপন
অনলাইন ট্রেডিংয়ের নামে বাংলাদেশিদের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এমটিএফই। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা মাসুদ আল ইসলাম থাকেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে। বাংলাদেশিদের টাকায় সেখানে তিনি বিলাসী জীবনযাপন করছেন। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। প্রয়োজনে ইন্টারপোলের সহায়তা নেওয়া হবে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, মাসুদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগরের জাহাপুর ইউনিয়নের সাতমোড়া গ্রামে। তার বাবার নাম নজরুল ইসলাম। মাসুদ ও তার ভাই মাহাবুব আইটি বিষয়ে দক্ষ। দীর্ঘদিন ধরে তারা বিভিন্ন ওয়েবসাইট হ্যাক করে অর্থ আদায় ও বিকাশ-নগদসহ মোবাইল ব্যাংকিং প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এমটিএফই প্রতারণার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মাসুদের বাড়িতে যায়। কিন্তু সেখানে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। তার পরিবারের সদস্যরা গাঢাকা দিয়েছেন। অন্যদিকে প্রতারণার টাকা দিয়ে দুবাইয়ে বিলাসী জীবনযাপন করছেন মাসুদ। তার মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাসুদ শুরুতে এমটিএফই অ্যাপের একজন সাধারণ বিনিয়োগকারী ছিলেন। পরে নিজেই দক্ষিণ এশিয়ার জন্য একই নামে অ্যাপস চালু করেন। মাসুদ নিজেকে আড়ালে রাখতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শত শত সিইও বানিয়েছেন। এসব সিইওদের মাধ্যমে দেশের আনাচে-কানাচে নেটওয়ার্ক তৈরি করেন তিনি। মাসুদের অন্যতম সহযোগী ছিলেন কুমিল্লার হৃদয়। বর্তমানে তারা দুজনই দুবাইতে অবস্থান করছেন বলে নিশ্চিত হয়েছে তদন্ত সংস্থা।
এমটিএফই’র আগে ‘পিএলসি আলটিমা’ নামে আরেকটি এমএলএম কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মাসুদ।
আরও পড়ুন : ইসলাম স্বাভাবিক পন্থায় ধনী হওয়াকে উৎসাহিত করে : শায়খ আহমাদুল্লাহ
এদিকে এমটিএফই প্রতারণায় মাসুদ আল ইসলামকে প্রধান আসামি করে গত ২৮ আগস্ট রাজধানীর খিলগাঁও থানায় মামলা করেছেন মারুফ রহমান ফাহিম নামে এক ভুক্তভোগী। মামলায় অজ্ঞাত আরও ৫০ থেকে ৬০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
সিআইডির সাইবার ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. রেজাউল মাসুদ বলেন, মাসুদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে। বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী সিআইডির কাছেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। এ বিষয়ে তদন্ত চলছে। মাসুদকে ফিরিয়ে আনা গেলে অনেক বিষয় খোলাসা হবে। তাকে ফিরিয়ে আনতে পুলিশ সদরদপ্তরের এনসিবি শাখার সহায়তা নেওয়া হচ্ছে।
এদিকে পুলিশ সদরদপ্তরের এনসিবি শাখা জানায়, এমটিএফই’র মূল হোতা মাসুদকে ফিরিয়ে আনার জন্য সব ধরনের চেষ্টা চলছে। আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ অর্গানাইজেশনকে (ইন্টারপোল) চিঠি দিয়ে মাসুদের বিষয়ে অবহিত করা হবে।
এমটিএফই কি?
এমটিএফই হচ্ছে মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ গ্রুপ নামে একটি ক্রিপ্টোকারেন্সি (যেমন- বিট কয়েন) ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম। এখানে বিনিয়োগকারীদের উচ্চ মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলানো হয়। ক্রিপ্টো ট্রেডিং বাংলাদেশে নিষিদ্ধ।
আরও পড়ুন : এমটিএফইর মতো উচ্চপ্রযুক্তির দুর্নীতি ধরতে জাইকার দ্বারস্থ দুদক
এমটিএফইতে ক্রিপ্টো ট্রেডিং করে মুনাফা লাভের পাশাপাশি আরেকটি প্রলোভন দেখানো হয়। একজন গ্রাহক যদি নতুন কাউকে এখানে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করেন, তাহলে তিনি নতুন গ্রাহকের বিনিয়োগ থেকেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে অতিরিক্ত আয় করতে পারবেন। ডেসটিনির মতো এটিও একটি এমএলএম কোম্পানি।
অনলাইন প্ল্যাটফর্মে থাকলেও এমটিএফই নিজেদের কানাডিয়ান কোম্পানি দাবি করে, যার প্রতিষ্ঠাকাল ২০০৫ সালে। তবে বাংলাদেশে এ বছরের জানুয়ারি মাসে তাদের কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হয়েছে। এমটিএফই-এর বিরুদ্ধে কানাডিয়ান সিকিউরিটিজ অ্যাডমিনিস্ট্রেটরস (সিএসএ)-এর কাছে প্রতারণার বেশ কয়েকটি অভিযোগও রয়েছে।
কীভাবে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে এমটিএফই?
একজন নাগরিক এমটিএফই এবং বাইনান্স নামের একটি অ্যাপ ডাউনলোড করে খুব সহজেই এমটিএফইতে রেজিস্ট্রেশন করতে পারতেন। রেজিস্ট্রেশনের পর তাদের নিজস্ব ওয়ালেটে ট্রেডের জন্য ডলার রাখতে হতো। ডলারের পরিমাণ অনুযায়ী তাদের প্রতিনিয়ত লাভ দেওয়ার প্রলোভনও দেওয়া হতো।
বিজ্ঞাপনে এমটিএফই বলতো, কেউ যদি ২৬ থেকে ৬০ ডলার বিনিয়োগ করেন, সেক্ষেত্রে তিনি প্রতিদিন ০.৩৯ ডলার থেকে ০.৬০ মার্কিন ডলার লাভ করতে পারবেন। একইভাবে ৬১ থেকে ২০০ ডলার বিনিয়োগে প্রতিদিন ০.৯৮ ডলার থেকে ২.০৫ ডলারের লাভ, ২০১ থেকে ৫০০ ডলার বিনিয়োগে প্রতিদিন ৪ থেকে ৫.০৯ ডলার পর্যন্ত লাভ, ৫০১ থেকে ৯০০ ডলার বিনিয়োগে প্রতিদিন ১০.৯৩ থেকে ১৪.৬৪ ডলার পর্যন্ত লাভ, ৯০১ থেকে ১৫০০ ডলার বিনিয়োগে ১৮-২৪.৪০ ডলার পর্যন্ত লাভ, ৩৫০১ থেকে ৫০০০ ডলার বিনিয়োগে ৮৫ থেকে ১২৫ ডলার পর্যন্ত এবং ৫০০১ ডলার থেকে ১০ হাজার পর্যন্ত বিনিয়োগে প্রতিদিন ১১০ থেকে ১৬০ ডলার পর্যন্ত লাভ হতে পারে বলে লোভ দেখানো হয়।
কেউ যদি ডেসটিনির মতো তার বন্ধু বা পরিচিতদের বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করেন, তার লাভ আরও বাড়িয়ে দেয় এমটিএফই। তবে ওয়ালেটে লাভের টাকা থাকলেও নানা শর্তের কারণে সবসময় টাকা উত্তোলন করা যায় না, ইচ্ছেমতো অঙ্কের টাকাও তোলা যায় না।
যে বার্তায় বোঝা গেল পালিয়েছে এমটিএফই
আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই বিভিন্ন গ্রুপে এমটিএফই-এর গ্রাহকরা অভিযোগ করছিলেন যে- তাদের অ্যাকাউন্টে ডলার থাকলেও তারা উত্তোলন করতে পারছেন না। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি। প্রতিষ্ঠানটির কোনো কাস্টমার কেয়ার নেই বা যোগাযোগের মতো কোনো অফিস নেই। তাই সবাই এ বিষয়ে ফেসবুকে লেখালেখি শুরু করেন। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাতে অনেকের ওয়ালেটের ডলারের পরিমাণ শূন্য এবং ঋণাত্মক হয়ে যায়। তখন তারা বুঝতে পারেন যে তারা প্রতারিত হয়েছেন।
শুক্রবার এবং শনিবার গ্রাহকদের এ বিষয়ে ব্যাখ্যাও দেয় এমটিএফই। অ্যাপে নোটিফিকেশনের মাধ্যমে এমটিএফই গ্রাহকদের জানায়, এমটিএফই একটি ব্রোকার প্রতিষ্ঠান। গ্রাহকদের বিনিয়োগ করা ডলার দিয়ে ট্রেডিং করতে সহায়তা করে। প্রতিষ্ঠানটি লোকসান করেছে, তাই সবার ব্যালেন্স ঋণাত্মক বা মাইনাসে চলে গেছে। বিনিয়োগকারীদের এর দায়ভার নিতে হবে। তাই প্রত্যেকের অ্যাকাউন্টে নিজ নিজ লোকসানের অঙ্ক দেওয়া হয়েছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যদি এ পরিমাণ ডলার পরিশোধ করা না হয়, তাহলে বিনিয়োগকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এমটিএফই মাধ্যমে এ পর্যন্ত কত টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে তা না জানা গেলেও বিভিন্ন অসমর্থিত সূত্রে বলা হচ্ছে- প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার মতো পাচার হয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বা সাইবার পুলিশ এ বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেনি।
/এসএসএইচ/