বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও বাঙালির প্রতি দায়বোধ
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ভারতীয় বিমান বাহিনীর বিশেষ বিমানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার স্বপ্নের স্বাধীন স্বদেশ ভূমিতে ফিরে আসেন। তদানীন্তন রেসকোর্স ময়দানে জাতির পিতা আবারও বাংলার জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। তিনি নিজেই তার এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘অন্ধকার হতে আলোর পথে যাত্রা’ (A Journey from darkness to light)।
অতি সাধারণ অথচ অনন্য অসাধারণ আস্থা বাণীতে পরিপূর্ণ কিছু বাক্য, সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলার মানুষকে একেবারে ভাঙচুর অবস্থান থেকে মেরুদণ্ড সোজা রাখবার আহ্বান করেছিলেন সেই ভাষণে। আজও যতবার ভাষণটি পড়ি ততবার বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা গভীর হতে গভীরতরে পৌঁছায়।
ভাষণটি শুরুই করেছিলেন তিনি, ‘আমি প্রথমে স্মরণ করি আমার বাংলাদেশের ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী জনগণকে, হিন্দু মুসলমানকে, যাদের হত্যা করা হয়েছে আমি তাদের আত্মার মঙ্গল কামনা করি।’
আরও পড়ুন
২৯০ দিন পাকিস্তানের কারাবাস শেষে ১৯৭২ সালের এই দিনে লন্ডন-দিল্লি হয়ে মুক্ত স্বাধীন স্বদেশের মাটিতে ফিরে আসেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর প্রহসনের বিচার বন্ধ করে মুক্তির জন্য পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে চাপ দেওয়ার বিষয়ে অনুরোধ জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৬৭টি দেশের সরকার প্রধান ও রাষ্ট্রপ্রধানকে চিঠি দেন। অন্যদিকে তিনি ইউরোপের ৫টি দেশ ও যুক্তরাষ্ট্র সফর করে বিশ্বজনমত বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের অনুকূলে আনতে সক্ষম হন। ফলে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার পক্ষে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা সম্ভব হয়নি।
জাতির পিতা সেসব কথা ভুলে যাননি। তার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন বারবার স্মরণ করিয়ে দেয় যে, তিনি কতটা নৈতিক মূল্যবোধ নিয়ে পথ হাঁটতেন। ভাষণে তাই উল্লেখ করেছিলেন তিনি, ‘আমি মোবারকবাদ জানাই ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে, আমি মোবারকবাদ জানাই ভারতবর্ষের জনগণকে, আমি মোবারকবাদ জানাই ভারতবর্ষের সামরিক বাহিনীকে, আমি মোবারকবাদ জানাই রাশিয়ার জনগণকে, আমি মোবারকবাদ জানাই জার্মানি, ব্রিটিশ, ফ্রান্স সব জায়গার জনগণকে তাদের আমি মোবারকবাদ জানাই যারা আমাকে সমর্থন করেছে।’
অতি সাধারণ অথচ অনন্য অসাধারণ আস্থা বাণীতে পরিপূর্ণ কিছু বাক্য, সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলার মানুষকে একেবারে ভাঙচুর অবস্থান থেকে মেরুদণ্ড সোজা রাখবার আহ্বান করেছিলেন সেই ভাষণে।
স্বাধীনতা ঘোষণা দেওয়ার পরপরই দখলদার পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসা থেকে গ্রেফতার করে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে আটকে রাখে। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতেই দেশে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। একদিকে যখন অবরুদ্ধ বাংলাদেশে তখন পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ যুদ্ধ চলছে, ঠিক তখন পশ্চিম পাকিস্তানে প্রহসনের বিচারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়।
কারাগারের যে সেলে তাকে রাখা হয়েছিল, সেই সেলের পাশে কবর খুঁড়েছিল ওরা, আমাদের জাতির পিতার জন্য। পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধুর গোপনে বিচারের কাজ করে তাকে হত্যার সকল প্রকার আয়োজন সম্পন্ন করেছিল পাকিস্তানের সামরিক জান্তা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। সেই কথা স্মরণ করে তিনি তার ভাষণে উল্লেখ করেছিলেন, ‘আমি আপনাদের কাছে দু-এক কথা বলতে চাই। আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে, আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে, আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে। আমি আজ বক্তৃতা করতে পারবো না। বাংলার ছেলেরা, বাংলার মায়েরা, বাংলার কৃষক, বাংলার শ্রমিক, বাংলার বুদ্ধিজীবী যেভাবে সংগ্রাম করেছে আমি কারাগারে বন্দি ছিলাম, ফাঁসি কাষ্ঠে যাবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম কিন্তু আমি জানতাম আমার বাঙালিকে দাবায় রাখতে পারবে না...’
আরও পড়ুন
আমাদের জাতির পিতা জানতেন তার আহ্বানে দেশের সাধারণ মানুষ তাদের সাধারণ অবস্থান থেকে মুক্তির সংগ্রাম করেছিল। তাদের সাহস, বীরত্ব আর আত্মদান থেকে তিনি আরও সাহসী হয়েছিলেন, আরও বেশি সাধারণ মানুষের কাছে যাওয়ার পন্থা খুঁজে পেয়েছিলেন। তাই বারবার জনগণের কথা বলেছেন, কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন, শ্রদ্ধায় নত হয়েছেন এবং এসব কারণেই তিনি আমজনতার কাছে এক এবং অদ্বিতীয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন।
...সেই ভাষণে শুনতে পেয়েছিলেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়ার কথা, ‘তবে যারা দালালি করছে, যারা আমার লোকদের ঘরে ঢুকে হত্যা করছে, তাদের বিচার হবে এবং শাস্তি হবে। তাদের বাংলার স্বাধীন সরকারের হাতে ছেড়ে দেন, একজনকেও ক্ষমা করা হবে না।
১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের পর বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানানোর জন্য অপেক্ষায় ছিল। বুক ভাঙা স্বজন হারানো আর্তনাদ নিয়ে যেমন শহীদ পরিবার, শহীদ জায়া, বীরাঙ্গনা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা বিশ্বাস নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন, বঙ্গবন্ধু ফিরে আসলে তাদের কথা সবচেয়ে আগে ভাববেন।
সত্যি তারা সেই ভাষণে শুনতে পেয়েছিলেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়ার কথা, ‘তবে যারা দালালি করছে, যারা আমার লোকদের ঘরে ঢুকে হত্যা করছে, তাদের বিচার হবে এবং শাস্তি হবে। তাদের বাংলার স্বাধীন সরকারের হাতে ছেড়ে দেন, একজনকেও ক্ষমা করা হবে না। তবে আমি চাই স্বাধীন দেশে স্বাধীন আদালতে বিচার হয়ে এদের শাস্তি হবে। আমি দেখিয়ে দিতে চাই দুনিয়ার কাছে শান্তিপূর্ণ বাঙালি রক্ত দিতে জানে শান্তিপূর্ণ বাঙালি শান্তি বজায় রাখতেও জানে।’
আরও পড়ুন
আবার ঠিক অন্যদিকে আনন্দে আত্মহারা সাধারণ মানুষ ঢাকা বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দানে জাতির নেতার জন্য স্বতঃস্ফূর্ত অপেক্ষায় ছিল। তিনি তাদের কাউকে আশাহত করেননি। সেই ভাষণের এক জায়গায় বলেছিলেন, ‘আজ থেকে আমার অনুরোধ, আজ থেকে আমার আদেশ, আজ থেকে আমার হুকুম ভাই হিসেবে, নেতা হিসেবে নয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়। আমি তোমাদের ভাই, তোমরা আমার ভাই। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এদেশের যুবক যারা আছে তারা চাকরি না পায়। মুক্তিবাহিনী, ছাত্র সমাজ তোমাদের মোবারকবাদ জানাই তোমরা গেরিলা হয়েছো, তোমরা রক্ত দিয়েছো, রক্ত বৃথা যাবে না, রক্ত বৃথা যায় না।’
বিকাল পাঁচটায় রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লাখ লোকের উপস্থিতিতে তিনি সেই যুগান্তকারী ভাষণ দিয়েছিলেন। যা বিশ্ববাসী ও বাঙালিরা প্রত্যক্ষ করেছিল।
বাংলাদেশ বেতার থেকে ধারাবিবরণী প্রচারিত হচ্ছিল। বিমানবন্দর ও রাস্তার দু’পাশে অপেক্ষমাণ জনতা। সবার মাঝে বিজয়ের উত্তেজনা। তিনি আসছেন, যিনি বাঙালি জাতিকে মুক্তির আলোয় আলোকিত হওয়ার পথ দেখিয়েছেন। সেদিন মুক্ত মানুষের স্রোতে স্বাধীন রাজপথ হয়েছিল উজ্জ্বল। তাদের শক্তিময় কণ্ঠে আকাশ বাতাস শুনেছিল সেই সর্বজয়ী স্লোগান, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’।
শাওন মাহমুদ ।। শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা