কম্বোডিয়ায় বাংলাদেশিদের ‘সাইবার দাস’ বানাচ্ছে বাংলাদেশিরাই!
বাংলাদেশিদের কম্বোডিয়ায় নিয়ে ‘সাইবার দাস’ বানিয়ে মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে বাধ্য করা হচ্ছে। মেয়েদের ভিডিও কল দিয়ে আপত্তিকর অঙ্গভঙ্গি ও কথাবার্তা রেকর্ড করা হচ্ছে। এরপর সেগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা আত্মসাতে বাধ্য করানো হচ্ছে। কেউ এমন প্রতারণার কাজ করতে না চাইলে বা টার্গেট পূরণে ব্যর্থ হলে তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে ‘মানবপাচার’ ও ‘সাইবার দাস’-এর মতো অমানবিক ঘটনা ঘটলেও বিষয়টি জানা নেই আন্তর্জাতিক কোনো এনজিও বা বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট কোনো মহলের।
সম্প্রতি কম্বোডিয়ায় বাংলাদেশিদের পাচার করে নির্যাতনের অভিযোগে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন- র্যাব। এরপর বিষয়টি সামনে আসে। ঢাকা পোস্টের নিজস্ব অনুসন্ধান এবং ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে নির্মম ও অমানবিক এসব ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত, সে বিষয়টি উঠে এসেছে। পাশাপাশি ‘মানবপাচার’ ও ‘সাইবার দাস’-এর মতো ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ‘স্বপ্নের কম্বোডিয়ায় নরকের স্বাদ’— শিরোনামের দুই পর্বের বিশেষ প্রতিবেদনে আজ থাকছে শেষটি।
বাংলাদেশিদের নরকে পাঠায় খোদ বাংলাদেশিরা
কম্বোডিয়াফেরত এবং দেশটিতে বসবাসরত মোট ৩০ বাংলাদেশির সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। কাদের মাধ্যমে তারা কম্বোডিয়ায় কাজের উদ্দেশ্যে গেছেন এবং কীভাবে বাংলাদেশি দালালদের মাধ্যমে চীনা প্রতিষ্ঠানে বিক্রি হয়েছেন— এসব বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলেন ভুক্তভোগীরা। তারা সবাই ঘুরেফিরে কয়েকজন ব্যক্তির নাম বলেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন কম্বোডিয়া প্রবাসী আলিম ও শরিফুল।
আরও পড়ুন >> ৫ লাখে বিক্রি, দাস বানিয়ে বাংলাদেশিদের নিয়ে ‘খেলে’ চীনারা!
দুজনই কম্বোডিয়ায় থাকেন, পেশায় ‘দালাল’। তারা বাংলাদেশ থেকে যাওয়া প্রবাসীদের বিভিন্ন ফ্ল্যাটে তুলে কম্পিউটারের ওপর প্রশিক্ষণ দেন। পরে তাদের বিক্রি করে দেন চীনা প্রতিষ্ঠানের কাছে। একজন প্রবাসীর বেশে শরিফুলকে হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে ফোন করা হয়। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা প্রবাসীদের ভিসার বিষয়ে সহযোগিতা করি। ইনভাইটেশন পাঠাই, চাকরির ব্যবস্থা করি।
কম্বোডিয়ায় সবচেয়ে প্রভাবশালী দালাল হলেন কামাল ওরফে লায়ন কামাল, শরিফুল ও আতিক। সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তে তাদের নাম উঠে এসেছে। তারা বাংলাদেশ থেকে কর্মী এনে কম্পিউটার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। প্রশিক্ষণ শেষে তাদের চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বিক্রি করে দেন। বিক্রির অর্থের ৭০ শতাংশ ভাগ পান তারা। বাকি টাকা বাংলাদেশে অবস্থিত এজেন্টদের কাছে পাঠানো হয়
তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওই দুজন তেমন কোনো সহযোগিতা করেন না। কম্বোডিয়ার ভিসার জন্য যেকোনো প্রতিষ্ঠানের প্যাডে ইনভাইটেশন পাঠাতে হয়। তারা শুধুমাত্র সেটা পাঠান, তাও ভুয়া। ওই ভুয়া ইনভাইটেশন দেখে কম্বোডিয়ার দিল্লি বা মালয়েশিয়া দূতাবাস থেকে ইস্যু করা হয় ভিসা।
অনুসন্ধানে রাকিব ও রফিক নামের আরও দুই বাংলাদেশি দালালের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলা ভুক্তভোগী পাঁচ বাংলাদেশি জানান, তারা (রাকিব ও রফিক) নম পেন বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশিদের রিসিভ করেন। এরপর গাড়িতে করে আরিফ নামে আরেক দালালের হোটেলে নিয়ে যান।
কম্বোডিয়ায় সবচেয়ে প্রভাবশালী দালাল হলেন কামাল ওরফে লায়ন কামাল, শরিফুল ও আতিক। সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তে তাদের নাম উঠে এসেছে। তারা বাংলাদেশ থেকে কর্মী এনে কম্পিউটার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। প্রশিক্ষণ শেষে তাদের চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বিক্রি করে দেন। বিক্রির অর্থের ৭০ শতাংশ ভাগ পান তারা। বাকি টাকা বাংলাদেশে অবস্থিত এজেন্টদের কাছে পাঠানো হয়।
আরও পড়ুন >> গল্পগুলো ভয়ংকর, মামলা হলেও বিচার মন্থর!
এ চক্রের সদস্য সংখ্যা ২০ থেকে ২২ জন। তাদের মধ্যে তিনজন বাংলাদেশ থেকে কর্মী সংগ্রহ করতেন। বাকিরা কম্বোডিয়া থাকেন। সম্প্রতি বাংলাদেশে অবস্থান করা তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন- র্যাব। তারা হলেন- নাজমুল ইসলাম (৩০), নূর ইসলাম সাজ্জাদ (২৫) ও মো. সিরাজুল ইসলাম পঞ্চায়েত (৫৭)। তারা কম্বোডিয়া গমনেচ্ছুদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ভিসার ব্যবস্থা এবং তাদের বিমানবন্দরে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করতেন।
নম পেন বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলাদেশিদের হস্তান্তরের আগ পর্যন্ত সার্বিক বিষয়গুলো দেখভাল করেন দালাল শাহীন রেজা, বাবু, নাজমুল, রাকিব, ওসমান ও আবুলসহ বেশ কয়েকজন।
মানবপাচার ও সাইবার দাসত্বের ঘটনায় জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোতে অর্থায়ন করছে চীনা তিন ব্যবসায়ী। তারা দীর্ঘদিন ধরে কম্বোডিয়ায় অবস্থান করছেন। সম্প্রতি একজন থাইল্যান্ডে গ্রেপ্তার হয়েছেন। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা বলছে, কম্বোডিয়ায় সবচেয়ে বড় তিন চীনা বিনিয়োগকারী হচ্ছেন- ডং লেচেং, জু আইমিন ও শি ঝিজাং। আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগে তারা চীন ছাড়তে বাধ্য হন। পরে আশ্রয় নেন কম্বোডিয়ায়। বর্তমানে সেখানে অনলাইন স্ক্যাম ও সাইবার কৃতদাস প্রথার নিয়ন্ত্রণ করছেন তারা
এদিকে, চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে অনুসন্ধান করে ঢাকা পোস্ট। জানা যায়, প্রতিষ্ঠানগুলোতে অর্থায়ন করছে চীনা তিন ব্যবসায়ী। তারা দীর্ঘদিন ধরে কম্বোডিয়ায় অবস্থান করছেন। সম্প্রতি একজন থাইল্যান্ডে গ্রেপ্তার হয়েছেন। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা বলছে, কম্বোডিয়ায় সবচেয়ে বড় তিন চীনা বিনিয়োগকারী হচ্ছেন- ডং লেচেং, জু আইমিন ও শি ঝিজাং। আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগে তারা চীন ছাড়তে বাধ্য হন। পরে আশ্রয় নেন কম্বোডিয়ায়। বর্তমানে সেখানে অনলাইন স্ক্যাম ও সাইবার কৃতদাস প্রথার নিয়ন্ত্রণ করছেন তারা। শিয়ানোভিলে তাদের একাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমটি বলছে, জু আইমিন অবৈধভাবে অনলাইন জুয়া পরিচালনা করে এক দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার আয় করেছিলেন। ২০১৩ সালে চীনা সরকার তার ১০ বছরের জেল দেয়। তাৎক্ষণিক পালিয়ে তিনি কম্বোডিয়ায় চলে আসেন। গড়ে তোলেন অনলাইন জুয়াসহ প্রতারণার সাম্রাজ্য। ২০১৮ সালে কম্বোডিয়ার ফনোম পেনের কান্তা বোফা চিলড্রেন্স হাসপাতালে দুই লাখ ডলার দান করে প্রকাশ্যে আসেন। বিপুল অর্থ দানের মাধ্যমে কম্বোডিয়া সরকারের গুড বুকে নাম লেখান তিনি।
আরও পড়ুন >> ইউরোপে মানবপাচারের নতুন রুট ‘ভারত হয়ে উজবেকিস্তান’
দ্বিতীয়জন হলেন শি ঝিজাং। আর্থিক কেলেঙ্কারির কারণে তিনিও চীন ছাড়তে বাধ্য হন। আশ্রয় নেন কম্বোডিয়ায়। এখানেও তিনি প্রতারণা ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। চলতি বছরের (২০২২ সাল) আগস্টে তাকে ব্যাংকক থেকে গ্রেপ্তার করে থাইল্যান্ড পুলিশ। গ্রেপ্তারের পর পুলিশ জানায়, শি ঝিজাং ২০১০ সালে চীনে নিষিদ্ধ অনলাইন জুয়ার ব্যবসার প্রতিষ্ঠান খুলে বিপুল টাকার মালিক হন। পুলিশের তৎপরতায় ওই বছরই চীন থেকে পালিয়ে কম্বোডিয়ায় আশ্রয় নেন। সেখানেও অবৈধ সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। চীন সরকারের জারি করা ইন্টারপোল রেড নোটিশ এবং আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানার ভিত্তিতে তাকে গ্রেপ্তার করে থাইল্যান্ড পুলিশ।
দেশটির পুলিশ জানায়, শি ঝিজাং কম্বোডিয়ায় ‘ইয়াতাই ইন্টারন্যাশনাল’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান খুলে সেটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন। অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে তিনি ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেন। আনুষ্ঠানিকতা শেষে তাকে চীনে হস্তান্তর করা হবে।
ওই তালিকায় থাকা তৃতীয় ব্যক্তি হলেন ডং লেচেং। তিনি কম্বোডিয়ার জেসি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের মালিক। ২০০৮ সাল থেকে চীনে অবৈধ অনলাইন জুয়া ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ২০১৪ সালে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতিতে জড়ানোর প্রমাণ পায় চীনা সরকার। ওই বছরই চীন থেকে তিনি সব ব্যবসা গুটিয়ে কম্বোডিয়ার সিহানউকভিলে চলে আসেন। সেখানে গড়ে তোলেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ২০২১ সালের শেষের দিকে কম্বোডিয়া পুলিশ ডং লেচেংয়ের সিহানউকভিলের পাশে চায়না টাউনের কেবি হোটেলে অভিযান চালায়। তাদের কাছে তথ্য ছিল সেখানে প্রবাসী কর্মীদের কিনে ভুয়া স্ক্যামিংয়ের কাজে লাগানো হচ্ছে। তবে, প্রমাণ না পাওয়ায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি পুলিশ।
দাসত্ব থেকে মুক্তির পরও বিপদ
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রবাসীদের এক বছরের জন্য দাস বানিয়েও ক্ষান্ত হয় না চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো। দাসত্ব থেকে মুক্তির পরও আরও বড় বিপদের মুখোমুখি হতে হয় তাদের। কারণ, কম্বোডিয়ার জেনারেল ডিপার্টমেন্ট অব ইমিগ্রেশনের নিয়ম অনুযায়ী, ট্যুরিস্ট ভিসার মেয়াদ যত দিনই থাকুক না কেন সেই ভিসায় দেশটিতে থাকা যায় সর্বোচ্চ ৩০ দিন। ৩০ দিনের বেশি থাকলে প্রতিদিনের জন্য ৩০ মার্কিন ডলার ওভার স্টে ফি দিতে হয়।
আরও পড়ুন >> দালালের কথায় ‘চোখ বন্ধ করে’ সিল মারেন ইমিগ্রেশন অফিসার
ফলে দাসত্ব থেকে মুক্তি মিললেও ভুক্তভোগী প্রবাসীদের বড় ধরনের জরিমানার মুখোমুখি হতে হয়।
মে মাসে দেশে ফেরা এমন এক ভুক্তভোগী বাংলাদেশি যুবকের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। তিনি বলেন, আমাকে তিন মাসের ট্যুরিস্ট ভিসায় নেওয়া হয়। এরপর আমাকে সাড়ে তিন হাজার ডলারের বিনিময়ে এক বছরের জন্য বিক্রি করে দেওয়া হয়। তারা আমার পাসপোর্ট আটকে রাখে। ১১ মাসের মাথায় তাদের ডেরা থেকে বের হয়ে দেশে ফেরার টিকিট কাটি। নয় মাস ২০ দিনের ওভার স্টে (ভিসার মেয়াদ শেষে অতিরিক্ত নয় মাস অবস্থান) হওয়ায় আমাকে ইমিগ্রেশন পুলিশের মুখোমুখি হতে হয়। তারা আমাকে প্রচুর জিজ্ঞাসাবাদ করে। পরে বাংলাদেশি এক দালালের সঙ্গে ফোনে কথা বলি। তিনি আমাকে বিমানবন্দরের এক কর্মকর্তার কাছে এক হাজার ডলার দিতে বলেন। টাকা দিলে তারা আমাকে দেশে ফিরতে দেয়।
বাংলাদেশিদের করণীয় কী
কম্বোডিয়ায় বাংলাদেশের কোনো দূতাবাস নেই। পাশের দেশ থাইল্যান্ডে অবস্থিত দূতাবাস থেকে প্রবাসীদের সেবা নিতে হয়। ভুক্তভোগীরা চাইলে দূতাবাসের ফোন নম্বরে কল দিয়ে সেবা নিতে পারেন।
ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে থাইল্যান্ড দূতাবাসে যোগাযোগ করা হয়। তবে, তাদের কেউ ভিন দেশের (কলোম্বিয়া) বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রকৃতপক্ষে তাদের (কলোম্বিয়ায় ভুক্তভোগী বাংলাদেশি) জন্য সরাসরি কিছু করার সুযোগ নেই। তবে, কেউ যদি সেখান থেকে থাইল্যান্ডে আসে, আমরা তাদের দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারি।
আরও পড়ুন >> দুবাইয়ে বাংলাদেশি তরুণীদের পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করছেন যারা
ঢাকা পোস্টের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয় কম্বোডিয়ায় বসবাসরত বাংলাদেশি কমিউনিটির কয়েকজন নেতার সঙ্গে। তবে, তারা কেউ পরিচয় প্রকাশ করতে রাজি হননি। করণীয় হিসেবে তাদের একজন ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত বছর প্রতারণার শিকার এমন নয় বাংলাদেশি যুবক বন্দিশালা থেকে মুক্তির পর কম্বোডিয়ায় বসবাসরত বাংলাদেশি এক দালাল (বাড়ি সিরাজগঞ্জ) দম্পতির বিরুদ্ধে মামলা করেন। কম্বোডিয়া পুলিশ তাৎক্ষণিক তাদের গ্রেপ্তার করে আদালতে তোলে। অল্প সময়ে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাদের ১০০ বছরের জেল হয়।
তিনি বলেন, কম্বোডিয়ার আইন অনেক শক্ত এবং কঠোর। এছাড়া চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর আইনগত কোনো ভিত্তি নেই। তাই তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা যায় না। কিন্তু যেসব বাংলাদেশি নিজ দেশের লোকদের বিক্রি করে নরকে ঠেলে দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই মামলা করা যায়। বাংলাদেশিদের উচিত একজোট হয়ে এসব দালালের বিরুদ্ধে কম্বোডিয়ার থানাগুলোতে মামলা করা। এটি করতে পারলে নিশ্চিত তারা শিক্ষা পাবে।
দায় নেই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর
এ বিষয়ে ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক এনজিও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, ইউএন হিউম্যান রাইটস কম্বোডিয়া (ইউএন ওএইচসিএইচআর), হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (নিউইয়র্ক অফিস), কম্বোডিয়ার মানবাধিকার সংস্থা কম্বোডিয়ান সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস (সিসিএইচআর), কম্বোডিয়ান লিগ ফর দ্য প্রমোশন অ্যান্ড ডিফেন্স অব রাইটস, সেন্টার ফর অ্যালায়েন্স অব লেবার অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস ও কম্বোডিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিটিকে ই-মেইল করা হয়। তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, তারা কম্বোডিয়ায় কার্যক্রম পরিচালনা করলেও কেন সাইবার দাসত্বের বিষয়ে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে না? কেন-ই বা তারা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না?
আরও পড়ুন >> স্বপ্নের দুবাইয়ে দুঃস্বপ্নের রাত পার করছেন বাংলাদেশি তরুণীরা
সাতদিন হলেও সিসিএইচআর ছাড়া কোনো সংস্থার পক্ষ থেকে উত্তর মেলেনি। প্রথম শ্রেণির এসব মানবাধিকার বিষয়ক এনজিও’র ওয়েবসাইটে গিয়েও দেখা মেলেনি তেমন কোনো তৎপরতা।
কম্বোডিয়ার সাইবার দাসত্বের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা পোস্টের ই-মেইলের জবাবে সিসিএইচআর বলে, ‘এমন একটি ইস্যু মোকাবিলায় আমাদের সক্ষমতা নেই।’
তারা জানায়, কম্বোডিয়ায় মানবপাচার ও সাইবার দাসত্বের মতো অমানবিক নির্যাতনের ব্যাপক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এতে আমরা উদ্বিগ্ন ও বিরক্ত। আমরা চলতি বছরের মার্চে সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি অবগত করে চিঠি দিয়েছিলাম। প্রতিনিয়ত তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। মিডিয়ার সংবাদ থেকে আমরা জানতে পেরেছি, মূলত সিহানউকভিল, নম পেন, পুসরাত, কোহ কংয়ে এ ধরনের কাজ বেশি হচ্ছে। সরকার বেশ কয়েকটি অভিযোগের ভিত্তিতে কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও সামগ্রিকভাবে অভিযান হচ্ছে না। আমরা চাই দ্রুত এসব বন্ধ হোক। অন্যথায় কম্বোডিয়া পৃথিবীর বুকে ‘অমানবিক দেশ’ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে।
ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে কম্বোডিয়ায় অবস্থিত চীনা দূতাবাসের সঙ্গে অনলাইনে যোগাযোগ করা হয়। সেখান থেকে প্রতিবেদককে তিনটি ই-মেইলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রশ্ন পাঠাতে বলা হয়। ঢাকা পোস্ট দূতাবাসের কাছে জানতে চায়, ‘চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশিদের আটকে রেখে নির্যাতন করছে, বিষয়টি দূতাবাস অবগত আছে কি না? এছাড়া, কম্বোডিয়ায় চীনা প্রতিষ্ঠানের প্রতারণা বা অনলাইন স্ক্যামের বিষয়ে দূতাবাস অবগত আছে কি না?’
আরও পড়ুন >> না বুঝে ফাঁদে পা দিচ্ছেন মালয়েশিয়া গমনেচ্ছুরা
যথাযথ নিয়ম মেনে ঢাকা পোস্ট চীনা দূতাবাসের ই-মেইল এবং একটি অনুলিপি তাদের রাষ্ট্রদূতকে মেইল করে। তবে, সাতদিন পার হলেও তারা কোনো উত্তর দেয়নি।
কম্বোডিয়ায় রয়েছে এশিয়ার ১০ দেশের সমন্বিত পুলিশের সংস্থা আশিয়ানপোল (ASEANAPOL )। কম্বোডিয়া, ব্রুনাই, ইন্দোনেশিয়া, লাউস, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের পুলিশের সমন্বয়ে গঠিত সংস্থাটির মুখপাত্রের কাছে ঢাকা পোস্ট ই-মেইলে ‘দাসত্ব ও মানবপাচার’ পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে চায়। কিন্তু তারাও কোনো উত্তর দেয়নি।
রেমিট্যান্স যোদ্ধারা নির্যাতিত হচ্ছে, বাংলাদেশ কি জানে
সম্প্রতি কম্বোডিয়ায় বাংলাদেশিদের পাচার করে নির্যাতনের অভিযোগে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে সংস্থাটি। র্যাব জানতে পেরেছে, বাংলাদেশিদের কম্বোডিয়ায় নিয়ে সাইবার দাস বানিয়ে মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক করতে বাধ্য করা হচ্ছে। মেয়েদের ভিডিও কল দিয়ে আপত্তিকর অঙ্গভঙ্গি ও কথাবার্তা রেকর্ড করা হচ্ছে। এরপর সেগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা আত্মসাতে বাধ্য করানো হচ্ছে।
এ বিষয়ে র্যাব- ৩ এর সহকারী পুলিশ সুপার ফারজানা হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, কেউ এমন প্রতারণার কাজ করতে না চাইলে বা টার্গেট পূরণ করতে ব্যর্থ হলে তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ বিষয়ে র্যাব তদন্ত করছে এবং অভিযান পরিচালনা করছে। বাংলাদেশিরা দেশে ফিরে দালালদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারলেও প্রবাসী দালালরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন >> ৫ মিনিটে ‘স্ত্রীকে হ্যাক’!
তবে, র্যাব ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্য কোনো সংস্থা বা প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় কলোম্বিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের নির্যাতনের তথ্য জানে না।
ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সিনিয়র সহকারী সচিব সারোয়ার আলম বলেন, ‘এ বিষয়ে কোনো প্রবাসী আমাদের কাছে অভিযোগ করেননি। তারা হয়তো থানায় মামলা করতে পারে।’
তবে প্রবাসীরা বলছেন, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করতে হলে ম্যানপাওয়ার কার্ড লাগে। দালালরা কম্বোডিয়া থেকে দেশে ফেরার সময় ম্যানপাওয়ার কার্ড রেখে দেয়। তাই অভিযোগ করা যায় না।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের মধ্যে ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট মানবপাচারের বিষয়টি দেখে। ঢাকা পোস্টকে সিটিটিসির এই বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) তৌহিদুল ইসলাম বলেন, এ বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই।
আরও পড়ুন >> অবৈধ বাংলাদেশি কর্মীদের স্বীকার করেন না মালদ্বীপের মালিকরা
‘অধিকাংশ লোকজন (ভুক্তভোগী) নিজের আত্মীয়স্বজনসহ এলাকার পরিচিতদের মাধ্যমে কম্বোডিয়া যান এবং প্রতারিত হন। দেশে ফিরে এসে কেউ সমঝোতা করে ফেলেন, আবার কেউ ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেন না। এ কারণে অনেকে দিনের পর দিন অপরাধ করে পার পেয়ে যাচ্ছেন। আমরা চাই সবাই সচেতন হয়ে মামলা করুন, পুলিশকে সহযোগিতা করুন’— বলেন ওই কর্মকর্তা।
জানতে চাইলে সিআইডির সিরিয়াস ক্রাইম ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএস) নজরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো রেকর্ড নেই।’
এআর/এমএআর/