‘অরাজনৈতিক’ হেফাজতের যত রাজনৈতিক নেতা
‘হেফাজতে ইসলাম একটি অরাজনৈতিক সংগঠন’— বরাবরই এমন দাবি করে আসছেন সংগঠনটির নেতারা। কিন্তু তাদের অধিকাংশ নেতা কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত। তাদের কেউ কেউ সর্বশেষ ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের’ ব্যানারে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন।
হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটির বর্তমান শীর্ষ দুই নেতা (আমির ও মহাসচিব) সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য নন। তবে ২০১৩ সাল থেকে হেফাজতের আমির আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী সরকারবিরোধী হিসেবে পরিচিতি পান।
২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর মতিঝিল শাপলা চত্বরে তাণ্ডবের পরদিন হেফাজতের তৎকালীন আমির আল্লামা আহমদ শফীকে সরকার নিরাপদে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে পাঠিয়ে দেয়। অন্যদিকে, তৎকালীন কমিটির মহাসচিব বাবু নগরীকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়। আহমদ শফীর মৃত্যুর পর বাবু নগরীর নেতৃত্বাধীন গঠিত হেফাজতের নতুন কমিটির সঙ্গে সরকারের দূরত্ব দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।
এদিকে, হেফাজতের ঢাকা মহানগরী কমিটির শীর্ষ দুই নেতা সরাসরি দুটি রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। ঢাকা মহানগর কমিটির সভাপতি জুনায়েদ আল হাবীব রাজনৈতিক দল ‘জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের’ কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি। আর মহানগর হেফাজতের মহাসচিব আল্লামা মামুনুল হক আরেক রাজনৈতিক দল ‘খেলাফত মজলিসের’ মহাসচিবের দায়িত্বে আছেন।
১৫১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটিতে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, নেজামে ইসলাম পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট ও বাংলাদেশ ফরায়েজী আন্দোলনের রাজনৈতিক দলের নেতারা স্থান পেয়েছের। এর বাইরে সাবেক জামায়াত ও বিএনপির কয়েকজন নেতাও পদ পেয়েছেন
হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১৫১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটিতে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, নেজামে ইসলাম পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট ও বাংলাদেশ ফরায়েজী আন্দোলনের রাজনৈতিক দলের নেতারা স্থান পেয়েছের। এর বাইরে সাবেক জামায়াত ও বিএনপির কয়েকজন নেতাও পদ পেয়েছেন।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের ৩২ জন নেতা হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদ পান। এর মধ্যে জমিয়তের মহাসচিব মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী হেফাজতের মহাসচিব হয়েছিলেন। গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। ফলে বর্তমানে হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটিতে দলটির ৩১ জন নেতা রয়েছেন।
হেফাজতের উপদেষ্টা পরিষদে আছেন জমিয়তের দুই নেতা মাওলানা জিয়াউদ্দীন ও মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক। হেফাজতের নায়েবে আমির পদে আছেন জমিয়তের ছয় নেতা। তারা হলেন- মাওলানা আব্দুল হামিদ (পীর মধুপুর), মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ সাদী (মোমেনশাহী), মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী (হাটহাজারী), মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া (আরজাবাদ), মাওলানা আনোয়ারুল করিম (যশোর) ও মাওলানা নুরুল ইসলাম খান (সুনামগঞ্জ)।
হেফাজতের চার যুগ্ম মহাসচিবের মধ্যে দুজন জমিয়তের নেতা। তারা হলেন− মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব ও মাওলানা নাসির উদ্দিন মুনির। হেফাজতের সহকারী মহাসচিবের স্থান পেয়েছেন জমিয়তের দুই নেতা- মাওলানা ফজলুল করীম কাসেমী ও মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি।
হেফাজতের সহকারী সাংগঠনিক সম্পাদক পদে আছেন জমিয়তের নেতা মাওলানা মাসউদুল করীম (টঙ্গী), মাওলানা শামসুল ইসলাম জিলানী ও মাওলানা তাফহিমুল হক (হবিগঞ্জ)।
হেফাজতের অর্থ সম্পাদক পদে আছেন জমিয়তের নেতা মুফতি মুনির হোসাইন কাসেমী। হেফাজতের চার সহকারী অর্থ সম্পাদকের একজন জমিয়তের নেতা মাওলানা লোকমান মাজহারী।
হেফাজতের পাঁচ সহকারী প্রচার সম্পাদক পদে জমিয়তের তিন নেতা স্থান পেয়েছেন। তারা হলেন− মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াকুব ওসমানী, মুফতি শরীফুল্লাহ ও মাওলানা ফেরদাউসুর রহমান (নারায়ণগঞ্জ)। সংগঠনটির আইন বিষয়ক সম্পাদক জমিয়তের নেতা মাওলানা শাহীনুর পাশা চৌধুরী। দাওয়াহ সম্পাদক পদ পেয়েছেন জমিয়ত নেতা মাওলানা নাজমুল হাসান, সহকারী আন্তর্জাতিক সম্পাদক পদ পেয়েছেন জমিয়ত নেতা মাওলানা শুয়াইব আহমদ, মাওলানা গোলাম কিবরিয়া (লন্ডন), সহকারী দফতর সম্পাদক পদ পেয়েছেন জমিয়ত নেতা মাওলানা সিদ্দিকুল ইসলাম তোফায়েল।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ইসলামী ঐক্যজোটের দুজন হেফাজতের কমিটিতে আছেন। ইসলামী ঐক্যজোটের সমাজকল্যাণ সম্পাদক মাওলানা ফজলুল্লাহ হেফাজতের উপদেষ্টা। হেফাজতের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক উবায়দুর রহমান খান নদভী ইসলামী ঐক্যজোটের ভাইস চেয়ারম্যান
হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য পদ পেয়েছেন জমিয়ত নেতা জামিল আহমদ চৌধুরী (মৌলভীবাজার), বশির আহমদ (মুন্সিগঞ্জ), তাফাজ্জুল হক আজিজ (সুনামগঞ্জ), আলী আকবর (সাভার), আবু আব্দুর রহিম (নরসিংদী), আব্দুল কুদ্দুস (মানিকনগর), মুহাম্মদ উল্লাহ জামি ও মাওলানা হাবিবুল্লাহ মাহমুদ কাসেমী।
বিএনপি জোটের আরেক শরিক দল খেলাফত মজলিসের ছয় নেতা হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আছেন। হেফাজতের উপদেষ্টা পরিষদে আছেন খেলাফতের আমির মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক। হেফাজতের নায়েবে আমির পদে আছেন খেলাফতের মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের, সহকারী মহাসচিব পদে আছেন খেলাফত নেতা মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন (খুলনা), মাওলানা শফিক উদ্দিন (মৃত), সহকারী আন্তর্জাতিক সম্পাদক পদে আছেন খেলাফতের নেতা হযরত মাওলানা আবদুল কাদের সালেহ (লন্ডন) ও খেলাফত সদস্য মাহমুদ কাসেমী।
আরেক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আট নেতা হেফাজতের কমিটিতে আছেন। তারা হলেন- বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা ইসমাইল নূরপুরী, তিনি হেফাজতের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। দলটির সাবেক মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক হেফাজতের নায়েবে আমির।
খেলাফতের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা মুহাম্মদ মামুনুল হক হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর কমিটির মহাসচিব, হেফাজতের সহকারী মহাসচিব পদে স্থান পেয়েছেন খেলাফতের নেতা মাওলানা খুরশিদ আলম কাসেমী ও মাওলানা জালাল উদ্দিন আহমদ। হেফাজতের সহকারী সাংগঠনিক সম্পাদক পদে আছেন খেলাফতের মাওলানা আতাউল্লাহ আমিন। হেফাজতের সহপ্রচার সম্পাদক খেলাফতের নেতা মওলানা ফয়সাল আহমদ।
ইসলামী আন্দোলনের দুজন হেফাজতের কমিটিতে স্থান পেয়েছেন। তারা হলেন- হেফাজতের নায়েবে আমির মাওলানা ইউনুস আহমদ (রংপুর), যিনি ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব এবং ইসলামী আন্দোলনের মাওলানা আব্দুল আউয়াল (নারায়ণগঞ্জ)।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ইসলামী ঐক্যজোটের দুজন হেফাজতের কমিটিতে আছেন। ইসলামী ঐক্যজোটের সমাজকল্যাণ সম্পাদক মাওলানা ফজলুল্লাহ হেফাজতের উপদেষ্টা। হেফাজতের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক উবায়দুর রহমান খান নদভী ইসলামী ঐক্যজোটের ভাইস চেয়ারম্যান। হেফাজতের নায়েব আমির হিসেবে আছেন বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির চেয়ারম্যান মাওলানা সারওয়ার কামাল আজিজী।
এছাড়া হেফাজতের সহকারী আইন বিষয়ক সম্পাদক পদে আছেন জামায়াতের চট্টগ্রাম নগরের সাবেক আইন বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন।
হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমিরের পদে আছেন (সদ্য পদত্যাগী) বাংলাদেশ ফরায়েজী আন্দোলনের সভাপতি মাওলানা আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ হাসান। হেফাজতের সহকারী মহাসচিবর পদে আছেন রাজনৈতিক দল নেজামে ইসলাম পার্টির নেতা মাওলানা মুসা বিন ইজাহার।
গ্রেফতার হওয়ার আগে ‘হেফাজতের কমিটিতে রাজনৈতিক নেতাদের রাখার বিষয়ে’ জানতে চাইলে হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেছিলেন, ‘হেফাজতের কমিটিতে জমিয়ত, মজলিস, নেজামে ইসলামসহ অনেক ইসলামী দলের নেতারা আছেন। রাজনৈতিক দলের নেতারা থাকলেও তারা কেউ হেফাজতের ব্যানারে রাজনীতি করেন না।’
এএইচআর/এইচকে/এমএআর/