সম্প্রীতির সমাবেশ ও মানুষের প্রত্যাশা
অষ্টমীর দিন সকালে উৎসবের আনন্দে যে কালিমার ভাটা পড়ল, সেই কালিমার অন্ধকারে গোটা বাংলাদেশ। কুমিল্লা ছাড়িয়ে কালিমার সেই কলঙ্ক ছড়িয়েছে গোটা দেশে। রংপুরের জেলে পল্লীতে যখন আগুন জ্বলেছে কিংবা নোয়াখালীর মাটি যখন লাল হয়েছে পূজারির রক্তে, কালিমার সেই কালোর ছিটে এসে পড়েছে আমার গায়েও, পড়েছে আমাদের গায়ে।
কিছু একটা করতেই হবে এই তাগিদ থেকে আর কিছু করতে না পারার প্রচণ্ড হতাশায় ডুবে ভাসার চেষ্টা সম্প্রীতি বাংলাদেশের আহ্বায়ক পীযূষদা আর আমার। দাদার সাথে এমনি আড্ডা আমার চলে নিত্যই। এসব আড্ডায় রাজার সাথে উজিরও মারি আমরা অনেক। তারপর যার যার ঘর মুখো হই।
টিপিক্যাল বাঙালি মধ্যবিত্তের দেশ আর সমাজের জন্য কিছু একটা করার যে তাগিদ থাকে সেই তাগিদকে একটু চর্চায় রাখার এটা এক ধরনের চেষ্টা বলতে পারেন। তবে এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। এবারতো কিছু একটা করতেই হবে, করে দেখাতেই হবে।
প্রস্তাব আসলো পীযূষদার মাথা থেকে। একটা সম্প্রীতি সমাবেশ করতে হবে। সম্প্রীতি বাংলাদেশের উদ্যোগে হবে সমাবেশ আর সমাবেশের স্থান হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। কারণ বাংলা আর বাঙালিয়ানার চর্চার প্রতীক এটিই। পীযূষদার প্রস্তাবে রাজি হতে আমার কয়েক সেকেন্ড সময়ও লাগেনি। অবশ্য আমাদের দুজনের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া এমনই। আমি সাথে বাড়তি একটা প্রস্তাব জুড়ে দিলাম। সাথে সমমনা এবং একই চেতনা আর আদর্শকে ধারণ করে এমনই কিছু প্রগতিশীল সংগঠনকে সাথে নিয়ে নিলে কেমন হয়? যেমন কথা তেমনি কাজ। অনেকটা ‘ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে’ টাইপ।
সাত দিনেরও কম সময়ের প্রস্তুতিতে ২৫ অক্টোবর দুপুর আড়াইটায় আমরা সবাই সমবেত হই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। মনে যে দুরু দুরু শঙ্কা কিছুটা নেই তাও বলা যাচ্ছে না। একে তো সময় ছিল হাতে খুবই কম, তার উপর ঠিক আগের দিন আমাকে আয়োজন করতে হয়েছে দক্ষিণ এশীয় লিভার অ্যাসোসিয়েশনের অষ্টম বার্ষিক সম্মেলন।
আমি মানুষের মধ্যে প্রচণ্ড আবেগ আর বাংলাদেশকে আবারও ‘মিনি পাকিস্তান’ বানানোর ষড়যন্ত্র ঠেকিয়ে দেওয়ার অসম্ভব তাগিদ দেখেছি।
ভার্চুয়াল হলেও সারাদিন ধরে পঞ্চাশ জনেরও বেশি লিভার বিশেষজ্ঞকে পৃথিবীর নানা দেশ থেকে সংযুক্ত করে ভার্চুয়ালি একের পর এক সায়েন্টিফিক সেশন চালিয়ে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। তারপরও একটা শক্তি পাচ্ছিলাম মনের ভেতরে।
সম্প্রীতি সমাবেশ নিয়ে যখন যার সাথে, যে সংগঠনের সাথেই গত ক’দিনে কথা বলেছি, তাদের প্রত্যেকের মধ্যেই অদ্ভুত ধরনের স্বতঃস্ফূর্ততা দেখেছি। কাজেই আশা ছিল অনুষ্ঠানটি আর যাই হোক বসে পড়বে না। কিন্তু তাই বলে অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করবে পাঁচটিরও বেশি টিভি চ্যানেল আর সত্তরটিরও বেশি অনলাইন পোর্টাল, এমনটা স্বপ্নেও ভাবিনি।
কাজেই এটি যে সরাসরি সম্প্রচার হবে ভারতেও কিংবা অনুষ্ঠানটির প্রতিবেদন প্রচার করবে দেশের সবকটি জাতীয় দৈনিক আর মূলধারার সব অনলাইন পোর্টালের পাশাপাশি এমনকি মাইক্রোসফট নিউজ আর ইন্ডিয়া-ইউকের একাধিক সংবাদমাধ্যম, তেমনটা ভাবার প্রশ্নই আসে না।
আমার ধারণা ছিল, লোক হবে বড় জোর শ’পাঁচেক, কিংবা খুব বেশি হলে হাজার। অথচ সেই লোক সংখ্যা ছাড়িয়ে গেল পাঁচ থেকে ছ’হাজার। মিছিলে মিছিলে প্রকম্পিত হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
শুরুতে আমাদের লক্ষ্য ছিল, কমপক্ষে পঞ্চাশটি সমমনা সংগঠনকে সাথে নিতে হবে। শহীদ মিনারে যখন গিয়ে দাঁড়িয়েছি তখন আমাদের পাশে সংগঠনের সংখ্যা বাহাত্তর আর সাঁঝের বেলায় মোবাইলের টর্চের আলোয় পীযূষদা যখন সমাবেশের ঘোষণা পত্রটি পাঠ করে শোনাচ্ছেন, তখন আমাদের সাথে সংহতি প্রকাশ করে উপস্থিত সংগঠনের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৯৩তে।
আমার কাছে বারবার মনে হয়েছে আমরা ঠিক পথেই আছি। ওরা যতই বাড়ুক আর ভাঙুক না কেন জিততে পারবে না কখনই।
অনুষ্ঠানটির পরিচালনার সুযোগ পাওয়াকে আমি আমার জীবনের একটি বড় অর্জন বলে মনে করি। পাশাপাশি এই দায়িত্বটি পালন করতে গিয়ে আমি আরেকটি বড় সুযোগ পেয়েছি, তা হলো একদিকে যেমন সমাবেশের সাথে একাত্মতা ঘোষণাকারী সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দের সাথে সরাসরি কথা বলার সুযোগ পেয়েছি, তেমনি মঞ্চ থেকে সমাবেশে যোগ দিতে আসা মিছিলের মুখগুলোকেও খুঁটিয়ে দেখার সুযোগও আমার হয়েছে।
আমি মানুষের মধ্যে প্রচণ্ড আবেগ আর বাংলাদেশকে আবারও ‘মিনি পাকিস্তান’ বানানোর ষড়যন্ত্র ঠেকিয়ে দেওয়ার অসম্ভব তাগিদ দেখেছি। আমার কাছে বারবার মনে হয়েছে আমরা ঠিক পথেই আছি। ওরা যতই বাড়ুক আর ভাঙুক না কেন জিততে পারবে না কখনই। বাঙালি, বাঙালিয়ানায় সব শয়তানের শেষ ঠিকানা হবে আস্তাকুঁড়ে আর ভাগাড়ে।
এখন প্রত্যাশা শুধু একটাই। এবার অন্তত বিচার হোক কুলাঙ্গারগুলোর, আইনের আওতায় আসুক সবাই। শেকড় ধরে টান দিতে গিয়ে শেকড়ের গোড়া যদি পৌঁছায় গুলশানের কোনো অভিজাত বাসভবনে কিংবা ঐ গুলশানেই অবস্থিত কোনো হাই কমিশনে, তবে তাই হোক। কিন্তু শেকড় উপড়ে না ফেলা পর্যন্ত আমরা যেন এবার আর না থামি।
আমরা ভবিষ্যতে সম্প্রীতি মোর্চা গড়ব, আয়োজন করব এমনই আরও অসংখ্য সম্প্রীতি সমাবেশের, কিন্তু মানুষের চোখের ভাষায় আর মুখের কথায় আমি খুব ভালো করে বুঝেছি, মানুষ মন্দির ভাঙা আর প্যাগোডা পোড়ানোর প্রতিবাদে কিংবা পূজারি হত্যা আর জেলে পল্লীতে আগুন দেওয়ার নিন্দা জানাতে এদেশে আর কোনো সম্প্রীতি সমাবেশে যোগ দিতে চায় না। আর এইটুকু প্রত্যাশা পূরণে নেত্রীর হাত দুটোকে শক্তিশালী করায় মানুষ তার সবটুকুই উজাড় করে দিতে প্রস্তুত আছে।
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব ।। চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়