ফ্যাসিস্ট সরকারের লাঠিয়াল পুলিশকে ‘জনবান্ধব’ করার চেষ্টা
একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল পুলিশকে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর পল্টনে ডাকা বিএনপির সমাবেশ পণ্ড, পরে দলটির অফিসে কথিত অভিযান চালায় পুলিশ। এ ছাড়া অতীতের নজির ভেঙে নির্বাচনের ঠিক আগে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের প্রথম সারির বেশিরভাগ নেতাকে রাজনৈতিক মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। যদিও বিরোধী অধিকাংশ দল বয়কট করেছিল ওই নির্বাচন।
২৮ অক্টোবরের পর বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ অধিকাংশ প্রথম সারির রাজনৈতিক দল পুলিশের অনুমতি না পাওয়ায় ঢাকায় সভা-সমাবেশ করতে পারেনি। পতিত আওয়ামী লীগের হাতে যাচ্ছেতাইভাবে ব্যবহার হওয়া সেই পুলিশ বাহিনী তোপের মুখে পড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে।
সরকারি চাকরিতে কোটার সংস্কার চেয়ে গত জুলাই মাসে মাঠে নেমেছিল শিক্ষার্থীদের নিয়ে গড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সেই আন্দোলন দমাতে শুরু থেকে মারমুখী ছিল পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক দমন-নিপীড়ন আর ধরপাকড়ে ছাত্রদের সেই আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপ নেয়। কোটার আন্দোলন গিয়ে ঠেকে এক দফার সরকার পতনের আন্দোলনে। সেই আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশত্যাগে বাধ্য হলে ভেঙে পড়ে পুলিশের চেইন অব কমান্ড।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর সবচেয়ে বেশি তোপের মুখে পড়ে বাংলাদেশ পুলিশ। এ সময় থানা, ট্রাফিক স্থাপনায় হামলা-ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করা হয়। ঘটে পুলিশ সদস্যদের মারধর ও হত্যার মতো ঘটনা।
নিহত ৪৪ পুলিশ সদস্য
গত ২৫ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে নিহত পুলিশ সদস্যদের তালিকা প্রকাশ করা হয়। সেখানে উল্লেখ করা হয়, গত জুলাই-আগস্টে দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতায় ৪৪ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন।
প্রকাশিত তালিকায় নিহত পুলিশ সদস্যের নাম, পদের নাম, মৃত্যুর তারিখ, কর্মরত ইউনিটের নাম ও ঘটনাস্থল উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে তিনজন পুলিশ পরিদর্শক, ১১ জন উপপরিদর্শক (এসআই), সাতজন সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই), একজন এটিএসআই, একজন নায়েক ও ২১ জন কনস্টেবল রয়েছেন।
সরকার পতনের পর দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। ছাত্র-জনতার রোষের মধ্যে ডিএমপিসহ পুলিশের অধিকাংশ সুবিধাবাদী এবং সরকার ও আওয়ামী ঘেঁষা কর্মকর্তা আত্মগোপনে চলে যান। অনেককে গ্রেপ্তার, বরখাস্ত ও বদলি করা হয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এবং পুলিশকে স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফেরাতে উদ্যোগ নেওয়া হয়।
আরও পড়ুন
৫ আগস্টের পর সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় পুলিশিং কার্যক্রম পরিচালনা করা বাহিনীটি এখন স্বনির্ভরতায় ফেরার চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে ডাকাতি, চুরি ও ছিনতাইয়ের মতো অপরাধসহ ‘মব জাস্টিস’ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ এখনও ব্যর্থতার বৃত্তে আবদ্ধ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্মমতা, গুম ও বিরোধী কণ্ঠ দমনে পুলিশকে ব্যবহার করা হয়েছে বিগত ১৫ বছরে। ছাত্রদের আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপ নেওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল পুলিশের মারমুখী ভূমিকা ও রাজনৈতিক ব্যবহার। সংগত কারণেই ছাত্র-জনতার গণরোষের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশত্যাগে বাধ্য হলে পুলিশ বাহিনী বিপর্যয়ের মুখে পড়ে।
তারা আরও বলছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অপেশাদার, মারমুখী আচরণের কারণে সরকার পতনের পর ট্রমায় পড়ে পুলিশ। সেই অবস্থা থেকে পেশাদার, জনমুখী ও সেবাদানকারী সংস্থায় পরিণত করতে পুলিশে ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। এ সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনও জরুরি। যার উদ্যোগ ইতোমধ্যে নিয়েছে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার।
পুলিশ সংস্কারের লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নির্দেশে পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব পালন করা সফররাজ হোসেনকে।
পুলিশ সদরদপ্তর বলছে, অনেকটা স্বরূপে ফিরেছে পুলিশ। জন-আস্থা ফেরানোর সব চেষ্টাই করা হচ্ছে। বিতর্কিত ও পতিত আওয়ামী লীগের হয়ে পুলিশকে রাজনৈতিক ব্যবহারে নেতৃত্ব দেওয়া কর্মকর্তাদের কাউকে সরানো হয়েছে, কেউ গ্রেপ্তার হয়েছেন। কাউকে করা হয়েছে বরখাস্ত। কাউকে আবার তদন্তের আওতায় আনতে প্রত্যাহার করা হয়েছে। বিভিন্ন ইউনিটে ব্যাপক রদবদল করা হয়েছে।
পরিসংখ্যান বলছে বেড়েছে ডাকাতি, খুন ও নারী-শিশু নির্যাতন
পুলিশ সদরদপ্তরের ক্রাইম ডাটার তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে সবমিলিয়ে মামলা হয়েছে এক লাখ ৫৮ হাজার ৯৫৯টি। এর মধ্যে ডাকাতির ঘটনা ৪১৯টি। জানুয়ারিতে ২৯টি, ফেব্রুয়ারিতে ৩৩টি, মার্চে ২৫টি, এপ্রিলে ২৯টি, মে’তে ৩১টি, জুনে ৩৬টি, জুলাইয়ে ২৭টি, আগস্টে ৩৭টি, সেপ্টেম্বরে ৫৭টি, অক্টোবরে ৬৮টি ও নভেম্বরে ৪৭টি ডাকাতির ঘটনা ঘটে। সংঘবদ্ধ ডাকাতি ঘটেছে ১১৫২টি।
১১ মাসে খুনের ঘটনা ৩ হাজার ৮০০ : ১১ মাসে খুনের ঘটনা ঘটেছে ৩৮০০টি। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ২৩১টি, ফেব্রুয়ারিতে ২৪০টি, মার্চে ২৩৯টি, এপ্রিলে ২৯৬টি, মে’তে ২৫৯টি, জুনে ২৬৮টি, জুলাইয়ে ৩৩৪টি, আগস্টে ৬১৪টি, সেপ্টেম্বরে ৫৮৩টি, অক্টোবরে ৩৯৯টি ও নভেম্বরে ৩৩৭টি ঘটনা ঘটেছে।
দ্রুত বিচার আইনে মামলা ১১৩৬ : গত ১১ মাসে দ্রুত বিচার আইনে মামলা হয়েছে ১ হাজার ১৩৬টি। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৯২টি, ফেব্রুয়ারিতে ১০৮টি, মার্চে ১১০টি, এপ্রিলে ১২০টি, মে’তে ৯৮টি, জুনে ৯৫টি, জুলাইয়ে ১০২টি, আগস্টে ৯৯টি, সেপ্টেম্বরে ১২৮টি, অক্টোবরে ৯৩টি ও নভেম্বরে ৯১টি মামলা হয়েছে।
দাঙ্গা : পুলিশের হিসাব অনুযায়ী গত ১১ মাসে ছোট-বড়সহ মোট ১১৬টি দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ১টি, ফেব্রুয়ারিতে ২টি, মার্চে ৬টি, এপ্রিলে ৩টি, মে’তে ০, জুনে ২টি, জুলাইয়ে ৫২টি, আগস্টে ১৫টি, সেপ্টেম্বরে ১৯টি, অক্টোবরে ৫টি, নভেম্বরে ১১টি দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে।
নারী ও শিশু নির্যাতন : উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা। গত ১১ মাসে ঘটেছে ১৬ হাজার ৩৬৬টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ১০৪৩টি, ফেব্রুয়ারিতে ১৩৭১টি, মার্চে ১৫০৯টি, এপ্রিলে ১৬২৩টি, মে’তে ১৭৬৭টি, জুনে ১৬৮৯টি, জুলাইয়ে ১৭০২টি, আগস্টে ১০৭২টি, সেপ্টেম্বরে ১৫৭৮টি, অক্টোবরে ১৫৬০টি ও নভেম্বরে ১৪৫২টি ঘটনায় পুলিশ কেস হয়েছে।
অপহরণ : গত ১১ মাসে রাজধানীসহ সারা দেশে ৫৬৪টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৫১টি, ফেব্রুয়ারিতে ৪৩টি, মার্চে ৫১টি, এপ্রিলে ৫৫টি, মে’তে ৫০টি, জুনে ৩১টি, জুলাইয়ে ৩২টি, আগস্টে ২৭টি, সেপ্টেম্বরে ৬৫টি, অক্টোবরে ৯৬টি ও নভেম্বরে ৬৭টি ঘটনা ঘটেছে।
পুলিশের ওপর হামলা : গত ১১ মাসে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে ৬০৪টি। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৪৩টি, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭টি, মার্চে ৪৩টি, এপ্রিলে ৭৯টি, মে’তে ৪৩টি, জুনে ৩৬টি, জুলাইয়ে ১৭০টি, আগস্টে ৪২টি, সেপ্টেম্বরে ২৪টি, অক্টোবরে ৩৪টি ও নভেম্বরে ৪৯টি ঘটনা ঘটেছে।
চুরি : গত ১১ মাসে চুরির ঘটনা ঘটেছে ৭ হাজার ৫২৬টি। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৭৪৯টি, ফেব্রুয়ারিতে ৪২০টি, মার্চে ৮৬৫টি, এপ্রিলে ৮১২টি, মে’তে ৭২৬টি, জুনে ৭৪৫টি, জুলাইয়ে ৭৮৫টি, আগস্টে ৩৮১টি, সেপ্টেম্বরে ৬০৫টি, অক্টোবরে ৭২২টি ও নভেম্বরে ৭১৬টি চুরির ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া এ সময়ে জিম্মি করে চুরির ঘটনায় পুলিশ রিপোর্ট হয়েছে ২৪১৯টি।
অন্য কারণে মামলা হয়েছে ৬৪ হাজার ৫১০টি
অস্ত্র আইনে মামলা : অস্ত্র আইনে গত ১১ মাসে মামলা হয়েছে ১১৫১টি। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ১২১টি, ফেব্রুয়ারিতে ১২৯টি, মার্চে ১২৮টি, এপ্রিলে ১১৭টি, মে’তে ১১২টি, জুনে ৯৮টি, জুলাইয়ে ১০৫টি, আগস্টে ৪৪টি, সেপ্টেম্বরে ১৫০টি, অক্টোবরে ১২০টি ও নভেম্বরে ১৫৯টি মামলা হয়েছে।
এ ছাড়া বিস্ফোরক আইনে মামলা ৫৭৩টি, মাদক মামলায় ৪৩ হাজার ৩১৬টি, চোরাচালানের ঘটনায় ১৭৫২টিসহ মোট ৫২ হাজার ৩৩৯টি রিকভারি মামলা হয়েছে।
আরও পড়ুন
ডিএমপির পরিসংখ্যান : ১০ মাসে খুনের মামলা ৪৬০, সেপ্টেম্বরে সর্বোচ্চ ১৪৮
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তথ্যানুযায়ী, গত ১০ মাসে ঢাকার বিভিন্ন থানায় খুনের মামলা হয়েছে ৪৬০টি। এর মধ্যে সেপ্টেম্বরে হয়েছে সর্বোচ্চ ১৪৮টি মামলা। এ ছাড়া আগস্টে ১১৯টি, জুলাইয়ে ৫৯টি, অক্টোবরে ৫৮টি, মার্চে ১৮টি, মে’তে ১৬টি, এপ্রিলে ১৪টি, জুনে ১৩টি, জানুয়ারিতে ১১টি ও ফেব্রুয়ারিতে হত্যা মামলা হয়েছে ৪টি।
গত ১০ মাসে দস্যুতার ১৮৩টি, ডাকাতির ২৯টি, অপহরণের ৮৭টি এবং চুরির ঘটনায় মামলা হয়েছে ৫০৯টি। এর মধ্যে আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে দস্যুতার মামলা ৩৯টি, ডাকাতির ১৪টি, অপহরণের ৪৭টি ও চুরির মামলা হয়েছে ৯৬টি।
এ বিষয়ে ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘নানা অপরাধে হওয়া মামলার পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে মামলা হয়েছে বেশি। ডিএমপি গতিশীলতায় ফিরছে। মামলা হচ্ছে, আসামিও গ্রেপ্তার হচ্ছে। ঢাকায় সাঁড়াশি অভিযান চলছে। অভিযানে অপরাধীরা ধরাও পড়ছে। নভেম্বরে তুলনামূলক পরিবর্তন এসেছে, উন্নতি হয়েছে রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির।’
উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যা মামলায় জড়াচ্ছে পুলিশ
৫ আগস্টের পর ইচ্ছাকৃত বা উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যা মামলার অনেক তথ্য উঠে এসেছে গণমাধ্যমে। অনেকে জেনেশুনে জীবিত মানুষকে মৃত বলে মিথ্যা মামলা করেছেন। অনেক মামলায় বাদীর সঙ্গে মামলাবাজিতে জড়াচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা।
এ ব্যাপারে পুলিশ সদরদপ্তরের উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, পুলিশ সদরদপ্তর তদন্ত করছে। গণমাধ্যমে অনেকের নাম পেয়েছি। আমরা নিজেরাও তদন্ত করছি। আইন-বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মিথ্যা প্রমাণিত হলে ২১১ ধারা অনুযায়ী বিচারের মুখোমুখি হতে হবে সেই বাদীকে। এটাই আমাদের অনুসরণ করা উচিত। আমরা সেটাই চেষ্টা করব।
দৃশ্যমান পরিবর্তন আসছে, পুনর্গঠনের কাজ চলমান : আইজিপি
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, গত জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে এত মানুষ মারা গেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে কেন, এশিয়ার ইতিহাসেও এমন নেই। এমন একটা ঘটনা ও পরিবর্তনের পর আমাদের সক্ষমতায়ও কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটেছে। সব জায়গায় সঠিক লোকটা দিয়ে আমরা শেষ করতে পারিনি। আমাদের পুনর্গঠনের কাজটা কিন্তু চলমান। বদলি হচ্ছে। তদন্ত করতে পারে তেমন সক্ষম লোকদের বাছাই করে পুনরায় দায়িত্ব প্রদান করা হচ্ছে। সারা দেশে বিভাগ অনুযায়ী আলাদা মেন্টরিং ও মনিটরিং কমিটি করা হয়েছে।
গণবদলি কমানোর পরিকল্পনা, তদন্তের মান বাড়াতে উদ্যোগ
আইজিপি বলেন, ঢাকার অপরাধ জগতে নজরদারি, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে চৌকস ও অভিজ্ঞ জনবল দরকার। সেখানে গণহারে সিনিয়র থেকে জুনিয়র সব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বদলি করা হয়েছে। যার প্রভাবে বেড়েছে চুর, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা।
তিনি বলেন, মনিটরিং ও তদন্তের মান বাড়াতে ঊর্ধ্বতন ও অভিজ্ঞ, যারা বিপুল অভিজ্ঞতা নিয়ে অবসরে গেছেন তাদেরকেও আমরা সঙ্গে নিয়ে আটটা জায়গায় আলাদা মনিটরিং টিম করেছি। প্রতিটি থানায় মামলাগুলোর তদন্তকারী কর্মকর্তাকে গাইড ও মনিটরিং করার কাজ করবেন তারা। যারা তদন্ত করছেন তাদের দক্ষতা আশানুরূপ নয়। আমার বিশ্বাস তদন্তের মানটা বাড়বে। আর যারা পালিয়েছেন তাদের আমরা লোকেট করতে সম্ভব হবো।
আরও পড়ুন
আরও উন্নতি দরকার : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে একটু উন্নতি হয়েছে কিন্তু আরও উন্নতি হওয়া দরকার। খুব একটা সন্তোষজনক পর্যায়ে যে চলে গেছে তা নয়। এখন যদি বলেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন, জাস্ট সন্তোষজনক। কিন্তু এটা আরও ভালো হওয়া দরকার।’
আস্থা ফেরাতে জনগণের দোরগোড়ায় যাচ্ছে পুলিশ
জন-আস্থা ফেরাতে বিট পুলিশিং চাঙা এবং জনগণের দোরগোড়ায় যাচ্ছে পুলিশ। জনগণের অভিযোগ ও সমস্যা শুনতে চেষ্টা করছে পুলিশ। এজন্য ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন এলাকায় নিয়মিত মতবিনিময় সভার আয়োজন করছে ডিএমপি।
এ বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, আইনশৃঙ্খলা ও পুলিশি সেবা সংক্রান্ত যে কোনো বিষয়ে নগরবাসীর অভিযোগ জমা দেওয়ার জন্য খুব শিগগিরই অভিযোগ বক্স খোলা হবে। এ ছাড়া মুক্ত আলোচনার মাধ্যমে সবার পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে। পুলিশি সেবাপ্রাপ্তি দ্রুততম সময়ে নিশ্চিত করতে একটি বিশেষ টিমের কার্যক্রম শুরুর কথা বলেন তিনি।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে ডিএমপি তথা বাংলাদেশ পুলিশ নতুনভাবে মানুষকে সেবা দেওয়ার কাজ শুরু করেছে। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে ডিএমপির কিছু সদস্য পেশাদারিত্বের বাইরে গিয়ে কাজ করেছে। এজন্য ডিএমপি কমিশনার দুঃখ প্রকাশ করেন এবং ঢাকা তথা দেশবাসীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
এ সময় পেশাদারিত্বের বাইরে গিয়ে যারা কাজ করেছে তাদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, ছিনতাই প্রতিরোধে ডিবি ও থানা পুলিশকে সক্রিয় করা হয়েছে। ডিএমপির প্রতিটি থানায় মতবিনিময় সভা করা হচ্ছে। আমরা ঢাকাবাসীর মতামত নিয়ে সর্বোত্তম পুলিশি সেবা দিতে চাই। অনেক ক্ষেত্রে ঢাকাবাসীর সহযোগিতা ছাড়া আমাদের কাজ করা দুরূহ হয়।
জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (লজিস্টিকস, ফিন্যান্স অ্যান্ড প্রকিউরমেন্ট) হাসান শওকত আলী বলেন, মহানগরীর প্রতিটি এলাকা নিরাপদ রাখতে পুলিশ দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছে। পুলিশি কার্যক্রম ফলপ্রসূ করতে হলে এবং সমাজ থেকে অপরাধ দূর করতে হলে শুধু পুলিশই নয়, পুলিশের পাশাপাশি জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে। মানুষ যেন বলে আমাদের পুলিশ। আমরা সেই পুলিশ হতে চাই।
গণঅভ্যুত্থানে দমন-পীড়নসহ গণহত্যায় জড়িতদের তালিকা হচ্ছে
‘পুলিশ হবে জনতার’— এমন স্লোগানেই বেশি মুখর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বেশিরভাগই মাঠ পর্যায়ের সাধারণ পুলিশ সদস্য তথা পুরো বাহিনীকে ব্যবহার করেছেন ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে। সরকার পতনের পর সেই কর্মকর্তাদের তালিকা করা হচ্ছে বলে পুলিশ সদরদপ্তর সূত্রে জানা গেছে।
গণঅভ্যুত্থান দমনে হত্যা, গণহত্যা, গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্যদের তালিকা তৈরি করছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) তদন্ত সংস্থা। বিভিন্ন বাহিনীকে একাধিক চিঠি পাঠিয়েছে তদন্ত সংস্থাটি।
পুলিশ সদরদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের ঘটনায় অন্তত ৪৪৯ জন পুলিশ সদস্যকে ৩০০টি মামলায় আসামি করা হয়েছে, যার বেশিরভাগই হত্যা মামলা। এসব মামলায় পুলিশের দুই সাবেক মহাপরিদর্শকসহ ১৭ কর্মকর্তা এবং বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তদন্ত-সাপেক্ষে দোষী ও জড়িত পুলিশ সদস্যদের আরও অনেককে পর্যায়ক্রমে আইনের আওতায় আনা হবে।
প্রয়োজন দক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নুর মোহাম্মদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ক্রাইটেরিয়া ও বাস্তবতা বুঝে বদলি করা উচিত। আতঙ্ক ও ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠছে পুলিশ। কিন্তু তদন্ত ও অপরাধ দমনে এখনও ঘাটতি আছে। এখানে আগে পরিবর্তন আনতে হবে। মনে রাখতে হবে, এ আন্দোলন দেখিয়েছে আইনশৃঙ্খলা ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তায় ফ্রন্টলাইনার হিসেবে পুলিশকেই বেশি জবাবদিহি করতে হবে। তাই দক্ষ নেতৃত্বের গুণাবলি আছে, গ্রহণযোগ্যতা আছে— এমন পুলিশ কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে আনতে হবে।
জেইউ/এসএসএইচ