৪০ দিনের ইবাদত কবুল হয় না যে কারণে
বর্তমানে অনেকের মাঝে ব্যাপক আকারে মদ পানের প্রবণতা দেখা যায়। আনন্দ-ফুর্তি, উদযাপনের অংশ হিসেবেও অনেকে মদ পান করেন এবং একে স্বাভাবিক ব্যাপার মনে করেন। কিন্তু এতে শারীরিক বিভিন্ন ক্ষতির পাশাপাশি ধর্মীয় বিধি-নিষেধের ব্যাপারটি বেমালুম ভুলে যান।
মদ পান শয়তানের কাজ
অথচ পবিত্র কোরআনে মদ পানকে শয়তানের কর্ম বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ, নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, প্রতিমা-বেদী ও ভাগ্যনির্ধারক তীরসমূহ তো নাপাক শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার করো, যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ -(সুরা মায়েদা, আয়াত : ৯০)
মাদকের ক্ষতি সম্পর্কে কোরআনের আরেক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘শয়তান শুধু মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চার করতে চায়। আর (চায়) আল্লাহর স্মরণ ও সালাত থেকে তোমাদের বাধা দিতে। অতএব, তোমরা কি বিরত হবে না?’ -(সুরা মায়েদা, আয়াত : ৯১)
৪০ দিনের ইবাদত কবুল হবে না
মদ পানের সব থেকে বড় ক্ষতি হলো এর কারণে ৪০ দিনের ইবাদত তথা নামাজ কবুল হয় না। তিরিমিজি শরিফের এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মদপানকারী ব্যক্তির ৪০ দিনের নামাজ কবুল করা হয় না। সে তওবা করলে তবে আল্লাহ তায়ালা তার তওবা কবুল করেন। যদি আবার সে মদপান করে, তাহলে আল্লাহ তায়ালা তার ৪০ দিনের নামাজ কবুল করেন না।
যদি সে তওবা করে, তাহলে আল্লাহ তাআলা তার তওবা গ্রহণ করেন। সে যদি আবার মদপানে লিপ্ত হয়, তাহলে তার ৪০ দিনের নামাজ আল্লাহ তাআলা গ্রহণ করেন না। যদি সে তওবা করে, আল্লাহ তায়ালা তার তাওবা কবুল করেন।
সে চতুর্থবার মদপানে জড়িয়ে পড়লে আল্লাহ তায়ালা তার ৪০ দিনের নামাজ গ্রহণ করেন না। যদি সে তওবা করে, আল্লাহ তায়ালা তার তওবা কবুল করবেন না এবং তাকে ‘নাহরুল খাবাল’ হতে পান করাবেন। প্রশ্ন করা হলো, হে আবু আবদুর রাহমান (ইবনু উমার), খাবাল নামক ঝরনাটি কী? তিনি বললেন, জাহান্নামিদের পুঁজের ঝরনা। (তিরমিজি, হাদিস : ১৮৬২)
আরেক হাদিসে উরওয়া ইবনে রুওয়ায়ম রহ. বলেন, একদিন দায়লামী রহ. আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবন আস রা.-এর খোঁজে বের হলেন। তিনি বলেন, আমি আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা.-এর কাছে উপস্থিত হলাম। জিজ্ঞাসা করলাম. হে আবদুল্লাহ্ ইবন আমর! আপনি কি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে মদ সম্পর্কে কিছু বলতে শুনেছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, আমার উম্মতের কেউ শরাব পান করলে আল্লাহ তায়ালা তার চল্লিশ দিনের নামাজ কবুল করবেন না। (সুনানে নাসায়ী, হাদীস, ৫৬৬৪)
মদপানকারী ঈমানদার থাকে না!
আবু হুরায়রা রা. থেকে আরও বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘ব্যভিচারী যখন ব্যভিচার করে তখন সে ঈমানদার থাকে না। চোর যখন চুরি করে তখন সে ঈমানদার থাকে না। মদ পানকারী যখন মদ পান করে তখন সে ঈমানদার থাকে না। লুটেরা যখন মানব জনসম্মুখে লুট করে তখন সে ঈমানদার থাকে না। তবে এরপরও তাদেরকে তওবা করার সুযোগ দেয়া হয়’। -(বুখারী ২৪৭৫, ৫৫৭৮, ৬৭৭২, ৬৮১০; মুসলিম ৫৭; আবূ দাউদ ৪৬৮৯; ইব্নু মাজাহ্ ৪০০৭)
আরেক হাদিসে রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা মদপান থেকে বেঁচে থাকো। কারণ এটি যাবতীয় অপকর্মের চাবি।’-(মুবাদরকে হাকেম খণ্ড ৪, পৃ. ১৪৫; মুনজিরি হাদিস ৩৪৮৭, পৃ. ৪৫৫)
আরেক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, মদ পানকারীর চল্লিশ দিনের নামাজ কবুল হবে না। সে যদি এ অবস্থায় মারা যায় তাহলে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। -(ইবনে মাজাহ, হাদিদস,৩৩৭৭)
তার কাছ থেকে সব কিছু ছিনিয়ে নেওয়া হলো
হজরত আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস রা. থেকে আরেক হাদিসে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি প্রথম বারের মতো নেশাগ্রস্ত হয়ে নামাজ ছেড়ে দিলো সে যেন দুনিয়া ও দুনিয়ার উপরিভাগের সব কিছুর মালিক ছিলো এবং তা তার থেকে একেবারেই ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে।
আর যে ব্যক্তি চতুর্থ বারের মতো নেশাগ্রস্ত হয়ে নামাজ ছেড়ে দিলো আল্লাহ তায়ালার দায়িত্ব হবে তাকে ‘ত্বীনাতুল্ খাবাল’ পান করানো। জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘ত্বীনাতুল্ খাবাল’ বলতে কি? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তা হচ্ছে জাহান্নামীদের পুঁজরক্ত’। -(বাইহাক্বী, হাদীস ১৬৯৯, ১৭১১৫ ত্বাবারানী/আওসাত্ব, হাদীস ৬৩৭১; আহমাদ, ৬৬৫৯)
ইবাদত শুদ্ধ হয় না তবে...
আলেমরা বলেন, ‘চল্লিশ দিন নামাজ কবুল হবে না’-এর অর্থ হল, (কবুল হয় না অর্থ বুঝতে হবে, ইবাদত শুদ্ধ হয় না বা করা যাবে না বলা হয়নি, বলা হয়েছে কবুল হয় না। এ দু’টি কথা এক নয়) অর্থাৎ মদপানের শাস্তি হিসাবে চল্লিশ দিনের নামাজের সওয়াব পাবে না। তবে, নিয়মিত মাদকগ্রহণকারীর দোয়া শবে বরাতেও কবুল হয় না বলে হাদীসে উল্লেখ আছে।
যেমন ফেকাহবিদ আলেমরা বলেছেন, জুমার দিন খুতবাহ চলাকালীন যদি কেউ কথা বলে সে জুমা পড়বে কিন্তু তার জুমা হবে না। অর্থাৎ তার এই অপরাধের কারণে তাকে জুমার নামাজের সওয়াব প্রদান করা হবে না।’ (তাযীম কাদরিছ ছালাত, ২/৫৮৭ ও ৫৮৮)।
মাতলামি দূর হলেই পবিত্র হয়ে নামাজ পড়তে হবে
আলেমদের মতে, কেউ মদ পান করলে মাতলামী দূর হওয়ার পর তার ওপর পবিত্র হওয়া ও নামাজ পড়া ফরজ। ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘নামাজ কবুল না হওয়ার অর্থ হল, এতে তার সওয়াব হবে না। যদিও নামাজ পড়লে ফরজ আদায় হয়ে যাবে এবং তা পুনরায় আদায় করার প্রয়োজন নেই।’
তবে এ কারণে চল্লিশ দিন শরীর অপবিত্র থাকে এমন কথা হাদিসের মাধ্যমে সাব্যস্ত নয়। (শরহু মুসলিম, ১৪/২২৭, জামেউল ফাতাওয়া, ইসলামী ফিক্হ ও ফাতাওয়া বিশ্বকোষ)
এনটি