মসজিদের সম্পত্তি লোপাটেও ছাড় নয়!
সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী ও পটুয়াখালী- ৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মো. মাহবুবুর রহমান তালুকদার। তিনি বর্তমান কলাপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগেরও সভাপতি। তিনবারের নির্বাচিত এ সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে এবার মসজিদের বিপুল পরিমাণ জমি, মসজিদের মার্কেট দখল এমনকি মসজিদের উন্নয়ন ফান্ডের টাকা লুটপাটেরও অভিযোগ উঠেছে। এজন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাকে।
পটুয়াখালীর ঐতিহ্যবাহী খেপুপাড়া কেন্দ্রীয় বড় জামে মসজিদের সম্পদ লুটপাটের অভিযোগে আদালতে দায়ের হওয়া মামলায় তার সঙ্গী হয়েছেন কলাপাড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম রাকিবুল আহসানসহ অনেকে।
আরও পড়ুন >> ওয়াসার সমিতি বিলুপ্ত হলে ‘২০০ কোটির সম্পদ’ যাবে কার হাতে?
অভিযোগ রয়েছে, মসজিদের কার্যনির্বাহী কমিটির সাবেক প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে মাহবুবুর রহমান কমিটির অপর সদস্যদের সহযোগিতায় মসজিদের প্রায় ৫০ কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ ও অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। এ অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলার তদন্তভার বর্তায় দুদকের ওপর। গত ২৮ আগস্ট কমিশন থেকে এ অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক।
এ বিষয়ে দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘটনাটি বেশ পুরাতন। মসজিদের সম্পত্তি ও ফান্ড ধাপে ধাপে আত্মসাৎ হয়েছে। এ বিষয়ে গত ফেব্রুয়ারি মাসে আদালতে মামলা দায়ের হয়। ওই মামলা তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। এ ছাড়া সরকারি একটি কলেজের ১০ কোটি টাকার সম্পদ ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। বিষয়টিও অনুসন্ধান করবে দুদক ।
আরও পড়ুন >> বছরে ২ লাখ টাকার পত্রিকা, ওভারটাইমের নামে ১৬২ কোটি টাকা নয়ছয়!
মামলার আসামি হয়েছেন যারা
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি মসজিদের এক মুসল্লির দায়ের করা মামলার আসামিরা হলেন- সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী ও বর্তমান কলাপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. মাহবুবুর রহমান তালুকদার, কলাপাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান এস এম রাকিবুল আহসান, তার স্ত্রী সুরাইয়া নাসরিন, সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান সুলতান মাহমুদ ও উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রারসহ আরও চার থেকে পাঁচজন।
সাবেক প্রতিমন্ত্রী মাহাবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
>> কলাপাড়া পৌরসভার সাবেক মেয়র ও বর্তমান উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং খেপুপাড়া মসজিদ কার্যনির্বাহী কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এস এম রাকিবুল আহসান ও সাবেক পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. মাহাবুবুর রহমান পরস্পর যোগসাজশে ২০১৫-১৬ সালে কলাপাড়া উপজেলা প্রশাসন থেকে মসজিদের উন্নয়নে সরকারিভাবে বরাদ্দ হওয়া ৫০ হাজার টাকা এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বরাদ্দ হওয়া ৩০ হাজার টাকা কাজ না করে আত্মসাৎ করেন।
>> খেপুপাড়া কেন্দ্রীয় বড় জামে মসজিদের ঈদগাহ মাঠের অসমাপ্ত অংশ সমাপ্ত করতে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার (কাবিখা) কর্মসূচির আওতায় পটুয়াখালী সংসদ সদস্য মো. মাহবুবুর রহমানের অনুকূলে বরাদ্দ হওয়া ৫০ লাখ ৬২ হাজার ৫০০ টাকা কাজ না করে আত্মসাৎ করেন।
>> ২০১৪-১৫ অর্থবছরে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার (কাবিখা) কর্মসূচির আওতায় পটুয়াখালী- ৪ সংসদ সদস্যের অনুকূলে ২০০ টন খাদ্যশস্যের ৫০ টন কলাপাড়া কেন্দ্রীয় বড় জামে মসজিদের ঈদগাহের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্তকরণ এবং সোলার প্যানেল স্থাপনের জন্য ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয়। যার বাজারমূল্য প্রায় ১৫ লাখ টাকা। বরাদ্দ হওয়া ওই খাদ্যশস্য এমপি মাহবুব অন্যান্য আসামিদের সহায়তায় বিক্রি করে অর্থ আত্মসাৎ করেন।
আরও পড়ুন >> আইডিয়ালের সাবেক অধ্যক্ষ শাহান আরার এত সম্পদ!
>> ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে খেপুপাড়া কেন্দ্রীয় বড় জামে মসজিদের ঈদগাহ মাঠ উন্নয়নের জন্য আড়াই লাখ টাকা ( যার চেক নং-৭৯৮৬৮২৭) ২০১৩ সালের ৪ আগস্ট গ্রহণ করে মসজিদ ফান্ডে জমা না দিয়ে এবং কোনো রকম উন্নয়নমূলক কাজ না করে আত্মসাৎ করেন।
>> পটুয়াখালী জেলা পরিষদ থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদেমের আবাসস্থল এবং ঈদগাহ মাঠ উন্নয়নের জন্য আরও চার লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া যায়। যা মসজিদ কমিটির সদস্য (বর্তমানে প্রয়াত) মীর আবদুল বারেককে ২০১৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর উত্তোলন করার ক্ষমতা দেওয়া হয়। এমপি মাহবুব সিন্ডিকেট অন্য আসামিদের সহায়তায় তা আত্মসাৎ করেন।
>> পায়রা পোর্ট কর্তৃপক্ষ মসজিদের জমি থেকে মোট ৩.৫৯ একর জমি অধিগ্রহণ করে। ওই অধিগ্রহণ হওয়া জমির ক্ষতিপূরণের টাকা উত্তোলনের জন্য এমপি মাহাবুব ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম রাকিবুল আহসানকে ক্ষমতা দেওয়া হয়। জমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রাপ্ত অর্থেরও গন্তব্য পাওয়া যায়নি।
আরও পড়ুন >> ছোট্ট একটি ফ্ল্যাটে বসবাস, দুর্নীতি ৬৯০ কোটি!
>> ওয়াকফ অর্ডিন্যান্স ১৯৬২ এর ৫৬ (১) ধারা মোতাবেক মসজিদের কোনো স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করতে হলে ওয়াকফ পরিদর্শকের অনুমতি নিতে হবে। এ ছাড়া সরকারি বা ওয়াকফের কোনো পুরাতন অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করতে হলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সমন্বয়ে গঠিত নিলাম কমিটির মাধ্যমে প্রাক্কলিত মূল্য নির্ধারণপূর্বক পত্রিকায় নিলাম বিজ্ঞপ্তি ও দরপত্র আহ্বান করে সর্বোচ্চ দরদাতার নিকট বিক্রি করার বিধান রয়েছে। কিন্তু এমপি মাহাবুব ও রাকিবুল আহসান ক্ষমতার অপব্যবহার করে আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে খেপুপাড়া কেন্দ্রীয় বড় জামে মসজিদের পুরাতন ঘর, ইমাম-মুয়াজ্জিন ও খাদেমের আবাস ঘর, মসজিদের পাঠাগার, মসজিদের সামনের মার্কেট অবৈধভাবে বিক্রি করে প্রায় ২০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। ২০১৫ ও ২০১৬ সালের নভেম্বর ও সেপ্টেম্বর মাসে মসজিদ কমিটির সভার কার্যবিবরণীতে বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে।
>> মসজিদ মাঠের ভাড়া ও ওয়াপদা সড়কের দক্ষিণ পাশের মসজিদের নিজস্ব মার্কেট ভবন ভাড়া দিয়ে প্রতি বছর প্রায় দুই লাখ টাকা পাওয়া যায়। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ১০ লাখ টাকা ভাড়া বাবদ আদায় হলেও তা মসজিদের কোষাগারে জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করেন আসামিরা।
>> মসজিদের পুকুরে চাষ করা মাছ বিক্রি বাবদ ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১১ বছরে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন আসামিরা।
>> একই সময়ে মসজিদের নামে কৃষিজমি ও দানবাক্স থেকে পাওয়া ৩০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন অভিযুক্তরা।
আরও পড়ুন >> ৩৪ কোটির হিসাব না মিললেও ‘দায়মুক্ত’ তারা!
>> মসজিদের নামে ওয়াকফ করা সাড়ে ২২ শতাংশ জমি বিক্রির মাধ্যমে পাওয়া প্রায় তিন কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন আসামি পটুয়াখালী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম রাকিবুল ইসলাম ও তার স্ত্রী সুরাইয়া নাসরিন।
>> ২০১১ সালের ৯ আগস্ট মসজিদের নামে ৬৯ শতাংশ জমি ক্ষমতার অপব্যবহার করে এমপি মাহবুব নিজ নামে সাফ-কবলা দলিল করে নেন। যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ছয় কোটি টাকা। এ ছাড়া মসজিদের প্রায় তিন কোটি টাকার ১৯.৫০ শতাংশ জমি আসামি মো. ইউসুফ আলী এবং প্রায় এক কোটি টাকা মূলের ১১.৫০ শতাংশ জমি মো. মোজাফ্ফার আলীর নামে সাফ-কবলা করা হয়। মামলার আসামিরা চারটি দলিল সম্পাদন করে প্রায় ১০ কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং ১.১২ একর জমি নিজেদের অনুকূলে ভোগ দখলে রেখেছেন।
>> ওয়াকফ প্রশাসকের অনুমোদন ছাড়াই ২০১১ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে প্রায় দেড় একর জমি ১৪ কোটি টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। পরবর্তীতে নতুন মসজিদ নির্মাণ এবং মসজিদের নামে জমি ক্রয় দেখিয়ে প্রায় ১০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
>> ২০১১ ও ২০১২ সালে মসজিদের নামে প্রায় ১০ একর কৃষিজমি ক্রয়ের নামে দুটি দলিলে মোট ৩৭ কোটি ৩৮ লাখ ৮০০ টাকা আসামিরা আত্মসাৎ করেছেন। ওই জমি ক্রয় ও অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে খেপুপাড়া জামে মসজিদ কমিটির সাবেক সভাপতি সুলতান মাহমুদ সরাসরি জড়িত বলে মসজিদ কমিটি প্রমাণ পেয়েছে।
আরও পড়ুন >> নিয়োগ দুর্নীতিতে ফাঁসছেন যবিপ্রবির সাবেক ভিসি!
>> কলাপাড়া এতিমখানা গোরস্থান সংলগ্ন জমিতে মসজিদের নামে থাকা মার্কেট থেকে নিয়মিত উত্তোলন করা ভাড়া আসামিরা আত্মসাৎ করেছেন।
অভিযোগ যেভাবে মামলায় পরিণত হলো
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মসজিদের একজন মুসল্লি ২০২০ সালের ২৭ মে এসব অভিযোগের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে কলাপাড়ার নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর আবেদন করেন। সেখানে কোনো প্রতিকার না পেয়ে ২০২১ সালের ৯ জানুয়ারি তিনি প্রধানমন্ত্রী ও পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক বরাবর মসজিদের অর্থ ও সম্পদ আত্মসাতের প্রতিকার চেয়ে দরখাস্ত করেন। জেলা প্রশাসন অফিস থেকে অভিযোগটি ওয়াকফ প্রশাসককে সরেজমিন তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়।
২০২১ সালের ৯ ডিসেম্বর ওয়াকফ প্রশাসক দপ্তর থেকে সরেজমিন তদন্ত করা হয়। তদন্ত শেষে প্রতিবেদনে আসামিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের অধিকাংশের প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়। এরপর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তদন্ত প্রতিবেদনটি জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো হয়। প্রতিবেদন পাঠানোর এক বছরের বেশি সময় পার হলেও কোনো আইনি পদক্ষেপ না নেওয়ায় চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি আদালতে মামলা করা হয়। এসব অভিযোগ তদন্তের জন্য আদালত থেকে গত আগস্ট মাসে দুদককে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
যা বলছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী
এ বিষয়ে সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুবুর রহমান তালুকদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি কোনো মসজিদ কমিটির মধ্যে নেই। আমার বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়েছে কি না, সেটিও আমি জানি না। কলাপাড়ার ওই বড় মসজিদটি ব্রিটিশ আমলের। ওই সময়ে মসজিদ পরিচালনার জন্য রেজুলেশন করা হয়। সেটি অনুসারে মসজিদ কমিটির সভাপতি হওয়ার কথা ইউএনও এবং সহ-সভাপতি হবেন থানার ওসি সাহেব। আমি কখনোই মসজিদ কমিটিতে ছিলাম না।’
প্রসঙ্গত, সাবেক প্রতিমন্ত্রী মাহবুব হোসেনের বিরুদ্ধে সাড়ে ছয় কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ ও সম্পদের তথ্য গোপন এবং তার স্ত্রী প্রীতি হায়দারের বিরুদ্ধে দেড় কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ ২০১৫ সালে মামলা এবং পরবর্তীতে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। যা বর্তমানে ঢাকা বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালতে বিচারাধীন।
রায়হান/আরএম/এসকেডি/এমএআর/