বিশ্ব ইজতেমা কি গরিবের হজ? ইসলাম যা বলে
টঙ্গীর তুরাগ তীরে চলছে বিশ্ব মুসলিমের গণজমায়েত বিশ্ব ইজতেমা। শুক্রবার (১৩ জানুয়ারি) থেকে শুরু হওয়া এই আয়োজন চলবে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত। রোববার আখেরি মোনাজতের মাধ্যমে শেষ হবে বিশ্ব ইজতেমা। বিশ্ব ইজতেমা মূলত তাবলিগ জামাতের সঙ্গে যুক্ত মুসলিমদের একত্রিত হওয়ার একটি মাধ্যম। এখানে একত্রিত হয়ে তারা তাবলিগের গুরুত্বপূর্ণ মুরব্বি আলেমদের বিভিন্ন বয়ান ও ধর্মীয় কথা শুনে থাকেন।
প্রতিদিন ফজর নামাজের পর থেকে এশার নামাজের আগ মুহুর্ত পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালার ওপর ঈমান দৃঢ় করা ও ব্যক্তি জীবনের সব ক্ষেত্রে ইসলামকে কিভাবে ধারণ করা যায় এখানে এই বিষয়েই আলোচনা করা হয় বলে জানিয়ে থাকেন সংশ্লিষ্টরা।
তাবলিগ সংশ্লিষ্টরা বলেন, ইজতেমা মাঠে বয়ানের মাধ্যমে উদ্দেশ্য থাকে মূলত, মানুষের মধ্যে ঈমানি চেতনা বৃদ্ধি এবং দ্বীনের প্রচার-প্রসারের ভাবনা তৈরি করা। এবং তাদেরকে তাবলিগের নির্দিষ্ট সময় অথার্ৎ ৪০ দিন. চার মাসের জন্য বের হওয়ার জন্য উৎসাহিত করা। এক্ষেত্রে শুধু বয়ানের দ্বারা সবাই তৈরি হয়ে যায় না। বরং পুরো ইজতেমার সময় জামাতে লোকজনকে বের করার জন্য আলাদাভাবে তাশকিল (উদ্ধু্দ্ধ) করা হয়।
এমন উদ্দেশ্য নিয়েই মূলত তুরাগ তীরে তাবলিগ জামাতের সঙ্গে যুক্ত মুসলিমরা একত্রিত হন বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। এখানে আগতরা একে ইসলাম সম্পর্কে জানার একটি মাধ্যম হিসেবেই মেনে থাকেন। তবে এর বাইরে কিছু মানুষের মাঝে তাবলিগের বিশ্ব ইজতেমা নিয়ে কিছু কিছু ভুল ধারণা রয়েছে, যেমন কেউ কেউ বলে থাকেন বা মনে করেন, ইজতেমায় এলে গুনাহ মাফ হয়ে যায়। কেউ একে গরিবের হজ ভেবে থাকেন। আরেকটি বিভ্রান্তি রয়েছে, বিশ্ব ইজতেমার মোনাজাতকে ঘিরে। ইসলাম সম্পর্কে অল্প ধারণা রয়েছে, এমন কেউ কেউ মনে করেন, ইজতেমার মোনাজাতে অংশ গ্রহণ করলেই দোয়া অবশ্যই কবুল হয়।
কিন্তু এমন ধারণা ঠিক নয় বলে মন্তব্য করে থাকেন ইসলামি চিন্তাবিদেরা।
ইসলামি চিন্তাবিদের মতে, হজ ইসলামের অন্যতম ফরজ বিধান। নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের মালিকের ওপর নির্দিষ্ট জায়াগায় তা পালন করা ফরজ। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘যাদের নিকট এই ঘর (কাবা শরিফ) পর্যন্ত পৌঁছার সামর্থ্য আছে, তাদের ওপর এই ঘরের হজ করা ফরজ। ’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৯৭)
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘হে লোক সকল! আল্লাহ তোমাদের উপর হজ ফরজ করেছেন। সুতরাং তোমরা হজ কর।’ (বুখারী, অধ্যায়, কিতাবুল হজ)
ফরজ হজ সম্পর্কিত এই আয়াত ও হাদিস বর্ণিত হয়েছে ইসলামের প্রথম যুগে, বর্তমান সময় থেকে আরও সাড়ে ১৪ শত বছর আগে। এদিকে সাধারণ মুসলমানদের ইসলামের বিধান মানার প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে গত শতকে ১৯২৪ সালে তাবলিগ জামাত প্রতিষ্ঠিত হয়। এর আরও পরে ১৯৬৭ সালে শুরু হয় বিশ্ব ইজতেমা। তাই একে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধান বা ফরজ কোনও বিধানের সঙ্গেও মেলানোর কোনও যৌক্তিকা নেই।
এ বিষয়ে আন নূর জামে মসজিদের খতিব ও মাদরাসা আবু রাফে (রা.)-এর পরিচালক মাওলানা আলী হাসান তৈয়ব ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইজতেমার মোনাজাতকে যেভাবে গুরুত্ব দেওয়ার প্রবণতা শুরু হয়েছে এর জন্য তাবলিগ বা ইজতেমা সংশিষ্টরা নয় বরং সাধারণ মানুষ নিজেরাই দায়ী। তাবলিগের সাথী বা সচেতন মুসলিমদের কেউ একে হজের সঙ্গে তুলনা করতে যান না বা এমন কিছু তারা কখনও ভাবেনও না।
তার মতে, ইজতেমাকে ইসলামের মৌলিক ইবাদত বা পঞ্চ স্তম্ভের সঙ্গে তুলনার কোনও প্রশ্নই আসে না।
‘মিডিয়াতে বিশ্ব ইজতেমাকে হজের পরে দ্বিতীয় বৃহত্তম গণজমায়েত বলে প্রচার করা হয়, এর ফলে ইসলাম সম্পর্কে কম জানা সাধারণ মুসলিমদের অনেকে এমন ভাবনার কিছুটা সুযোগ পান’ তাই প্রচারণার ক্ষেত্রেও কিছুটা সচেতনতা কাম্য বলেন তিনি।
তিনি বলেন, ইজতেমায় জুমার নামাজকে কেন্দ্র করে মুসল্লিদের ঢল নামে, অনেকেই এই জুমাকে বিশেষ ফজিলতপূর্ণ মনে করেন। কিন্তু এর আলাদা কোনও ফজিলত নেই। তাই ইজতেমার ময়দান থেকেও এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা কাম্য। তাদের পক্ষ থেকে বলে দেওয়া উচিত, এখানে শুধু বয়ান শোনার জন্য আসা উচিত। মাঠের জুমাকে কেন্দ্র করে এখানে জমায়েত না করার জন্য বিশ্ব ইজতেমা সংশিষ্টদেরও মানুষকে সচেতন করা উচিত।
তার মতে, ইজতেমা সংশিষ্ট কেউ এখানে জুমা পড়াকে বা আখেরি মোনাজাতে অংশগ্রহণকে ফজিলতপূর্ণ বলেন না। কিন্তু কিছু মানুষের মাঝে যেহেতু এমন ধারণা ছড়িয়েছে তাই তাবলিগের সাথী ও আলেমদের পক্ষ থেকে মানুষকে বিষয়টি বোঝানো উচিত।
তিনি বলেন, অনেকে বৃহৎ জামাতের ফজিলতের আলোকে ইজতেমার জুমাকে বিশেষ জুমা হিসেবে প্রমাণ করতে চান, এটা আদৌ ঠিক নয়, কারণ এর ফলে ইসলামে বিকৃতি সাধন করা সহজ হয়, তাই এ থেকে দূরে থাকা কাম্য।
তিনিও আরও যুক্ত করেন, অনেকেই সচেতনতা তৈরি করতে গিয়ে পুরো আয়োজনকেই বেদআত বলে ঘোষণা করেন এটাও ঠিক নয়, বরং মধ্যমপন্থা অবলম্বন করে মানুষকে বোঝানো উচিত।
এদিকে মাদরাসা বানাতিল ইসলামের পরিচালক ও তাবলিগ সংশিষ্ট বিভিন্ন বইয়ের লেখক আলেম মাওলানা আব্দুল্লাহ আল ফারুক ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোনও কার্যক্রম বা সংগঠনের ক্ষেত্রে এর পরিচালক ও সংবিধান প্রণেতার নীতি মূল ও সর্বশেষ কথা বলে বিবেচিত হয়। এখানে অন্য কারও কথা ও ব্যাখ্যা গ্রহণ করা হয় না। তাই তাবলিগ ও ইজতেমা সম্পর্কে যেকোনও বক্তব্য ধর্তব্য ও গ্রহণ করা হবে তখনি যখন তা ইজতেমার বয়ানের মিম্বর থেকে আসবে।
তিনি বলেন, ইজতেমার এতো বছরে কখনও বয়ানের মিম্বর থেকে এমন কোনও বক্তব্য এসেছে বলে জানা নেই, তাই এক্ষেত্রে অন্য কারও ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না এবং এ জাতীয় কথাকে তাবলিগের ভাষ্য হিসেবে গ্রহণ করাও যাবে না।
তিনি আরও বলেন, তাবলিগের সাথীদের মাঝে ফাজায়েলে আমল, হেকায়েতে সাহাবাসহ বেশ কয়েকটি বই পড়ার প্রচলন রয়েছে, তারা তাদের চিল্লা এবং মসজিদ কেন্দ্রিক সাপ্তাহিক ও দৈনিক আমলে এই বইগুলো পড়ে থাকেন। এগুলোতেও কোথাও এমন কোনও ধারণা দেওয়া হয়নি বা এ জাতীয় কিছু বলা হয়নি। তাই ইজতেমা নিয়ে এমন কোনও ধারণা ও কথা গ্রহণযোগ্য নয়।
এই ইসলামি চিন্তাবিদদের মতে, সবাইকে এসব ধারণা, কথা ও মনোভাব থেকে বিরত থাকতে হবে। কেউ এমন ধারণা পোষণ করলে সেটা সংশোধন করা চেষ্টা করতে হবে।