নূর হোসেন : আমাদের হারিয়ে যাওয়া আত্মার প্রতিশব্দ
বাংলাদেশে গণতন্ত্র শব্দটিকে কোনো প্রতীকের মাধ্যমে প্রকাশ করতে বলা হলে, আমি নিশ্চিত বেশিরভাগ মানুষ উদল গায়ে ২৫/২৬ বছরের এক যুবকের কথা বলবে। যার বুকে এবং পিঠে সাদা রঙে লেখা—‘স্বৈরাচার নিপাত যাক; গণতন্ত্র মুক্তি পাক।’
যুবকের নাম নূর হোসেন। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর আলোকচিত্রী পাভেল রহমানের ক্যামেরায় এভাবেই সে ধরা দিয়েছিল। এর কিছুক্ষণ পরেই পুলিশের গুলিতে সে নিহত হয়। পরের দিন ইত্তেফাকের পাতায় এই ছবিটি ছাপা হলে নূর হোসেন সারা বাংলার অবরুদ্ধ আত্মার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।
কিন্তু আমি নূর হোসেনকে একটু অন্যভাবে দেখতে চাই। নূর হোসেন স্বাধীনতাত্তোর প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি ছিল। যে প্রজন্ম যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বেড়ে উঠেছিল। গান পয়েন্টের সামনে দাঁড়িয়ে নতুন একটা দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখত। ছিল সেনা শাসন। বেকারত্ব। বৈদেশিক ঋণ। অনিশ্চয়তা। আইএমএফ ওয়ার্ল্ড ব্যাংক। এতকিছুর পরও সে প্রজন্মের মধ্যে প্রতিরোধের সংস্কৃতি জারি ছিল। ছিল ‘রাষ্ট্র মানেই লেফট রাইট’কে চ্যালেঞ্জ করার দুঃসাহস। আশির দশকের শুরুতেই জন্ম হওয়ায় সেই প্রজন্মকে আমি কিছুটা দেখেছি।
আমার স্পষ্ট মনে আছে, ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় তরুণ-তরুণীরা কীভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আমরা তখন চট্টগ্রামের শহরতলীর একটা পাড়ায় থাকি। বন্যা আমাদের থেকে অনেক দূরে। কিন্তু যুবকদের তৎপরতা ছিল দেখার মতো। বাসায় বাসায় গিয়ে খাবার ও অর্থ সংগ্রহ, পাড়ার মেয়েদের এক হয়ে রুটি বানানোর বিরাট আয়োজন, যুবকরা কাপড়, খাদ্য ও অর্থ নিয়ে চলে যায় বন্যা উপদ্রুত অঞ্চলে। এখনো তরুণদের মধ্যে স্বেচ্ছাশ্রমের প্রতি আগ্রহ রয়েছে। কিন্তু সেসময় ছিল তা সর্বাত্মক। তারুণ্যের সংস্কৃতির অংশ।
আবার এই তরুণরা কিছুদিন আগে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ সময়’-এর সত্যিকারের প্রতিরূপ ছিল সে প্রজন্ম। অবশ্য এর কিছু ঝক্কিও ছিল। প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে ছিল অস্থিরতা। যেকোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের ছাত্ররা তাদের অবস্থান থেকে সহজে সরে আসতে চাইত না।
নূর হোসেন স্বাধীনতাত্তোর প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি ছিল। যে প্রজন্ম যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বেড়ে উঠেছিল। গান পয়েন্টের সামনে দাঁড়িয়ে নতুন একটা দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখত।
তখন কালো টাকার হাতছানি এত প্রবল হয়নি। আদর্শের প্রতি আনুগত্য ছিল চোখে পড়ার মতো। কেউ স্বপ্ন দেখত একটা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের। কেউ মুক্তিযুদ্ধে খোয়া যাওয়া স্বপ্নটাকে আবার পুনর্জীবিত করার। কেউ ভাবত শোষণ মুক্ত সমাজের কথা। এরা যে খু্ব একটা শিক্ষিত ছিল তা নয়। তখনো উচ্চশিক্ষা ছিল ফানেলের মুখের মতো চাপা।
অথচ এই তরুণদের মধ্যে এক উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। ১৯৯০ সালে এরশাদের সময় বাবরি মসজিদ ভাঙা হতে পারে এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে শক্ত হাতে দাঙ্গা প্রতিরোধ করেছিল। তিন মাস পর এরশাদ সরকারকে তারা টেনে নামায় ক্ষমতা থেকে। অসাম্প্রদায়িক এ খ্যাপাটে তরুণদের দল হয়ে উঠছিল মুক্তিযুদ্ধের পর আরেক মুক্তিযুদ্ধের অগ্র সৈনিক। এরাই পরবর্তীতে একাত্তরের ঘাতকদের বিচারে সোচ্চার হয়ে ওঠে দেশব্যাপী।
নব্বইয়ে গণতান্ত্রিক চর্চা শুরু হওয়ার পর এই তরুণদের বিক্ষিপ্ত করে দেওয়ার একটা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা আমরা দেখতে পাই। প্রথমত, ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে বিভিন্ন অর্থকরী কর্মকাণ্ড যুক্ত হয়ে পড়ে। স্বতঃসিদ্ধ বিষয়গুলোতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় বিভ্রান্তি। আদর্শের প্রতি আনুগত্যের যে ধারা ছিল, তা দুর্বল হতে থাকে। এ-তো গেল রাজনীতি সচেতন তরুণদের কথা। যারা নেহাত সাধারণ, তারা উচ্চশিক্ষা নামের কুহেলিকার পেছনে ছুটতে লাগল।
১৯৯৩ সালে জাতীয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। হঠাৎ করে উচ্চশিক্ষার বিশাল ক্ষেত্র অবারিত হয়ে পড়ে। অল্প খরচে সাধারণ পরিবারের তরুণ তরুণীরা নিকটস্থ কলেজে পেয়ে যেতে লাগল ডিগ্রি, মাস্টার্সের সার্টিফিকেট।
২০২০ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ জানিয়েছিলেন, এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে ২৭ বছরে প্রায় ৫০ লাখ শিক্ষার্থী গ্রাজুয়েট ডিগ্রি লাভ করেছেন। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক জরিপের তথ্য থেকে জানা যায়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশ চাকরি পাচ্ছেন না। উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েও তারা বেকার। ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি পাচ্ছেন। ৭ শতাংশ এখনো অন্য কোনো বিষয়ে স্নাতকোত্তর বা কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করছেন কিংবা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। ৩ শতাংশ নিজ উদ্যোগে কিছু করছেন।
যে চেষ্টায় রাষ্ট্র পুরোপুরি সফল হতে পারেনি, তাতে সফল হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি। সংস্কৃতি চর্চা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। নেই কোনো আদর্শিক রাজনীতির চর্চা। ফলে রুচিশীল প্রতিবাদ করতেও তারা শিখছে না।
অর্থাৎ উচ্চশিক্ষার নামে বেকার তৈরির একটা বিশাল প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি আর্থিকভাবে বেশ লাভজনক হয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে সঞ্চিত উদ্বৃত্ত অর্থ আড়াই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এই প্রকল্পই আজকের নূর হোসেনদের রাস্তা থেকে তুলে নিয়েছে ক্যারিয়ারের প্রলোভন দেখিয়ে। এত কম বিনিয়োগে যে মানসম্মত শিক্ষা সম্ভব নয়, তা তারাও জানেন। জেনে শুনে এক মরীচিকার পেছনে ছুটছে তারা।
যে চেষ্টায় রাষ্ট্র পুরোপুরি সফল হতে পারেনি, তাতে সফল হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি। বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম চলে আসায় ভার্চুয়াল জগৎকে তরুণরা তাদের কমফোর্ট জোন করে নিয়েছে। সেখানকার লাইক কমেন্ট আর শেয়ারেই আটকে গেছে তাদের প্রতিবাদ। সংস্কৃতি চর্চা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। নেই কোনো আদর্শিক রাজনীতির চর্চা। ফলে রুচিশীল প্রতিবাদ করতেও তারা শিখছে না।
বিভিন্ন ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোকেই তারা প্রতিবাদের ধারা মনে করছে। নেই যুক্তি ও বিজ্ঞানের চর্চা। তাই কোনো রকম প্রতিরোধ ছাড়াই সিন্ডিকেট করে দ্রব্যমূল্যে বৃদ্ধি করা যাচ্ছে। গণপরিবহন চলে গেছে কিছু পরিবহন দস্যুর হাতে। গড় আয় বৃদ্ধির সমান্তরালে বাড়ছে আয় বৈষম্য। আবার মুদ্রার উল্টো পিঠে গুজব ছড়িয়ে নিরীহ জনগণের উপর লেলিয়ে দেওয়া যাচ্ছে তরুণদের। কোনো জুতসই প্রতিপক্ষ না পেলে নারীকেই বানানো হচ্ছে লক্ষ্যবস্তু।
১৯৮৭-র নূর হোসেনরা ছিল অর্ধশিক্ষিত। সারা পৃথিবী থেকে একপ্রকার ছিল বিচ্ছিন্ন। কিন্তু দেশের সংকটে তারা একেকজন মানব বোমা হয়ে নেমেছিল পথে। আজকের নূর হোসেনরা পাচ্ছে অনায়াসলব্ধ উচ্চশিক্ষা। তাদের হাতের মুঠোয় বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। তারা কথাবার্তায় চৌকস। অসীম তাদের সম্ভাবনা। কিন্তু বাসার সামনের রাস্তায় দাঁড়ানোর মতো সৎসাহস তাদের নেই। সাহসের উৎস আদর্শ। সেই আদর্শের চর্চাই উঠে গেছে সমাজ থেকে।
জয়দীপ দে ।। কথাসাহিত্যিক