২০২২ সালে বিদায় নিয়েছেন যে আলেমরা
২০২২ সাল একেবারে শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে। হাতছানি দিচ্ছে নতুন বছর ২০২৩। চলতি বছরের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে অনেকেই চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন ফেলে আসা দিনগুলিতে। আনন্দ-উৎসব, অস্থিরতার আরও কিছু অধ্যায় যুক্ত হয়েছে এ বছর। শোকের পাল্লাও ভারি হয়েছে দেশ ও বিশ্ব বরেণ্য অনেক আলেমের বিদায়ে।
একজন আলেমের মৃত্যুকে পৃথিবীর মৃত্যু বলে অভিহিত করা হয়। পৃথিবীর সঙ্কটময় এই সময়ে মানুষকে শোকে কাতর করে রবের ডাকে সাড়া দিয়েছেন যে আলেমরা তাদের তালিকা তুলে ধরা হল-
জাতীয় মসজিদের খতিব মাওলানা সালাহউদ্দিন রহ.
২০২২ সালের শুরুতেই ইন্তেকাল করেন বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব অধ্যাপক মাওলানা মুহাম্মদ সালাহউদ্দিন। ৩ ফেব্রুয়ারি (বৃহস্পতিবার) সন্ধ্যায় রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি বায়তুল মোকাররমের খতিব হিসেবে মাওলানা সালাহউদ্দিনকে নিয়োগ দেয় ধর্ম মন্ত্রণালয়। তবে শারীরিক অসুস্থতা ও বার্ধক্যজনিত কারণে কয়েক বছর তিনি নামাজ পড়াতে পারেননি জাতীয় মসজিদে।
মাওলানা মুহাম্মদ সালাহউদ্দিন ১৯৪৪ সালে নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর থানার কলাগাছিয়া ইউনিয়নের হাজরাদী গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তিনি ঢাকা আলিয়া মাদরাসার ৪৪তম অধ্যক্ষ ছিলেন। ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি রাজধানীর মহাখালীর গাউসুল আজম মসজিদের খতিবের দায়িত্বও পালন করেছেন।
আল্লামা আবদুল হালিম বোখারী রহ.
দেশের শীর্ষ আলেম ও চট্টগ্রামের আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার মহাপরিচালক আল্লামা মুফতি আবদুল হালিম বোখারী ইন্তেকাল করেন ২১ জুন (মঙ্গলবার)। চট্টগ্রাম শহরের সিএসসিআর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন তিনি।
শ্বাস কষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে সিএসসিআর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
আল্লামা আব্দুল হালিম বোখারী সম্মিলিত কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিস বাংলাদেশের মহাসচিব ছিলেন।
এছাড়াও তিনি শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের শরীয়াহ সুপারভাইজারি কমিটির সভাপতি, ইসলামি সম্মেলন সংস্থা বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ তাহফিজুল কুরআন সংস্থার সভাপতি এবং জামিয়া পটিয়ার মুখপাত্র মাসিক আত তাওহীদের প্রধান সম্পাদক ছিলেন।
২০১৮ সালে সরকার কর্তৃক কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদকে মাস্টার্সের স্বীকৃতি প্রদানের নিমিত্তে আল হাইআতুল উলয়া গঠিত হলে তিনি এর স্থায়ী কমিটির সদস্য মনোনীত হন।
মুফতি আবদুল হালিম বোখারী ছিলেন দেশের একজন প্রথিতযশা আলেমে দ্বীন ছিলেন। মাদ্রাসা শিক্ষার উভয় ধারায় তিনি সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জন করেন। সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায়ও তিনি ডিগ্রীপ্রাপ্ত হন। ইলমে হাদিস ও ফিকাহ শাস্ত্রের উপর তিনি গভীর জ্ঞান রাখতেন এবং যুগ সমস্যার উপযোগী সমাধান দিতে পারতেন। তিনি দেশের আলেমদের উল্লেখযোগ্য অংশের দীর্ঘদিন নেতৃত্ব দিয়েছেন।
আল্লামা মুফতি আব্দুল হালিম বুখারী ১৯৪৫ সালের জানুয়ারিতে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া থানার রাজঘাটা (তৎকালীন সাতকানিয়ার অন্তর্গত) গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আব্দুল গণী বুখারী। তার পরদাদা সৈয়দ আহমদ বুখারী উজবেকিস্তানের বোখারার বাসিন্দা ছিলেন।
আল্লামা ইউসুফ কারাযাভী রহ.
বিশ্ববিখ্যাত মুসলিম স্কলার ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব মুসলিম স্কলার্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং বর্ষীয়ান আলেমেদ্বীন শায়খ ড. ইউসুফ আল-কারজাভি ইন্তেকাল করেন ২৬ সেপ্টেম্বর (সোমবার)। মৃত্যুর আগে কয়েক মাস ধরে তিনি অসুস্থ ছিলেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর।
শায়খ প্রফেসর ড. ইউসুফ আবদুল্লাহ আল-কারজাভি (১৯২৬-) মিশরীয় বংশোদ্ভূত একজন প্রভাবশালী আধুনিক ইসলামি তাত্ত্বিক ও আইনজ্ঞ। ২০০৮ সালে এক জরিপে বিশ্বের প্রভাবশালী ২০ চিন্তাবিদ আলেমের তালিকায় তৃতীয় স্থানে উঠে আসে শায়খ ড.ইউসুফ আল-কারজাভির নাম।
শায়খ কারাজাভির জন্ম ১৯২৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর। মিসরের উত্তর নীলনদের তীরবর্তী সাফাত তোরাব গ্রামে। দুই বছর বয়সে বাবা ইন্তিকাল করলে চাচা তার লালন-পালন করেন। দশ বছর বয়সে তিনি সম্পূর্ণ কোরআন হিফজ করেন।
হিফজ সম্পন্ন করে আল-আজহার কারিকুলামে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশোনা করেন। উচ্চ মাধ্যমিকে জাতীয় মেধায় দ্বিতীয় হন। প্রাচীন ইসলামী বিদ্যাপীঠ আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উসুলুদ দ্বীন অনুষদ থেকে অনার্স, আরবি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা এবং পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
শায়খ ইউসুফ কারাজাভি ১৪১১ হিজরিতে ইসলামী অর্থনীতিতে অবদান রাখায় ব্যাংক ফয়সল পুরষ্কার লাভ করেন। ইসলামি শিক্ষায় অবদানের জন্য ১৪১৩ হিজরিতে মুসলিম বিশ্বের নোবেল খ্যাত কিং ফয়সাল অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন ।
১৯৯৭ সালে ব্রুনাই সরকার তাকে ‘হাসান বাকলি’ পুরষ্কারে ভূষিত করে। এছাড়াও তার বৈচিত্র্যময় পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি নানা পদক ও সম্মাননায় ভূষিত হন ।
তার অন্যতম কিছু আন্তর্জাতিক পুরস্কার : এক. কিং ফয়সাল ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ । দুই. ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় পদক, মালয়েশিয়া। তিন. আন্তর্জাতিক পবিত্র কোরআন সম্মাননা পুরস্কার, দুবাই । চার. সুলতান হাসান আল বলকিয়াহ সম্মাননা, ব্রুনাই। পাঁচ. আল-ওয়াইস পদক, সংযুক্ত আরব আমিরাত। ছয়. জর্ডানের মেডেল অব ইন্ডিপেন্ডেন্স।
মুফতি নুরুল আমিন রহ. (বেফাক)
কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সহকারী মহাসচিব ও রাজধানীর জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলুম ফরিদাবাদ মাদরাসার (ফরিদাবাদ মাদরাসা) শাইখুল হাদিস, মাওলানা মুফতি নূরুল আমীন ইন্তেকাল করেন ১২ নভেম্বর (শনিবার)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর।
মসজিদে কুবার ইমাম শায়খ মুহাম্মদ আবিদ আল-সিন্দি রহ.
ইসলামের ইতিহাসে প্রথম নির্মিত মসজিদ, মসজিদে কুবার ইমাম ও খতিব শায়খ মুহাম্মদ আবিদ আল-সিন্দি ইন্তেকাল করেন ২১ নভেম্বর (সোমবার)। তিনি মদিনায় ইন্তেকাল করেন। তিনি মসজিদে নববির সাবেক তারাবির ইমাম ছিলেন।
শায়খ মুহাম্মদ আবিদ আল-সিন্দি সৌদি আরবে জন্মগ্রহণ করেন। ইসলামী শরিয়াহ, উসুলে ফিকাহ, তাফসির, কোরআনুল কারিমসহ বিভিন্ন বিষয়ে গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন তিনি। ১৪০৭ হিজরি সাল থেকে তিন বছর পর্যন্ত তিনি মসজিদে নববীতে শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৪১০ হিজরি থেকে তিনি মসজিদে কুবার ইমাম ও খতিব নিযুক্ত হন।
মুফতি সাদেকুর রহমান রহ.
রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে অবস্থিত জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া মাদরাসার প্রধান মুফতি মাওলানা সাদেকুর রহমান ইন্তেকাল করেন ১২ নভেম্বর।
তিনি ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভাদুঘরে জন্মগ্রহণ করেন। সাদিকুল ইসলাম তিন ভাইয়ের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। শান্ত সুবোধ সাদিকুল ইসলাম ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠেন। তার বাবার নাম কারী আব্দুল আলী।
মুফতি সাদেকুর রহমানের শিক্ষা জীবনের সূচনা হয় স্কুল থেকে। তিনি দেশের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি বিদ্যাপীঠ জামিয়া ইউনুছিয়া, মিফতাহুল উলুম, ঢাকার লালবাগ এবং উম্মুল মাদারিস খ্যাত ‘মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী’ তে পড়াশোনা করেন।
ইসলামী ফিকাহ ওপর গভীর জ্ঞান অর্জনের জন্য তৎকালীন পাকিস্তানের দারুল উলুম করাচি ভর্তি হন। সেখানে এ বিষয়ে পিএইচডি করেন।পরবর্তীতে দেশের মাটিতে ফিরে যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় ইফতা বিভাগ চালু কারেন।
মুফতি রাফি উসমানী রহ.
পাকিস্তানের প্রখ্যাত আলেম, জামিয়া দারুল উলুম করাচির প্রধান, মুফতি রফি উসমানি ইন্তেকাল করেন ১৮ নভেম্বর (শুক্রবার )। দীর্ঘ দিন অসুস্থ থাকার পর তিনি ইন্তেকাল করেন। এসময় তার বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর।
তিনি দেশটির মুফতি আজম (প্রধান মুফতি) খ্যাত মুফতি মুহাম্মাদ শফি রহ.-এর ছেলে ও পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের শরিয়ত আপিল বিভাগের সাবেক বিচারক মুফতি তাকি উসমানির বড় ভাই।
মুফতি রফি উসমানি উপমহাদেশ ভাগের আগে হিন্দুস্থানের দেওবন্দ অঞ্চলে ১৯৩৬ সালের ২১ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি ছিলেন একজন ধর্মীয় পণ্ডিত, আইনবিদ এবং লেখক। বাবা মুফতি শফী রহ.-এর হাতেই তার লেখাপড়ার হাতে খড়ি হয়। তিনি দারুল উলূম দেওবন্দ, পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় এবং দারুল উলুম করাচির সাবেক ছাত্র ছিলেন।
মুফতি রফি উসমানি আহকাম-ই-জাকাত, আল-তালিকাত আল-নাফিয়াহ আলা ফাতহ আল মুলহিম, ইসলাম মে আওরাত কি হুকমরানি এবং নাওয়াদির আল-ফিকহসহ বহু বই লিখেছেন। ফিকাহ, হাদিস এবং তাফসিরে তার জ্ঞানের জন্য স্বীকৃত মুফতি রফি উসমানি উর্দুতে প্রচুর বইয়ের পাশাপাশি আরবি ভাষায়ও উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন।