স্বাধীনতা: বাঙালির ঐতিহ্যের নবায়ন
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর। বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী। একটি রাষ্ট্রের গৌরবময় উচ্চারণ। এই স্বপ্ন ও স্পর্ধার মাহেন্দ্রক্ষণে উপনীত আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। এ সময়ে এসে প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার গাছ পাথরে বাংলাদেশকে চুলচেরা বিশ্লেষণের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। আর্থ-সামাজিকের সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাস-ঐতিহ্যের মূল্যায়নও জরুরি এবং অত্যাবশ্যক হয়ে উঠেছে।
বস্তুত-বাঙালির ঐতিহ্য বহুমাত্রিক, বিচিত্র এবং স্বীকৃত স্পর্ধা। যেসব ঐতিহ্যে চিরায়ত সেই বাঙালিকে আবিষ্কার করা যায়, তার মধ্যে অন্যতম হলো ধর্মনিরেপক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্য। এ ঐতিহ্যে নির্মিত হয়েছে হাজার বছরের বাঙালির মানস। তাদের প্রাত্যহিক আচরণে এবং জীবন প্রবাহে তার ঘটেছে সুস্পষ্ট প্রতিফলন। এ প্রতিফলিত দৃষ্টিভঙ্গি ও সংস্কৃতির আত্মপ্রকাশ ঘটেছে সহস্র বর্ষ বিস্তৃত বাংলা সাহিত্যে।
এ কথা সত্য রাষ্ট্রযন্ত্র যখন কর্তৃত্ববাদী, আগ্রাসী এবং প্রজাপীড়ক তখন রাজক্ষমতাকে স্থায়ী করার প্রয়োজনে রাষ্ট্রযন্ত্র ধর্মের অপপ্রয়োগে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ায়। বিভ্রান্ত করে জনগণকে। বাঙালির সমাজে এ ভ্রষ্টতার দৃষ্টান্ত বিরল। যে সামান্য দু-একটি আছে তা হলো সেন আমলে হিন্দু রাজন্যবর্গ ভ্রষ্টতার চূড়ান্ত প্রকাশে বিপন্ন করেছিল বৌদ্ধদের। যার প্রতিফলন আছে চর্যাপদে।
সহজিয়া সিদ্ধাচার্যদের সাধন প্রণালির সংগীতের অন্তরালে আছে সাম্প্রদায়িকতা দুষ্ট বাঙালি সমাজের বাস্তব চিত্র। দ্বাদশ খ্রিষ্টাব্দে তুর্কিদের বঙ্গ দখলের মধ্যে দেখা গেল সাম্প্রদায়িকতা। বিজয়ী মুসলমান শাসকগোষ্ঠী হিন্দু প্রজাপীড়নে সক্রিয় হয়ে ওঠে। তাদের নিষ্ঠুর শাসন ও শোষণে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হয়। বাঙালি সমাজ চিরায়ত সম্প্রীতির সৌন্দর্য থেকে বিচ্যুত হয়।
বিরল নয় যে দৃষ্টান্ত তা হলো ধর্ম-বর্ণে মানুষের সম্প্রীতি। হিন্দু রাজন্যবর্গ ও তুর্কি ভিন্ন মোঘল আমলের পুরোটা সময়ই মানবিক ঐক্যের কাল। মোঘল আমলে বাংলায় যারা শাসন করেছেন তারা অর্থনৈতিকভাবে শোষণও করেছেন। তবে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে শাসন যন্ত্রকে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু ধর্ম-বর্ণের অপব্যবহার করেননি।
দ্বাদশ-অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বাংলা অধিকৃত ছিল বহিরাগত শাসকদের দ্বারা। তারা রাজক্ষমতার কর্তৃত্ব নিশ্চিত করতে যতটুকু শাসনকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন তার চেয়ে কম হননি প্রজাপ্রীতি সিক্ত। তারা প্রজা সন্তুষ্টিতে সক্রিয় থেকেছেন। যার কারণে দেখা যায় মধ্যযুগের বাংলা প্রায় প্রজা বিদ্রোহহীন। বিচ্ছিন্ন দু-চারটি ঘটনা ছাড়া।
দ্বাদশ খ্রিষ্টাব্দে তুর্কিদের বঙ্গ দখলের মধ্যে দেখা গেল সাম্প্রদায়িকতা। বিজয়ী মুসলমান শাসকগোষ্ঠী হিন্দু প্রজাপীড়নে সক্রিয় হয়ে ওঠে। তাদের নিষ্ঠুর শাসন ও শোষণে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হয়।
এই যে প্রজাপ্রীতি যা রাজক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী ও শঙ্কাহীন করেছে তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ধর্ম সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি নিশ্চিত করা। শাসকগণ সেটি সুচারুরূপে করতে পেরেছিলেন। যার দৃষ্টান্ত প্রচুর। এ প্রসঙ্গে ড. আহমদ শরীফ বলেন, ব্যবহারিক জীবনে বর্ণে-বর্ণে, জাতে-জাতে ও হিন্দু-মুসলমানে একটা কেজো সহযোগিতা ও সাহচর্য ছিল। যেমন নাপিত, ধোপা, তাঁতি, মাঝি, চাষি, মালী প্রভৃতির সঙ্গে প্রায় প্রাত্যহিক ঘরোয়া সম্পর্ক রাখা সেখানে অপরিহার্য ছিল। সেখানে অস্পৃশ্যতার, অবজ্ঞার, ঔদাসীন্যের, অপ্রেমের ও বিদ্বেষের এই আন্তরিক দুস্তর ব্যবধান সম্ভব হতো না।
তা সত্ত্বেও হাজার হোক মানুষ তো। ব্যক্তি মানুষ তাই ক্ষণে ক্ষণে নানা প্রতিবেশে মানবিক গুণের এবং উদার ও মহৎ অনুভূতির বশীভূত হয়ে পড়বেই। ফলে বিভিন্ন বর্ণের, সম্প্রদায়ের ও ধর্মাবলম্বীর মধুর মিলন ও আত্মীয়তা দেখতে পায়। তাছাড়া স্বার্থবুদ্ধিও মানুষের মিলন ও ঐক্য ঘটায়। তখন দেশ, জাত, ধর্ম ও বর্ণ কোথাও বাধা হয়ে দাঁড়ায় না।
এ ধ্রুব সত্য বাঙালির জীবনে আঠারো শতক অবধি বিদ্যমান ছিল যার সূচনা প্রকৃত অর্থেই সুপ্রাচীনকাল থেকে। এর ব্যতিক্রম বিচ্ছিন্ন দু-চারটি ঘটনা যা পূর্বে বলা হয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলার যোগ-সংখ্যা-তন্ত্র-অষ্ট্রিক-মোঙ্গলীয় শংকর মানুষের মধ্যে বহু পূর্ব থেকে ছিল জৈন-বৌদ্ধের সাম্য-সহিষ্ণুতার ঐতিহ্য। যার দ্বারা নির্মিত হয়েছে বাঙালির মানস। যে মানসে সুস্পষ্ট হয়েছে প্রাণের মর্যাদা ও সহাবস্থানের অধিকার। যেখানে করুণা, প্রীতি, মৈত্রী, সাম্য ও সহনশীলতা যুগিয়েছে প্রেরণা।
প্রাচীনকালের এ প্রেরণাজাত মানস প্রসূত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নতুন প্রকাশ লক্ষ করা যায় মধ্যযুগে শ্রীচৈতন্যদেবের কর্ম প্রয়াসে। তার প্রবল, সক্রিয় ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব এবং প্রভাব বিস্তারই সম্মোহনী ক্ষমতা বাঙালি মানসকে মিলন প্রয়াসী ও সম্প্রীতি মনস্ক করে তুলল। তিনি ও তার শিষ্যগণ বাঙালি মানসকে সাম্প্রদায়িক ক্ষুদ্রতার ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে ওঠার পথ তৈরি করে দিয়েছিলেন। যে পথে বাঙালি চলেছে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত। সে পদযাত্রীরা ইতিহাসে খ্যাতি পেয়েছে অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি হিসেবে। তাদের প্রাত্যহিক আচরণে তা সুস্পষ্ট হয়েছে।
যার কারণে দেখা যায়, বাঙালি হিন্দুর পূজায় মুসলমান বাঙালির উপস্থিতি এবং মুসলমানদের ঈদে হিন্দুর আনন্দ। একই গ্রামে পাশাপাশি দুই ধর্ম সম্প্রদায়ের প্রীতিময় অবস্থান। কাঁসর ঘণ্টা বা মসজিদের আজান কারওরই শান্তিতে বিঘ্ন সৃষ্টি করে না। জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রা বা ঈদে মিলাদুন্নবীর আনন্দ যাত্রায় কিংবা মহররমের শোক মিছিলে কারওরই অসন্তোষ প্রকাশিত হয়নি। বরং ধর্ম সম্প্রদায়ের ঔদার্যে সেসব আয়োজন সার্থকতা লাভ করেছে।
বলা যায় মধ্যযুগের প্রান্তসীমা পর্যন্ত বাঙালি মানস ও সমাজ ছিল ধর্ম সম্প্রদায়ের দ্বন্দ্ব মিলনমুখী এবং কখনো কখনো দ্বন্দ্বহীন সম্প্রীতিময়। তাদের যুক্ত সাধনায় ঋদ্ধ হয়েছে বাংলা সাহিত্য এবং উৎকৃষ্ট হয়েছে বাঙালি সমাজ। সে সমাজ প্রতিফলিত হয়েছে বহুমাত্রিক সৃজনে।
১৭৫৭ সালে কোম্পানির কাছে বাংলার নবাবের পরাজয় হলো। সর্বনাশটা হলো তখনই। কোম্পানি মানে ইংরেজ বিজয়ী হলো। আর পরাজয় হলো বাংলার। সত্য প্রতিষ্ঠা পেল না। ইংরেজদের সুপরিকল্পিত প্রচারণায় প্রসিদ্ধি লাভ করল ইংরেজদের কাছে মুসলমানের পরাজয়। এক সময়ের ক্ষমতার পালাবদলকে এবার পরিচিতি দিলো হিন্দুর কাছ থেকে মুসলমানরা ক্ষমতা হরণ করেছিল। তাই মুসলমানের পরাজয়ে হিন্দুকে উৎফুল্ল হতে হলো।
আর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে ইংরেজ প্রচারিত কথাগুলো সত্যে রূপলাভ করে। বাংলায় হিন্দু-মুসলমানকে দূরত্বে নিয়ে গেল। নষ্ট হলো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। নষ্ট হলো বাঙালি মানস। ইংরেজদের দ্বৈত শাসন নীতির ফলে বাঙালি তার ধর্মনিরপেক্ষতার উৎকৃষ্ট পথ থেকে বিচ্যুত হলো।
লক্ষ করা গেল যখনই ভারতবর্ষে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত হলো তখনই ইংরেজ শাসক সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের জন্ম দিয়েছে। বিভেদের নীতি নিয়ে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছে। ইংরেজ আমলে গুজরাট, কাশ্মীর, অযোধ্যা প্রভৃতি স্থানে সৃষ্ট দাঙ্গার প্রভাব এসে পড়ে বাংলায়।
শ্যামবাজার, চিৎপুর, ময়মনসিংহ, জামালপুর, মৌলালি, হাওড়া, নোয়াখালী প্রভৃতি দাঙ্গায় বাঙালি সমাজ সুস্পষ্টত দ্বিধা বিভক্ত হয়ে যায়। হিন্দু-মুসলমান বিরোধ বাঙালি সমাজ ও মানসে ধীরে ধীরে সক্রিয় ও স্থায়ী দ্বন্দ্বের জন্ম দেয়। সে হিসেবে বলা যায় প্রায় দুইশত বছরের ঔপনিবেশিক শাসনে বাঙালি মানস চিরায়ত ধর্মনিরপেক্ষতা বিচ্যুত হয়ে গেল। তাদের মধ্যে জন্ম নেয় সাম্প্রদায়িকতা।
সমাজ ও মানস যেহেতু পরস্পর সম্পর্কযুক্ত সেহেতু বাঙালি সমাজ ও মানস ঐতিহ্য বিচ্যুত এবং সাম্প্রদায়িকতা দোষে দুষ্ট হয়ে গেল। এবার এলো ভারতবর্ষের স্বাধীনতা। জিন্নাহ’র ভ্রান্ত দ্বিজাতিতত্ত্বে বিভক্ত হলো ভারত। জন্ম হলো মুসলমানের পাকিস্তান।
রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে ইংরেজ প্রচারিত কথাগুলো সত্যে রূপলাভ করে। বাংলায় হিন্দু-মুসলমানকে দূরত্বে নিয়ে গেল। নষ্ট হলো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। নষ্ট হলো বাঙালি মানস। প্রায় দুইশত বছরের ঔপনিবেশিক শাসনে বাঙালি মানস চিরায়ত ধর্মনিরপেক্ষতা বিচ্যুত হয়ে গেল।
সদ্যজাত পাকিস্তান পূর্বাংশের বাঙালিকে পাকিস্তানি বানানোর জন্য তৎপর হলো। তারা নাম পরিবর্তন করে পূর্ব বাংলাকে বানালও পূর্ব পাকিস্তান। মানুষকে বাঙালি জাতিসত্তা থেকে বিচ্যুত করে সাম্প্রদায়িক করার উদ্যোগ নিলো। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ঐতিহ্য প্রায় বিচ্ছিন্ন বাঙালি মানসে আঘাত হানলো। বাঙালি হারানো সংস্কৃতির শক্তির প্রেরণা পেল।
পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের মানস কোণে লুপ্তপ্রায় বাঙালি সত্তা জেগে ওঠল। সে তার ঐতিহ্যের আলো দেখল। বাঙালির আত্ম উপলব্ধির স্ফুরণ তাকে বেগবান করল ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে। বাঙালির বিজয় এবং মুসলিম লীগের পরাজয়।
বাঙালি মানস ও সমাজে এ দু’য়ের ইতিবাচক আঘাতের পর এলো ১৯৬৬ সালের ৬ দফা। যেখানে বাঙালির অধিকার নিশ্চিত করার প্রত্যয় ঘোষিত হলো। বাঙালির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত ৬ দফাকে নিয়ে গেলেন প্রান্তিক বাঙালির কাছে। ফলে বাংলাদেশের জন্ম সম্ভাবনা যেমন দেখা গেল তেমনি বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষতার ঐতিহ্য চেতনার সুস্পষ্ট প্রকাশও লক্ষ করা গেল। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ও ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পথ ধরে এলো মহান মুক্তিযুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধ কেবল বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ নয়। বাঙালির সামগ্রিক চৈতন্যের মুক্তি। ত্রিশ লক্ষ শহীদ, দুই লক্ষ নারীর সম্ভ্রমহানি ও নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে যে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হলো তার পশ্চাতে আছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমান্য অবদান। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশ দেওয়ার পাশাপাশি বাঙালিকে তার হারানো গৌরব, ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্য ফিরিয়ে দিয়েছেন।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে আমাদের সব স্তরের উন্নয়নের পূর্বশর্ত এই নবায়নকৃত ঐতিহ্য। একে পাশ কাটিয়ে অবহেলায় দূরে সরিয়ে কিংবা সচেতন উপেক্ষায় এড়িয়ে গেলে সর্বনাশ হবে জাতির। রাষ্ট্র হবে বিপন্ন। তাই ঐতিহ্যের নবায়নকৃত ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতাকে রাষ্ট্রের অতি আবশ্যক অনুষঙ্গ বিবেচনা করে এদের সঙ্গে নিয়েই চলতে হবে বাংলাদেশকে। সে চলাই কর্তব্য।
অধ্যাপক ড. রতন সিদ্দিকী ।। শিক্ষাবিদ ও নাট্যকার
[email protected]