‘কৌশলে’ প্রবাস কমিটি করছে রাজনৈতিক দলগুলো
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী, বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দল বিদেশের মাটিতে শাখা বা কমিটি গঠন করতে পারবে না। করলে দলের নিবন্ধন বাতিল হবে। তারপরও নানা কৌশলে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত অনেক রাজনৈতিক দল বিদেশে কমিটি গঠন করছে। এসব প্রবাস কমিটির নেতারা বিভিন্ন সময় দেশে এসে রাজনীতি করছেন। সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে এমপিও নির্বাচিত হচ্ছেন।
নির্বাচন কমিশনের ‘রাজনৈতিক দলসমূহের নিবন্ধন আইন-২০২০’ অনুযায়ী, কোনো দলের গঠনতন্ত্রে যদি দেশের ভৌগোলিক সীমার বাইরে কোনো দফতর, শাখা বা কমিটি গঠন ও পরিচালনার বিধান থাকে তাহলে নির্বাচন কমিশনের ধারা ১১ অনুসারে সেই রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল হবে।
নির্বাচন কমিশনের ‘রাজনৈতিক দলসমূহের নিবন্ধন আইন-২০২০’ অনুযায়ী, কোনো দলের গঠনতন্ত্রে যদি দেশের ভৌগোলিক সীমার বাইরে কোনো দফতর, শাখা বা কমিটি গঠন ও পরিচালনার বিধান থাকে তাহলে নির্বাচন কমিশনের ধারা ১১ অনুসারে সেই রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল হবে
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাশের দেশ ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান ও আফগানিস্তান ছাড়া বিশ্বের প্রায় ৩০টির মতো দেশে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর শাখা বা কমিটি আছে। কিন্তু এসব কমিটি গঠন আরপিও’র লঙ্ঘন বিধায় তা গণমাধ্যমে জানানো হয় না। অনেকটা গোপনেই এসব কমিটি করে দলগুলো। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধি প্রবাসে গিয়ে কমিটি গঠন করে আসেন।
দলগুলোর নেতারা বলছেন, পাশের কয়েকটি দেশ আমাদের রাজনীতিতে বিশেষ করে নির্বাচনের সময় সরাসরি প্রভাব বিস্তার করে। তাই এসব দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর শাখা বা কমিটি দেওয়া হয় না। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কুয়েত, জাপান, ইতালি, লেবানন ও আরব আমিরাতে বাংলাদেশি প্রবাসীরা বেশি বসবাস করেন। তাদের দিয়েই রাজনৈতিক দলগুলো প্রবাস কমিটি গঠন করে। এসব কমিটির নেতারা অনেক সময় দেশে ও প্রবাসে দুই জায়গাতেই রাজনীতি করেন। তাদের অনেকে দেশে এসে মনোনয়ন নিয়ে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন। কেউ কেউ আবার সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হন।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কুয়েত, জাপান, ইতালি, লেবানন ও আরব আমিরাতে বাংলাদেশি প্রবাসীরা বেশি বসবাস করেন। তাদের দিয়েই রাজনৈতিক দলগুলো প্রবাস কমিটি গঠন করে। এসব কমিটির নেতারা অনেক সময় দেশে ও প্রবাসে দুই জায়গাতেই রাজনীতি করেন। তাদের অনেকে দেশে এসে মনোনয়ন নিয়ে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন। কেউ কেউ আবার সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হন
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রাজনৈতিক দলের মহাসচিব বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে আমরা দেখেছি কীভাবে পাশের একটি দেশ সরাসরি হস্তক্ষেপ করল। তবে, এটা যে প্রথম ছিল তা নয়। এর আগে-পরেও পাশের দেশগুলো বাংলাদেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছে। এ কারণে দেশগুলোতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের রাজনৈতিক কোনো কমিটি নেই।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেশে দলের কার্যক্রম আছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির। এ দুটি দলের ৩০টির বেশি দেশে প্রবাস শাখা বা কমিটি রয়েছে। এরপর জাতীয় পার্টি, ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বিকল্পধারা, জাকের পার্টি, ইসলামী ফ্রন্ট বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোটের মতো দলগুলোর প্রবাসে শাখা বা কমিটি আছে।
আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা যায়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, জাপান, কুয়েতসহ বিশ্বের প্রায় ৩৫টি দেশে দলটির প্রবাস কমিটি আছে। এসব দেশে বসবাসরত বাঙালিরা সেখানে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এসব প্রবাস কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকরা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে কাউন্সিলর ও ডেলিগেট হিসেবে আমন্ত্রিত হন। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফেনীর আসন থেকে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সৌদি আরব আওয়ামী লীগ শাখার সভাপতি রহিম উল্লাহ।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা বিষয়টিকে নিরুৎসাহিত করি। কিন্তু প্রবাসী বাংলাদেশিরা যদি সে দেশের আইন মেনে, এক জায়গায় বসে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করেন সেটা তো আমরা নিষিদ্ধ করতে পারি না।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, জাপান, সৌদি আরব, ইতালি, লেবানন, আরব আমিরাত ও কুয়েতে প্রবাস কমিটি আছে দলটির।সাধারণত দলের জাতীয় সম্মেলনে এসব দেশের কমিটিগুলোর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষিত হয়। কাউন্সিলর হিসেবে তারা সম্মেলনে ভোট বা মতামত দিতে পারেন।
বিএনপির প্রবাস কমিটিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় যুক্তরাজ্যের কমিটি। সেখানে বসবাসরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে কেন্দ্র করে বেশি সক্রিয় তারা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান এ বিষয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের গঠনতন্ত্রে ‘প্রবাস সংগঠন’ নামের একটি ধারা আছে। এই গঠনতন্ত্র নির্বাচন কমিশন কর্তৃক অনুমোদিত। সুতরাং ধারাটিও ইসি কর্তৃক অনুমোদিত।
বিশ্বের প্রায় ১০টির মতো দেশে জাতীয় পার্টির কমিটি আছে বলে জানান দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরবসহ কয়েকটি দেশে আমাদের কমিটি আছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এসব কমিটি তো আমরা গিয়ে করে দিয়ে আসি না। সেখানকার প্রবাসীরা এসব কমিটি করেন।’
জাকের পার্টির সদ্য সাবেক মহাসচিব এজাজুর রসুল ঢাকা পোস্টকে বলেন, কাতার, সৌদি আরব, বাহরাইনসহ বেশকিছু দেশে আমাদের প্রবাস কমিটি আছে। সেখানকার প্রবাসী বাঙালিরা কমিটি করে দেশে পাঠালে আমাদের দলের চেয়ারম্যান সেগুলোর অনুমোদন দেন।
বিকল্পধারা বাংলাদেশের মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের এখন সক্রিয় দুটি প্রবাস কমিটি আছে। একটি নিউ ইয়র্ক আরেকটি লন্ডনে। এর বাইরে ইতালি ও ফ্রান্সে কমিটি ছিল। তবে, সেগুলো মনে হয় এখন আর সক্রিয় নেই।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আব্দুল জলিল বলেন, দুবাই, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতারসহ কয়েকটি দেশে আমাদের কমিটি আছে। তবে, আমরা তো আওয়ামী লীগ-বিএনপির মতো কমিটি করতে পারি না।
ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনেক দেশে ইসলামী ঐক্যজোটের কার্যক্রম আছে। তারা তো দেশের মতো সেখানে মিটিং-মিছিল করতে পারেন না। সেখানকার আইন অনুযায়ী যতটুকু করা যায়, ততটুকু করেন। আর দেশে আসলে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন তারা।
অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দল আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু এক সাক্ষাৎকারে ঢাকা পোস্টকে বলেন, মালয়েশিয়া, সৌদি আরবসহ বেশকিছু দেশে এবি পার্টির সাংগঠনিক কমিটি আছে। তিনি বলেন, আরপিওতে বলা হয়েছে, ‘দেশের বাইরে কোনো কমিটি থাকতে পারবে না।’ আবার এটাও বলা আছে যে ‘প্রবাসীরা রাজনৈতিক দলের সদস্য হতে পারবেন’। অর্থাৎ প্রবাস কমিটি নিয়ে স্ববিরোধী বক্তব্য দিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। এর পরিবর্তন প্রয়োজন।
প্রবাসে রাজনীতি করেন এমন কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। নাম প্রকাশ না করে তারা বলেন, প্রবাসে যেসব রাজনৈতিক দলের শাখা আছে, তাদের মধ্যে সক্রিয় কেবল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কমিটিগুলো। দেশের রাজনীতির মতো তাদেরও বছরব্যাপী সক্রিয় কর্মসূচি থাকে। তবে, দলের সভাপতি বা চেয়ারম্যানের বিদেশ সফরকে কেন্দ্র করে প্রবাস কমিটিগুলোর তৎপরতা বেড়ে যায়।
এক্ষেত্রে একপক্ষ দলীয়প্রধানকে শুভেচ্ছা জানিয়ে কর্মসূচি দেয়। বিরোধীপক্ষ তার সফরের প্রতিবাদে কর্মসূচি পালন করে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে দেশ সফর করেন, সেই দেশের প্রবাস কমিটি তাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে কর্মসূচি পালন করে। অন্যদিকে, বিএনপি তার সফরের প্রতিবাদে কর্মসূচি দেয়। একই অবস্থা লক্ষ করা যায় বিরোধীপক্ষ ক্ষমতায় থাকলে।
এএইচআর/এমএআর/