কৃষক চৈতন্যের শেরে বাংলা
পূর্ব বাংলার বাঙালিদের মধ্যে যেসব মানুষ পরিপূর্ণভাবে তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতাকে ছাপিয়ে উঠতে পেরেছিলেন শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক তাদের অন্যতম। শিক্ষাগত যোগ্যতাকে ছাপিয়ে যাওয়া বলতে বোঝাতে চাইছি এই যে, তার নাম উচ্চারণের সাথে সাথে মনে হয় তিনি বুঝি তেমন শিক্ষিত কেউ নন। অথবা মনে হয় তিনি বেশিদূর পড়াশোনা করেননি। যেমনটি জসীমউদ্দীনের ক্ষেত্রে ঘটে।
বাল্যকালে জসীমউদ্দীনের কবিতা পড়ে এই ধারণা হয়েছিল যে, তিনি বুঝি অশিক্ষিত বা স্বল্প শিক্ষিত একজন মানুষ। হয়তো কবিতা লেখার একটা সহজাত প্রতিভা নিয়ে তিনি জন্মেছিলেন। কিন্তু পরে আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম, তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামজাদা ছাত্র ছিলেন। ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষকও। শেরে বাংলার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।
ছাত্রজীবনে এত প্রখর মেধার অধিকারী ছিলেন যে, যে-পাতা একবার চোখ বুলাতেন সে-পাতা ছিঁড়ে ফেলতেন—এই মিথ চালু থাকা সত্ত্বেও সাধারণের দৃঢ় বিশ্বাস যে, তিনি খুব বেশি শিক্ষিত ছিলেন না। অথচ বিভাগীয় বৃত্তি নিয়ে প্রথম শ্রেণিতে এন্ট্রান্স পাস করেন। সেটি ১৮৮৯ সালের কথা। এফ এ পাসও করেন বৃত্তিসহ প্রথম বিভাগে।
আরও পড়ুন : অস্ত্র ও ছলনার বিরুদ্ধে মানুষে আস্থা রবীন্দ্রনাথের
স্নাতকে গণিতশাস্ত্র, পদার্থবিদ্যা ও রসায়নশাস্ত্র এই তিনটি বিষয় নিয়ে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে। এমএ-তে প্রথমে ভর্তি হন ইংরেজিতে। মুসলমানের ছেলে অঙ্ক ভয় পায়- এমন মন্তব্য শুনে জেদ করে পরীক্ষার ছয় মাস আগে বিষয় পরিবর্তন করে নেন গণিত। সেখানেও অবাক করা ফল করেন। ১৮৯৭ সালে তিনি সিটি ল’ কলেজ থেকে ডিস্টিংশন নিয়ে আইন পাস করেন। প্রখর মেধার কারণে ছাত্রজীবনে গভীর স্নেহ লাভ করেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের। তার আইন পেশার হাতেখড়ি হয় স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের শিক্ষানবিশ হিসেবে।
তাহলে প্রশ্নটা খুবই মৌলিক যে, ফজলুল হকের নাম উচ্চারণে শিক্ষা তো গৌণ হয়ই বরং উল্টো ধারণা জন্মে কেন? প্রশ্নটা মৌলিক এই কারণে যে, এই প্রশ্নের মধ্যেই লুকিয়ে আছে বাংলার রাজনীতিতে ফজলুল হকের বিশেষত্বের প্রাণভোমরা। এই প্রশ্নের মধ্যেই লুকিয়ে আছে বাংলার রাজনীতিতে তার অবদান।
ছাত্রজীবনে এত প্রখর মেধার অধিকারী ছিলেন যে, যে-পাতা একবার চোখ বুলাতেন সে-পাতা ছিঁড়ে ফেলতেন—এই মিথ চালু থাকা সত্ত্বেও সাধারণের দৃঢ় বিশ্বাস যে, তিনি খুব বেশি শিক্ষিত ছিলেন না।
শেরে বাংলার সামগ্রিক জীবনের দিকে তাকালে দেখা যায়, তিনি বরিশালের মোটামুটি একটা সচ্ছল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের কৃষক, জেলে, তাঁতি, জোলা আর জল-জঙ্গলের পূর্ব বাংলায় তিনি সচ্ছল পরিবারের সন্তানই ছিলেন বটে। ওই আমলে তার দাদা ছিলেন মোক্তার আর বাবা ছিলেন বরিশালের নাম করা উকিল। অনুমান করি, পড়াশোনার জন্য তাকে পাটের বাজারের দামের উপর নির্ভর করতে হয়নি। যেকারণে তিনি খুব সহজেই বিয়ে করতে পেরেছিলেন নবাব আবদুল লতিফের নাতনি ও নবাব সৈয়দ মোহাম্মদ আলীর মেয়ে খুরশিদ তালাৎ বেগমকে। তারা মূলত উর্দু ও ফারসি ওরিয়েন্টেড পরিবার। ‘আশরাফ মুসলমান’ বলতে ওই আমলে যা বোঝাতো তারা তাই ছিলেন। প্রথম জীবনে ফজলুল হকের চলাফেরাও ছিল নবাব-নাইটদের সাথেই। নবাব সলিমুল্লাহর অন্তঃপুর পর্যন্ত তার ছিল অবাধ যাতায়াত। এইসব অভিজাত সংস্পর্শ হয়তো তাকে ১৯০৬ সালে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগদান করার ক্ষেত্রে একটা বড় সমর্থন জুগিয়ে থাকবে। কিন্তু শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক এসবের কোনোকিছুর মধ্যেই আটকে থাকেননি। তার রাজনৈতিক জীবনের গতিবিধি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে তিনি যেন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছেন পূর্ব বাংলার গরিব তথা ‘ছোটলোক’ মানুষের দিকে। তিনি যত ছুটেছেন ততই খসে পড়েছে একটি একটি করে আভিজাত্যের পালক।
একই সময়ে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সভাপতি ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক পদে থাকা ফজলুল হক ক্রমে শ্রেণিহীন কৃষকের গন্তব্যে পৌঁছে গিয়েছেন। একলা চলো নীতি অবলম্বন করে তিনি ১৯২৯ সালের দিকে গঠন করেন কৃষক প্রজা পার্টি। এই পার্টি আসলে পূর্ব বাংলার মানুষের সংগ্রামকে বুঝতে পেরেছিল। ফলে ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে কৃষক প্রজা পার্টির সমর্থনে জেগে উঠল সারা পূর্ব বাংলা।
আরও পড়ুন : রূপসী বাংলার ক্ষত ও জীবনানন্দ দাশ
ঢাকা, বরিশাল, ময়মনসিংহ, যশোর, পাবনা, খুলনা, ফরিদপুর, বরিশাল, রংপুর, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম সব জেলাতেই কৃষক প্রজা পার্টির সমর্থনে জেগে উঠল মানুষ। যুক্ত হলেন কৃষক পরিবার থেকে উঠে আসা অসংখ্য নেতাকর্মী।
পটুয়াখালীতে নির্বাচনী লড়াই হলো খাজা নাজিমুদ্দীন ও ফজলুল হকের মধ্যে। কিন্তু নাজিমুদ্দীনের টাকা, ক্ষমতা আর আভিজাত্য সেদিন কোনো কাজে আসেনি। সাত হাজারেরও বেশি ভোটে জেতেন ফজলুল হক। বাংলার সাধারণ মানুষের কণ্ঠে ভোটের সময় ধ্বনিত হয়েছিল নজরুলের গান—‘ওঠ্রে চাষী জগৎবাসী, ধর কষে লাঙল’।
ফজলুল হক মন্ত্রিপরিষদ গঠন করলেন। হলেন প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রী হয়েই তিনি প্রস্তাব করলেন, ঋণ-সালিশি বোর্ড আর মহাজনি আইন। পাস হলো অনেক কষ্টে। এতে খাইখালাসি, জায়সুদী, পাট্টা, কবলা এরকম শত রকমের বন্ধকি থেকে জমি আবার ফেরত গেল কৃষকের হাতে। যে জমি কোনোদিন ফিরে পাওয়ার কথা না তা ফিরে পেল মুহূর্তে।
শুধু কৃষি নয়, শিক্ষায়ও তিনি ছিলেন তৎপর। প্রধানমন্ত্রী হয়েও তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয় রাখলেন নিজের হাতে। কারণ তিনি জানতেন পূর্ব বাংলায় দুটি জিনিস খুব জরুরি; কৃষি আর শিক্ষা। একারণে ঋণ সালিশি বোর্ড আর মহাজনি আইন পাশ করেই শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে তিনি ‘মাওলা বক্স কমিটি’ নিযুক্ত করেন। কমিটির রিপোর্ট অনুসারে অধিবেশনে পাস করেন, ‘অবৈতনিক প্রাইমারি-শিক্ষা আইন’। এছাড়া পূর্ব বাংলার বিচিত্র জায়গায় স্থাপন করেন বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
শুধু কৃষি নয়, শিক্ষায়ও তিনি ছিলেন তৎপর। প্রধানমন্ত্রী হয়েও তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয় রাখলেন নিজের হাতে। কারণ তিনি জানতেন পূর্ব বাংলায় দুটি জিনিস খুব জরুরি; কৃষি আর শিক্ষা।
এই কৃষি আর শিক্ষাই তো ওই সময়ের পূর্ব বাংলার মানুষের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় দুটি বিষয়। এই দিয়েই তিনি গরিব মানুষদের মন জয় করেছিলেন। এই গরিব নিয়ে কারবারই হয়তো সাধারণের কাছে তার এত বড় বড় ডিগ্রি, কৃতিত্বকে আড়ালে রেখে দেয়। জন চৈতন্যে ‘কম শিক্ষিতের’ এই বরমাল্য খুব কম মানুষের ভাগ্যেই জোটে। অথবা খুব কম মানুষই ‘এত নিচে নেমে’ কাজ করতে পারেন; নিজেই দান হয়ে নেমে আসতে পারেন গ্রহীতার ভিড়ের মধ্যে। আবুল কাশেম ফজলুল হক আর শেখ মুজিবুর রহমান এই কাজটি করতে পেরেছিলেন বাংলার রাজনীতিতে আর কবিতায় পেরেছিলেন জসীমউদ্দীন।
বাংলার রাজনীতিতে ফজলুল হকের পরবর্তী বা তারও পরবর্তী প্রজন্মের সন্তানেরা যে প্রবেশ করতে পেরেছিল তার পথটি তৈরি করেছিলেন ফজলুল হক। ক্রমে বাংলার রাজনীতিতে আবুল হাশিমের প্রযোজনায় এই ধারাটিই প্রধান হয়ে উঠেছিল এবং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
আরও পড়ুন : রবীন্দ্র ভাবনায় তারুণ্য
বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা তো আসলে সামন্ত বড়লোক অভিজাত আর টাকাওয়ালা শ্রেণির বিপরীতে কৃষক চৈতন্যেরই প্রতিষ্ঠা। ফজলুল হক এই কৃষক চৈতন্যের উদ্গাতা। একারণেই সম্ভবত পূর্ব বাংলার মানুষ ফজলুল হককে তাদের অংশী মনে করতেন। শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে এর এক দারুণ প্রমাণ লক্ষ্য করা যায়। তিনি বলছেন, "একদিনের কথা মনে আছে, আব্বা ও আমি রাত দুইটা পর্যন্ত রাজনীতির আলোচনা করি। আব্বা আমার আলোচনা শুনে খুশি হলেন। শুধু বললেন, এ. কে. ফজলুল হক সাহেবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যক্তিগত আক্রমণ না করতে। একদিন আমার মাও আমাকে বলেছিলেন, বাবা যাহাই কর, হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছুই বলিও না।’ শেরে বাংলা মিছামিছিই ‘শেরে বাংলা’ হন নাই। বাংলার মাটিও তাকে ভালবেসে ফেলেছিল। যখনই হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেছি, তখনই বাধা পেয়েছি।"
পূর্ব বাংলার মানুষের হৃদয়ের এত কাছের মানুষ বলেই হয়তো ফজলুল হকের একাশি বছর বয়সেও ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম বড় নির্বাচনে তাকে কেন্দ্রে রেখেই সবাই আবর্তিত হয়েছিল! বাংলার রাজনীতিবিদদের সেই ধারণা একেবারে মিছে ছিল না। নির্বাচনের ফলাফলই সেই ইতিহাসের স্মারক হয়ে আছে।
বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে এ. কে. ফজলুল হকের সমালোচনাও কম নেই। বিশেষত তার শেষ জীবনে তিনি যে তার পূর্ব জীবনের নিজের গড়া ইতিহাসের প্রতি খুব সুবিচার করতে পেরেছিলেন তা মনে হয় না। কিন্তু মনে রাখা দরকার, এই ফজলুল হক অশীতিপর বৃদ্ধ ফজলুল হক। তাছাড়া তার নিজের চরিত্র-ব্যক্তিত্বের মধ্যে সম্ভবত ব্যক্তিগতভাবে সবাইকে সবকিছুকে ছাড়িয়ে যাওয়ার একক নায়কোচিত বৈশিষ্ট্য ছিল। কিন্তু এসব সত্ত্বেও ফজলুল হক বেঁচে থাকবেন বাংলার- বিশেষত পূর্ব বাংলার- মানুষের খুব কাছের দরদি মানুষ হিসেবে। তিনি বেঁচে থাকবেন একটি বিশেষ ঐতিহাসিক অসময়ে বাংলাদেশের মানুষের মর্মের অনুবাদক হিসেবে।
ড. কুদরত-ই-হুদা ।। প্রাবন্ধিক, গবেষক ও শিক্ষক
[email protected]