হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী : ইতিহাসের কৌতূহলোদ্দীপক এক চরিত্র
প্রথমেই একথা মেনে নেওয়া দরকার যে, ইতিহাস কোনো ‘তেজাবি পদার্থ’ নয়। একটা ঐতিহাসিক ঘটনা, সময় বা চরিত্র সম্পর্কে সবার ব্যাখ্যা একইরকম হবে এমন কথা নেই।
ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তার অবস্থান অনুযায়ী ইতিহাস নির্মাণ করে। সবাই যার যার উদ্দেশ্যের পক্ষে ইতিহাসের নানা উপাদান, উপকরণকে ব্যবহার করে থাকে। এই বাস্তবতায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বাংলার ইতিহাসে খুব কৌতূহলোদ্দীপক এক চরিত্র বটে।
একধারার ইতিহাস বলছে, সোহরাওয়ার্দী বাঙালি মুসলমানের ইতিহাসের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তিনি বাংলার ইতিহাসে ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’। কারণ, তিনি চিরকাল অন্যের মত-পথকে খুবই গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করতেন। শুধু তাই নয়, রাজনৈতিক শত্রুকেও স্পেস দিতেন। অনেক সময় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকেও তিনি পদ-পদবি দিতেন। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান, পৃষ্ঠা-৪১-৪২, সুলভ সংস্করণ, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা) এর মধ্য দিয়ে সামগ্রিকভাবে দেশ ও জাতির অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করার যে-উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তা তার মধ্যে চিরকাল ছিল। তিনি বাংলায় বুর্জোয়া রাজনীতির জনক বলেও কীর্তিত হন।
আরও পড়ুন : ‘বেখাপ্পা’ মওলানা ভাসানী
তিনি ধর্মনিরপেক্ষ-অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিরও অন্যতম পথদ্রষ্টা ছিলেন বলেও ইতিহাসে বর্ণিত হন। এই ধারার ইতিহাস নির্মাতাদের মধ্যে বোধ করি সবচেয়ে এগিয়ে থাকবেন তার রাজনৈতিক আদর্শপুষ্ট এবং স্নেহধন্য শেখ মুজিবুর রহমান।
তিনি তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে সোহরাওয়ার্দীকে এক আলাদা উচ্চতায় স্থান দিয়েছেন। সোহরাওয়ার্দীকে ইতিহাসে এক ভিন্ন উচ্চতায় নির্মাণকারীদের দলে আবুল মনসুর আহমদও পড়বেন।
আরেক ধারার ইতিহাস বলছে, সোহরাওয়ার্দী বাঙালি মুসলমানের ইতিহাসে বিচিত্র বিষয়ে খুব একটা জুতের লোক ছিলেন না। তার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, বুর্জোয়া চেতনা, অসাম্প্রদায়িকতা, অবিভক্ত বাংলা নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের বাইরে নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়াস আসলে রাজনৈতিক ভাওতা। ‘তিনি সবচেয়ে বড় মনে করতেন নিজের ক্ষমতাকে’। (বাঙালীর জাতীয়তাবাদ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, পৃষ্ঠা-২৮৩, পরিবর্ধিত তৃতীয় সংস্করণ, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা)
সোহরাওয়ার্দী বাঙালি মুসলমানের ইতিহাসের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তিনি বাংলার ইতিহাসে ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’। কারণ, তিনি চিরকাল অন্যের মত-পথকে খুবই গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করতেন।
তিনি উর্দুভাষী অবাঙালি এলিট ছিলেন। কেউ কেউ তাকে ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্টের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার হোতা হিসেবে নির্মাণ করে এর জের ধরে বলেছেন, সোহরাওয়ার্দী আসলে “কলকাতার ‘আন্ডারওয়ার্ল্ডের’ নেতা”। (দেশভাগ : ফিরে দেখা, আহমদ রফিক, পৃষ্ঠা-৩২১, অনিন্দ্য প্রকাশ, ঢাকা)
আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, কী একটা কাণ্ড! মনে হবে, এও কি সম্ভব! আমরা বলব, এ শুধু সম্ভব নয়, ‘এই-ই হইয়া থাকে’। ওই যে, মমতাজুর রহমান তরফদারের ভাষা চুরি করে গোড়াতেই বলেছি, ইতিহাস কোনো তেজাবি পদার্থ নয়। ইতিহাস কুমোরের হাতে কাদামাটিই বটে!
কিন্তু আমাদের কথা সেখানে নয়, অন্য জায়গায়। কথাটা হচ্ছে, এই যে একই ব্যক্তির ভিন্ন ভিন্ন নির্মাণের পেছনের গভীর তাৎপর্যটা কী। এটা কি বিজয়ী বনাম পরাজিতের মামলা! লক্ষ করলে দেখা যাবে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সাথে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত নেতৃস্থানীয় প্রায় সবাই বাংলাদেশের ইতিহাসে বাঁকাভাবেই চিত্রিত হয়েছেন।
আরও পড়ুন : আওয়ামী লীগ : বহুত্ববাদ ও জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল
শুধু পাকিস্তান আন্দোলনই নয়, মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তাদের অনেকের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। যেমন, খাজা সলিমুল্লাহ বা নবাব সলিমুল্লাহ। তবু তো সলিমুল্লাহ কিছুটা হলেও আগে ‘মরিয়া বাঁচিয়াছেন’।
খতিয়ে দেখা দরকার, এদের এই বিশেষভাবে নির্মাণের কারণটা কী। ওই বিজয়ী বনাম পরাজিত! হ্যাঁ, একটা কারণ হতে পারে, পাকিস্তান রাষ্ট্র আর টেকেনি। তাকে টেক্কা দিয়েই নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটা ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে সামনে রেখে। কিন্তু ইতিহাসের এই রাত-দিনের আর কি কোনো মাত্রা আছে! বোধ করি আছে।
সেই মাত্রাটা কি ঔপনিবেশিক চেতনার ব্যাপার-স্যাপার? স্মরণ করা দরকার, ইংরেজের লেখা বাঙালির ইতিহাসের কথা। এক্ষেত্রেও একই সূত্রের কিছু ক্রিয়াশীল থাকতে পারে! ইতিহাসের বাঁকবদল করা ওইসব চরিত্ররা পশ্চিম বাংলার ইতিহাস চর্চায় অধিকাংশ সময় যেভাবে বর্ণিত ও চিত্রিত হন বাংলাদেশের ইতিহাস চর্চার একটি ধারায়ও তাই দেখা যায়।
ভারত ভূ-ভাগের, বিশেষত জাতীয়তাবাদী ইতিহাস চর্চায়, হয়তো সেটাই সঙ্গত এবং জাতীয় ইতিহাসের জন্য প্রয়োজনীয়ও বটে। কিন্তু সেই ঢঙের চিত্রায়ণেরই একটা পরিবর্ধিত রূপই কি বাংলাদেশের ইতিহাস চর্চায় লক্ষ করা যায়। অথচ সোহরাওয়ার্দীসহ ইতিহাসের ওইসব চরিত্ররা তো পূর্ববাংলার বাঙালির আত্মপ্রতিষ্ঠা ও আত্মমর্যাদার জন্য লড়াই করেছিলেন।
অন্য অনেকের কথা না বোঝা গেল। তাদের অনেকের সাথে দেশভাগ পরবর্তী পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাংলাদেশের ইতিহাসের একটা বড় আর ত্যাগী মুখোমুখি কনফ্রন্টেশন বা মোকাবিলা আছে। কিন্তু বড় গোলমেলে ঠেকে সোহরাওয়ার্দীর ইতিহাস নিয়ে। দেশভাগ হওয়ার পর তার রাজনৈতিক জীবন তো মূলত বাংলাদেশকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে। তিনি তো পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামন্ত ও সাম্প্রদায়িক শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করতেন না।
তিনি উর্দুভাষী অবাঙালি এলিট ছিলেন। কেউ কেউ তাকে ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্টের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার হোতা হিসেবে নির্মাণ করে এর জের ধরে বলেছেন, সোহরাওয়ার্দী আসলে “কলকাতার ‘আন্ডারওয়ার্ল্ডের’ নেতা”।
মওলানা ভাসানী ছিলেন ১৯৪৯ সালে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম সভাপতি। আর সোহরাওয়ার্দী ছিলেন একই সময়ে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম সভাপতি। তিনি ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের অন্যতম নেতা।
১৯৫৮ থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত আইয়ুবি স্বৈরশাসনের দোর্দণ্ড প্রতাপের মধ্যে রাজনীতি যখন বন্ধ ছিল, তখন ১৯৬২ সালে সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বেই সব বিরোধী দলকে একত্র করে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল পূর্ব বাংলা। এমন সময় ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের ওই সময়ের অন্যতম নির্ভরযোগ্য নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে বিনা বিচারে জেলে আটক করা হয়। তার গ্রেফতারে রাজনৈতিক অঙ্গনে নেমে আসে চরম হতাশা।
আরও পড়ুন : তাজউদ্দীন আহমদ ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়
পূর্ব বাংলায় তাৎক্ষণিক তীব্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়। বিশেষত, ছাত্রদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দেখা দেয়। ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২ তারিখে ছাত্র ধর্মঘটও পালিত হয়। এপ্রিলের ১৪ তারিখে ৭ জন বিশিষ্ট রাজনীতিক সংবাদপত্রে বিবৃতি দেন। বিবৃতির মূল বিষয় ছিল, সোহরাওয়ার্দীসহ সকল রাজনৈতিক বন্দি ও ছাত্রনেতার মুক্তি। এর পরের বছর ১৯৬৩ সালে সোহরাওয়ার্দী মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার পরিচয় ছিল তিনি আওয়ামী লীগের নেতা; গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের অগ্রনায়ক।
পারিবারিক দিক থেকে সোহরাওয়ার্দী অত্যন্ত অভিজাত শ্রেণির ছিলেন। বিদ্যাশিক্ষায়ও তাই ছিলেন; পড়েছিলেন অক্সফোর্ডে। কিন্তু রাজনীতিতে তিনি ছিলেন প্রায় তার উল্টো। কলকাতায় এবং ঢাকায় ছিলেন মূলত অভিজাততন্ত্র বিরোধী রাজনীতিক অংশেরই মানুষ। তার রাজনৈতিক জীবনের প্রায় শুরুতে তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের।
চিত্তরঞ্জন মূলত ‘হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের জন্য তাকে কাছে টেনে নেন।’ (হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী : কাছে থেকে দেখা, মাহমুদ নূরুল হুদা, পৃষ্ঠা-৩২, চতুর্থ মুদ্রণ, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা) তিনি ১৯২৩ সালে গঠিত তার স্বরাজ পার্টির ডেপুটি লিডারও নির্বাচন করেন সোহরাওয়ার্দীকে।
আরও পড়ুন : বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড : বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থান
চিত্তরঞ্জন যখন কলকাতা করপোরেশনের মেয়র তখন সোহরাওয়ার্দী দেশবন্ধুর সহায়তায় হন ডেপুটি মেয়র। ১৯২৭ সালে তিনি ‘ন্যাশনাল লেবার ফেডারেশন’ গঠন করেন। খুব কম সময়ের মধ্যে তিনি পাটকল, কাপড়কল, জাহাজ শ্রমিকসহ বিভিন্ন সংস্থায় প্রায় ৩৬টি ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করেন।
দেশবন্ধুর পছন্দের সোহরাওয়ার্দীই তার মৃত্যুর একুশ বছর পরও মনে করেছিলেন হিন্দু-মুসলমানের যুগল বসতির দুই বাংলাকে ভাগ করা বাঙালির জন্য আত্মহত্যার শামিল। এজন্য তিনি দেশভাগের অব্যবহিত পূর্বেই আবুল হাশিম, শরৎ বসুসহ আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন দুই বাংলা মিলিয়ে ভারত-পাকিস্তানের বাইরে নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। কিন্তু ততক্ষণে ‘গঙ্গার জল অনেকদূর গড়িয়ে গিয়েছিল’।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সমালোচনার ঊর্ধ্বে ছিলেন না। তার রাজনৈতিক জীবন অভ্রান্ত ছিল না। তার প্রিয় রাজনৈতিক শিষ্য শেখ মুজিব প্রয়োজনীয় জায়গায় কিছু কম সমালোচনাও করেননি। এমনকি আবুল মনসুর আহমদও করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাস চর্চায় সোহরাওয়ার্দীর ঐতিহাসিক নির্মাণে যে রাত-দিন পার্থক্য লক্ষ করা যায় তা এক গভীর রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক গবেষণার বিষয়ই বটে।
ড. কুদরত-ই-হুদা ।। প্রাবন্ধিক, গবেষক ও শিক্ষক