হঠাৎ জন্মনিবন্ধনের হিড়িক, হিমশিম খাচ্ছে সিটি কর্পোরেশন
ছেলের জন্মনিবন্ধন করতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অধীন অঞ্চল-২ এর কার্যালয়ে এসেছেন রেহেনা খাতুন। এক মাস পরেই ছেলের স্কুলে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হবে। এ জন্য জন্মনিবন্ধন সনদ অপরিহার্য। এই সনদ পেতে কিছুদিন ধরে ঘোরাঘুরি করছেন তিনি। শুধু রেহেনা খাতুন নন, তার মতো অনেক অভিভাবক সিটি কর্পোরেশনের এই কার্যালয়ে ছোটাছুটি করছেন। সবারই একই কথা, সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করাতে হবে।
স্কুলে ভর্তি হওয়ার অপরিহার্য এই সনদ পেতে ভোগান্তিও কম পোহাতে হচ্ছে না। রেহেনা খাতুন বলেন, জন্মনিবন্ধন করানোর প্রক্রিয়াটি খুবই জটিল। এটি আগে বুঝতে পারিনি। জানুয়ারিতে ছেলের স্কুলে ভর্তি। যে কারণে তার জন্মনিবন্ধন সনদ লাগবে। আশা করেছিলাম দ্রুত কাজটি শেষ করতে পারব। কিন্তু বছরের শেষে এসে রীতিমতো ঝামেলায় পড়ে গেছি।
‘জন্মনিবন্ধন কোনোভাবেই করাতে পারছি না। শুধু আমি নই, সবারই পরিকল্পনা ছিল যে বছরের শুরুতে নিজ নিজ সন্তানকে স্কুলে দেবে, সে কারণে জন্মনিবন্ধন করতে আসা অভিভাবকদের প্রচণ্ড ভিড় লক্ষ করা যাচ্ছে। সিটি কর্পোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোও হিমশিম খাচ্ছে। তারা বলছে, ছেলের জন্মসনদ পেতে হলে বাবা-মারও জন্মসনদ থাকতে হবে। এখন এটি করানোর জন্য আমাদের যেতে হবে নিজ জেলায়। হঠাৎ যেন বড় ধরনের ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লাম।’
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, চাকরিতে যোগদান, পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্রসহ নাগরিক সেবার ১৯টি ক্ষেত্রে জন্মনিবন্ধন সনদের প্রয়োজন হয়। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল, যা সবার আবশ্যিক প্রয়োজন। এত গুরুত্বপূর্ণ একটি দলিল হাতে পেতে দিনের পর দিন সিটি কর্পোরেশনের কার্যালয়ে ঘুরতে হচ্ছে ভুক্তভোগীদের। এ ছাড়া আসছে নতুন বছর, রাজধানীসহ দেশের স্কুলগুলোতে সন্তানদের ভর্তির জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন অভিভাবকরা। এ সময়ে জন্মসনদের আবেদনপত্র স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি পড়ে।
আরও পড়ুন
বিষয়টি স্বীকার করেন ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ। তারা জানান, প্রতিদিন হাজার হাজার অভিভাবক এসে ভিড় করছেন। কাঙ্ক্ষিত লোকবলের অভাবে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।
কারণ ব্যাখ্যা করে তারা আরও জানান, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী ও প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা পালিয়ে যান। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও কাউন্সিলররাও আত্মগোপনে চলে যান। পরে মেয়রদের অপসারণ করে প্রশাসক বসানো হয়। অপসারণ করা হয় কাউন্সিলরদেরও। সিটি কর্পোরেশনের কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে গঠন করা হয় দুটি কমিটি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, চাকরিতে যোগদান, পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্রসহ নাগরিক সেবার ১৯টি ক্ষেত্রে জন্মনিবন্ধন সনদের প্রয়োজন হয়। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল, যা সবার আবশ্যিক প্রয়োজন। এত গুরুত্বপূর্ণ একটি দলিল হাতে পেতে দিনের পর দিন সিটি কর্পোরেশনের কার্যালয়ে ঘুরতে হচ্ছে ভুক্তভোগীদের
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় দুই কমিটির ৫০ জন এবং ২০ জন আঞ্চলিক কর্মকর্তাসহ ৭০ জনকে। বর্তমানে ওয়ার্ডগুলোতে প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে সংশ্লিষ্ট সচিবরা দায়িত্ব পালন করছেন।
আরও পড়ুন
এদিকে, চলতি বছর জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম সহজ করতে ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয় থেকে এ সনদ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন। ৫৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে আগের ৩৬টিতে এ সেবা চালু করে তারা। যেখানে ওয়ার্ড কাউন্সিলররা এটি প্রদান করতে পারতেন। এ ছাড়া নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ডগুলোর ক্ষেত্রে (৩৭ থেকে ৫৪ নম্বর ওয়ার্ড) সেখানকার বাসিন্দাদের জন্মনিবন্ধন সনদ নিতে ডিএনসিসির সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক কার্যালয়ে যেতে বলা হয়। পাশাপাশি জন্মনিবন্ধন সংক্রান্ত কোনো সংশোধনী থাকলে তা করতে আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে যোগাযোগ করতে বলা হয়। পরবর্তীতে সব ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে অপসারণ করা হলে এ সেবা প্রদানের দায়িত্ব দেওয়া হয় ওয়ার্ড সচিবদের। যে কারণে জন্মনিবন্ধন সনদ পেতে ভোগান্তি বেড়ে যায়— বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
অন্যদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় আগে থেকেই জন্মনিবন্ধন সনদ দেওয়া হতো তাদের আঞ্চলিক ১০টি কার্যালয় থেকে। এ ছাড়া জন্মনিবন্ধন সংক্রান্ত কোনো সংশোধনী থাকলে তা সদরঘাটে অবস্থিত জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে করিয়ে আনতে বলা হতো। বর্তমানে আঞ্চলিক কার্যালয়গুলো থেকে এ সনদ দেওয়া হচ্ছে। তবে, লোকবল সংকট এবং হঠাৎ করে চাপ বেড়ে যাওয়ায় তাদেরও হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে জানা গেছে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অধীন ২১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মুকিবুর রহমান। বেসরকারি এ চাকরিজীবী সন্তানের জন্য জন্মনিবন্ধন করাতে ওয়ার্ড সচিবের কার্যালয়ে ঘুরছেন বেশ কয়েকদিন ধরে। কিন্তু অতিরিক্ত ভিড় ও নামের জটিলতায় তিনি তা করাতে পারছেন না। এ বিষয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘অফিস থেকে ছুটি নিয়ে মেয়ের জন্মনিবন্ধন করাতে আসি ওয়ার্ড সচিবের কার্যালয়ে। যেদিনই আসি সেদিনই অতিরিক্ত ভিড়। সবাই এসেছে তাদের সন্তানদের জন্মনিবন্ধন করাতে। ১০০ টাকার জায়গায় আমি ৫০০ টাকা দিলাম। পরে তারা সবকিছু চেক করে বলে, আমার জন্মনিবন্ধনের সঙ্গে আমার জাতীয় পরিচয়পত্রের নামের পার্থক্য রয়েছে কিছুটা। এটা আগে সংশোধন না করালে আমার সন্তানের জন্মনিবন্ধন হবে না। এটা নিয়েই কয়েকদিন ধরে ঘুরছি। হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন এখানে আসছে। এত ভিড়ের মধ্যে আমার কাজটা করিয়ে নিতে পারছি না।’
একই অভিযোগ জানিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অধীন খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা সারোয়ার আলম বলেন, গতকাল সারাদিন এসে বসেছিলাম। কিন্তু আঞ্চলিক কার্যালয়ে জন্মনিবন্ধন করাতে আসা মানুষের সংখ্যা এত বেশি যে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাই হিমশিম খাচ্ছেন। আমি সেবা পাওয়ার আগেই অফিস টাইম শেষ হয়ে গেছে। আমার সব কাগজপত্র ঠিক আছে। আমার জন্মনিবন্ধন অনলাইনে করানো আছে, জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গেও কোনো অমিল নেই। শুধু এন্ট্রি দিলেই পেয়ে যাব। কিন্তু অতিরিক্ত ভিড়ের জন্য সেই সুযোগটা পাচ্ছি না। সংশ্লিষ্টদেরও কিছু বলা যাচ্ছে না, কারণ তাদের লোকবল কম। অতিরিক্ত চাপের কারণে তারা সেবাটা ঠিক মতো দিতে পারছে না।
এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অঞ্চল-২ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, জানুয়ারিতে যেহেতু স্কুলে ভর্তির বিষয় থাকে, আর ভর্তির জন্য জন্মনিবন্ধন সনদ আবশ্যক, সেই কারণে বছরের শেষের দিকে এসে এটি করানোর সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। গত সেপ্টেম্বর থেকে এটি করাতে অভিভাবকদের ভিড় বাড়তে থাকে। স্কুলে ভর্তির সময় যত এগিয়ে আসছে জন্মনিবন্ধন করার জন্য ভিড়ও তত বাড়ছে। ফলে আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোতে চাপ বেড়েছে।
আরও পড়ুন
সার্বিক বিষয় নিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক মো. মাহমুদুল হাসান বলেন, জন্মনিবন্ধনসহ অন্যান্য সনদ সরবরাহ কার্যক্রমে জড়িত অসাধু চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ডিএনসিসির ম্যাজিস্ট্রেটরা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করবেন। তিনি আরও বলেন, আইন ও বিধি অনুসরণ করে জবাবদিহিতার মধ্য দিয়ে সিটি কর্পোরেশনের প্রতিটি কাজ পরিচালিত হবে বলে আমরা ঘোষণা দিয়েছি। সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে জন্মনিবন্ধন প্রদান করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এরপরও যদি কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে আমরা দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন শাখার তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের শুরু থেকে সারাদেশে গড়ে প্রতিদিন জন্মনিবন্ধনের জন্য আবেদন পড়ে এক লাখ দুই হাজার ১৭৯টি। প্রতিদিন সনদ দেওয়া হয় ৯২ হাজার ৫৬টি। এ ছাড়া প্রতিদিন গড়ে জন্মনিবন্ধন সংশোধনের আবেদন জমা পড়ে ৪৯ হাজার ৯২৫টি। প্রতিদিন গড়ে নিষ্পত্তি হয় ২৬ হাজার ৫৪১টি সংশোধনের আবেদন। আগস্ট মাস পর্যন্ত এ সংখ্যা কমে যায়। অক্টোবরের পর থেকে জন্মনিবন্ধনের আবেদন সংখ্যা বাড়তে থাকে, নভেম্বরে এসে তা আরও বেড়ে যায়।
২০২১ সালের ১ জানুয়ারি জারি করা সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, ২০০১ সালের পর জন্ম নেওয়া ব্যক্তিদের জন্মনিবন্ধন করাতে হলে মা-বাবার জন্মসনদ থাকা আবশ্যিক। জাতিসংঘ শিশু অধিকার কনভেনশনের অনুচ্ছেদ ৭ অনুযায়ী, জন্মনিবন্ধন করতে হবে শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে। রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের এক নির্দেশিকায় শিশুর জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে জন্মনিবন্ধনের ব্যাপারে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে বিনা মূল্যে নিবন্ধন করা যাবে। ৪৬ দিন থেকে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত এ খরচ ২৫ টাকা। আর বয়স পাঁচ বছরের বেশি হলে খরচ ৫০ টাকা।
এএসএস/