জুয়া এখন অনলাইনে
‘খেলল এই দল, জিতল সেই দল’—এমন শিরোনাম হতো একসময় পত্রিকায়। সেই দিন গত হয়েছে, তবে ফিরে এসেছে ভিন্নভাবে। এ যুগের পত্রিকা লিড রিপোর্টের শিরোনাম করছে—‘খেলা ওমানে, জুয়া বাংলাদেশে’। পুলিশের তরফেই তথ্য আসছে নানারকম। পুলিশ বলছে, বাংলাদেশে জুয়ার আসর চালানো একটি ওয়েবসাইটের খোঁজ তারা পেয়েছে। সিআইডি বলছে, সাইট পরিচালনা করা হয় রাশিয়া থেকে। এটি চালাচ্ছে তিন বাংলাদেশি যুবক যারা রাশিয়া থাকে।
চলমান আইসিসির টি–২০ ওয়ার্ল্ড কাপ, ইউরোপীয় ফুটবল লিগ, ক্রিকেট লিগসহ বিভিন্ন ধরনের খেলায় বাজি ধরার ব্যবস্থা আছে। চাইলে যে কেউ ক্যাসিনোও খেলতে পারেন। ওয়েবসাইটের পাশাপাশি তাদের মুঠোফোন অ্যাপও রয়েছে।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, এটি কোনো স্বাভাবিক অনলাইন জুয়ার আসর। কিন্তু গভীরে প্রবেশ করলে বুঝতে পারা যায়, জুয়ার নামে এটিও বিদেশে টাকা পাচারের আরেক আসর।
রাজনীতির ছত্রছায়ায় একটা নব্য ধনিক শ্রেণির সৃষ্টি হয়েছে দেশে, যারা ক্ষমতা কাঠামোর ভেতরে থেকে যোগসাজশে, ঘুষের বাণিজ্য করে, শাসক দলের পদ-পদবী ব্যবহার করে, পদ আর মনোনয়ন বাণিজ্য করে, টেন্ডার দখল করে যারা বিপুল অপ্রত্যাশিত অর্থের মালিক বনেছেন তারা শুধু হুন্ডি কিংবা অবৈধ অন্যসব পথেই টাকা পাচার করছেন না, এরকম অনলাইন জুয়াতেও বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করছেন বা অপচয় করছেন।
যারা বিপুল অপ্রত্যাশিত অর্থের মালিক বনেছেন তারা শুধু হুন্ডি কিংবা অবৈধ অন্যসব পথেই টাকা পাচার করছেন না, এরকম অনলাইন জুয়াতেও বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করছেন বা অপচয় করছেন।
ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের দুই নেতা বরকত ও তার ভাই ফরিদপুর প্রেসক্লাবের বহিষ্কৃত সভাপতি রুবেল পাচার করেছেন দুই হাজার কোটি টাকা, যার মামলা এখনো চলমান। এদের দুজনই বহিষ্কৃত, তবে একটা কথাতো বোঝাই যায়—একটা মফস্বল শহরের দুই ভাই যদি এত টাকা পাচার করতে পারে তাহলে কেন্দ্রীয় পর্যায়ের বাস্তবতা কী?
রাশিয়ায় বসে বাংলাদেশে যে জুয়ার সাইটটি চালানো হয়, সেটির সঙ্গে জড়িত একটি চক্রের ছয় সদস্যকে গত ১৭ অক্টোবর রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। এ ঘটনায় রাজধানীর পল্টন থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। জুয়াড়ি চক্রের টাকা লেনদেনের তথ্যের সূত্র ধরে পাঁচটি ব্যাংক হিসাব ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সাতজন এজেন্টের সন্ধান পাওয়া গেছে। এজেন্টদের লেনদেনের তথ্য খতিয়ে সিআইডি দেখেছে, প্রত্যেক এজেন্ট প্রতি সপ্তাহে প্রায় ২০ লাখ টাকা জুয়াড়ি দলের পাঁচটি ব্যাংক হিসাবে জমা করেছেন। সিআইডি বলছে, এ টাকা পরে রাশিয়ায় পাচার হয়েছে।
ঘুষখোর সরকারি কর্মকর্তা, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকরা টাকা পাচার যেমন করে, তেমনি আছে তাদের অর্থ অপচয়ের বিলাসিতা। কিন্তু সমস্যা হয় তখনই যখন অতি সাধারণ মানুষও এমন ফাঁদে পা দেয়।
অতি সাধারণ চাকরিজীবী, ক্ষুদে ব্যবসায়ী নিয়মিত বিভিন্ন অনলাইন সাইটে জুয়ায় অংশ নিচ্ছেন। তারা খুব কম সময় জিততে পারছেন। হারছেন বেশি। তাদের কষ্টার্জিত আয় পাচার হয়ে যাচ্ছে বিদেশে যেটা তারা বুঝতেও পারছেন না।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী নেতাদের নেতৃত্বে জুয়া ও অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা চালানোর অভিযোগে ২০১৯ সালে সুপরিচিত কিছু স্পোর্টিং ক্লাবে অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা।
২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর জুয়া, চাঁদাবাজি, জমি দখল ও অন্যান্য দুর্নীতির অভিযোগে পাঁচটি স্পোর্টিং ক্লাবে অভিযান শুরু হয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের বেশ কয়েকজন নেতাসহ ২৫০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয় এসব অভিযানে। এই অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে সরকারের উচ্চপদস্থরা বারবার ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন। কিন্তু, ওই বছরের ১ নভেম্বরের পর এই ধরনের আর কোনো অভিযান চলেনি।
অতি সাধারণ চাকরিজীবী, ক্ষুদে ব্যবসায়ী নিয়মিত বিভিন্ন অনলাইন সাইটে জুয়ায় অংশ নিচ্ছেন। তারা খুব কম সময় জিততে পারছেন। হারছেন বেশি। তাদের কষ্টার্জিত আয় পাচার হয়ে যাচ্ছে বিদেশে যেটা তারা বুঝতেও পারছেন না।
মাসব্যাপী সেই অভিযান মূলত স্পোর্টিং ক্লাবভিত্তিক জুয়ার আসরকে লক্ষ্য করে চালানো হয়। কিন্তু, আইনের চোখ এড়িয়ে অনলাইন জুয়া ঠিকই চলছে দেশে। বিভিন্ন কোম্পানির আড়ালে চলছে সংগঠিত জুয়ার কারবার। পুরো বিষয়টি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে বিদেশ থেকে।
বাংলাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক মানুষ প্রতিনিয়ত অনলাইনে জুয়া খেলছে। অনুসন্ধানে বাংলাদেশে জনপ্রিয় বেশ কয়েকটি অনলাইন বেটিং সাইটের সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব বেটিং সাইটে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) এবং আন্তর্জাতিক ও ক্লাব পর্যায়ের ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে জুয়ার আসর বসে।
জানা গেছে, প্রতিটি ওয়েবসাইটই এক বা একাধিক অ্যাডমিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তারাই জুয়া পরিচালনা করেন। অনলাইন জুয়া দ্রুত বন্ধ করা সময়ের দাবি। সংশ্লিষ্ট এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন বলেই প্রত্যাশা।
একটা বড় বাস্তবতা হলো, অনেক অপরাধই এখন অনলাইনের মাধ্যমে হচ্ছে। এক্ষেত্রে নিয়মিত নজরদারি নেই, নেই এগুলো দমন করার মতো দক্ষতা ও সক্ষমতা।
যারা এগুলো নজরদারিতে আনবে বা দমন করবে তাদের ভেতরেই যদি ঘুষ আর দুর্নীতির কর্মসংস্কৃতি বিকশিত হয় তাহলে এগুলো দমন করবে কে? পুলিশ মাঝে মধ্যে দু-একজনকে গ্রেপ্তার করে। তবে মূল হোতারা বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।
বাংলাদেশে এসব ওয়েবসাইট খুলে যাতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালানো না যায়, সেজন্য নিয়মিত নজরদারি ও ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। প্রশ্ন হলো, বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, জিটিভি