সম্প্রীতির তাল যেন না কাটে
হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। আর এই পূজাকে ঘিরে শারদীয় দুর্গোৎসবে আনন্দের বান ডাকে সারাদেশে। পূজার ধর্মীয় অংশটুকু বাদ দিলে শারদীয় দুর্গোৎসব পরিণত হয় সর্বজনীন এক আনন্দ আয়োজনে। করোনার কারণে কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হলেও এবার শারদীয় উৎসবের শুরুটা হয়েছিল আনন্দ মুখর পরিবেশেই। কিন্তু পাঁচ দিনের এই আনন্দ আয়োজনের তাল কেটে যায় তৃতীয় দিনেই।
কুমিল্লায় পবিত্র আল কোরআন অবমাননার ঘটনায় দেশের বিভিন্ন স্থানে মন্দিরে হামলা, প্রতিমা ভাংচুর, হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের বাড়িঘরে হামলা, নির্যাতন সব মিলে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। অনেক জায়গায় পূজা শেষ করা যায়নি, অনেক জায়গায় প্রতিমা বিসর্জনও হয়নি। কয়েক জায়গায় উগ্রবাদীরা জোরপূর্বক প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে দিয়েছে। কুমিল্লার ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় এবার উৎসবের রঙ নিভে যায়।
শারদীয় দুর্গোৎসবের পাঁচ দিনে নানা আয়োজন থাকে। বিসর্জনের সকালে থাকে সিঁদুর খেলা। এবার অনেক মণ্ডপেই সিঁদুর খেলা হয়নি। সিঁদুর খেলায় অংশ নিতে না পারায় এক হিন্দু নারী কান্না ভেজা কণ্ঠে তার ক্ষোভের কথা বলছিলেন, ‘আমার প্রথম পরিচয় হিন্দু না, বাংলাদেশের নাগরিক। এই দেশে শুধুমাত্র ধর্ম পরিচয়ের জন্য বছরের একটা উৎসবে আমরা একটু সিঁদুর খেলি, সেটা হলো না। এটা এই রাষ্ট্রের ব্যর্থতা, এটা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অবমাননা। আমার প্রথম পরিচয় আমি হিন্দু না, আমি নাগরিক। আমার নিরাপত্তার দায়িত্ব এই রাষ্ট্রের। সারা বছরের একটা পূজা বলে শুধু নয়, এই যে সারা বছর সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ঘুরে বেরায়, কোনো প্রতিবাদ হয় না। শুধুমাত্র আমরা দায়সারা কথা বলি, এটা আমার ধর্মে বলে না। প্রতিবাদ কে করে বলেন তো? কে বলে যে, না আমার এই প্রতিবেশীরও এটা অধিকার। আমাকে যখন মালাউন গালি দেওয়া হয়, তখন কে প্রতিবাদ করে? কে বলে যে, না ওকে এই গালিটা দিও না। আমাকে ইন্ডিয়ার দালাল বলা হয়, আমার দেশপ্রেমকে প্রশ্ন করা হয়, শুধুমাত্র আমার ধর্মীয় বিশ্বাসের জন্য। এই দেশ আমার, আমার চৌদ্দপুরুষ এই দেশে রয়েছে। ৪৭-এ যাইনি, ৬৬-তে যাইনি, ৭১-এ যাইনি, ২০০১-এ যাইনি। এই দিন দেখার জন্য! ভালো থাকেন সবাই।’
একজন মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ হিসেবে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের কান্না, বেদনা, ক্ষোভ, ক্রোধ, অসহায়ত্ব আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে...
তার এই ক্ষোভ, সেই কান্না ছুঁয়ে গেছে অনেককেই। শিক্ষক ও নাট্যকর্মী রুমা মোদক ফেসবুকে লিখেছেন, ‘সতীর্থ সুহৃদ বন্ধুরা, ক্ষমা চাইবেন না, লজ্জাও পাবেন না। ঘটনার সাথে আপনি জড়িত নন। এর দায় আপনার নয়। জানি আপনি সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ বলেই দায় স্বীকার করছেন, ক্ষমা চাইছেন। কিন্তু আপনার যদি দায় কিছু থাকে, তবে তা রুখে দাঁড়ানোর। আপনার লজ্জা, ক্ষমা সবিনয়ে মাথায় রেখে বলছি, সুযোগ এসেছে। রুখে দাঁড়ান, সত্যি রুখে দাঁড়ান। আদর্শিক দেশ ছিনিয়ে আনুন। ক্ষমা চেয়ে দায় এড়াবেন না।’
সংবাদ উপস্থাপক শ্রাবণী জলি লিখেছেন, ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। এইসব আজাইরা কথা বইলা লজ্জা দিয়েন না। আমিও আর বইলা লজ্জায় ফেলব না।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম জুড়ে এমন অসংখ্য মানুষের কান্না, ক্ষোভ, বেদনার ছড়াছড়ি। এ আসলে শুধু বেদনার কান্না নয়, তীব্র অসহায়ত্বের ক্ষোভও। ফেসবুকে একটু আধটু কান্না করা ছাড়া আর কীইবা করার আছে তাদের?
কুমিল্লার ঘটনা এবং এর প্রতিক্রিয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক তাণ্ডবের ঘটনার বিবেচনায় তাদের আবেগ, তাদের বক্তব্য ঠিক আছে। আমি জানি, আমার জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি কখনোই তাদের বেদনাকে অনুভব করতে পারব না। তবে বিশ্বাস করুন, একজন মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ হিসেবে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের কান্না, বেদনা, ক্ষোভ, ক্রোধ, অসহায়ত্ব আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। তবে আবেগকে একটু দূরে সরিয়ে রাখতে পারলে আমি বলব, তাদের অভিযোগ সত্য, তবে পুরোপুরি নয়, আংশিক। ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ বর্তমান পরিস্থিতিতে এটাকে আজাইরা কথা মনে হতে পারে। কিন্তু এটাই এ অঞ্চলের আবহমান কালের মূল চেতনা, মূল সুর। এবারের শারদীয় দুর্গোৎসব মাটি করে দেওয়ার এই তাণ্ডব সেই চেতনায় বড় আঘাত অবশ্যই। কিন্তু তাতে যেন সেই সুরটা কেটে না যায়, আমাদের সবাইকে সম্মিলিতভাবে সেই চেষ্টাটা করতে হবে।
রুমা মোদক যেমন রুখে দাঁড়ানোর কথা বলেছেন, তেমন ঘটনা কিন্তু ঘটছে। এটা ঠিক কোথাও সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নির্যাতনের শিকার হলে যখন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকেই প্রতিবাদ করতে দেখি, আমার খুব লজ্জা লাগে, নিজেকে ছোট মনে হয়। তবে কুমিল্লা ও পরে বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক তাণ্ডবের পর প্রতিবাদ হচ্ছে। ফেসবুকের প্রতিবাদকে যদি আমি গোনায় নাও ধরি, রাজপথেও কিন্তু সোচ্চার প্রতিবাদ হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে শান্তি সমাবেশ, সম্প্রীতি মিছিলের খবর পাচ্ছি।
ঢাকায় প্রতিদিনই প্রতিবাদ হচ্ছে। এটা ঠিক, যত সোচ্চার হবে, মানুষ হিসেবে আমার দায়-লজ্জা তত কমবে। সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনার পাশাপাশি রুখে দাঁড়ানোর ঘটনাও কম নয়। মুসলমান যুবকরা হিন্দুদের মন্দির, বাড়িঘর পাহারা দিচ্ছে। হামলাকারীর তুলনায় সংখ্যাটা হয়তো কম, তবু এই কয়েকজন মুসলমান যুবক গোটা সম্প্রদায়ের হেট হয়ে যাওয়া মাথা উঁচু করেছে। এমনিতে এ ধরনের ঘটনায় মোল্লাদের কেউ কেউ উসকানি দেয়, যাতে সহিংসতা আরও ছড়ায়। তবে এবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ কয়েকজন ইসলামী চিন্তাবিদের বক্তব্য আমাকে দারুণভাবে আশাবাদী করেছে, অনুপ্রাণিত করেছে। তারা কোরআন-হাদিসের আলোকে ব্যাখ্যা করে বলেছেন, এ ধরনের হামলা কোনোভাবেই ইসলাম সমর্থন করে না।
ইসলাম শান্তি, পরমতসহিষ্ণুতা, অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধার শিক্ষা দেয়। ইসলামে অন্য ধর্মের মানুষের বিশ্বাসে আঘাত না করতে, তাদের ধর্ম পালনে বাধা না দেওয়ার শিক্ষা দেয়। ইসলামে অন্য ধর্মের দেবী বা প্রতিমাকে গালি না দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। গালি দিলে অন্য ধর্মের মানুষও পাল্টা আল্লাহ-রসুলকে গালি দিতে পারে। ইসলামে কঠোরভাবে একজনের অপরাধে আরেকজনকে শাস্তি না দেওয়ার কথা বলা আছে।
চাঁদপুরের, নোয়াখালীর, রংপুরের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের অপরাধ কী? কেন তাদের পূজা করতে দেওয়া হলো না, কেন তাদের বাড়িঘরে হামলা চালানো হলো, কেন লুটপাট হলো?
কুমিল্লায় যে বা যারা ধর্মের অবমাননা করেছে, তিনি বা তারা যে ধর্মেরই হোন না কেন, তাদের কঠোর শাস্তি চাই। কিন্তু চাঁদপুরের, নোয়াখালীর, রংপুরের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের অপরাধ কী? কেন তাদের পূজা করতে দেওয়া হলো না, কেন তাদের বাড়িঘরে হামলা চালানো হলো, কেন লুটপাট হলো? যারা এই হামলা চালিয়েছে, আমরা তাদের শাস্তি চাই। তারা ইসলামের নামে হামলা করেছে বটে, তবে মুসলমান নয়; তাদের একটাই পরিচয়- দুর্বৃত্ত।
ইসলামী চিন্তাবিদদের বক্তব্য শুনে এটা স্পষ্ট, এই হামলাকারীরা ইহকালে তো শাস্তি পাবেই, পরকালেও তাদের জন্য অপেক্ষা করছে কঠিন শাস্তি। যারা ভালো মুসলমান, যারা হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর জীবনকে অনুসরণ করেন; তারা মানবেন, অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি তার গভীর শ্রদ্ধা ছিল। তাই ইসলামী চিন্তাবিদদের আরও বেশি করে কথা বলতে হবে, দুর্বৃত্তদের হাত থেকে ইসলামকে রক্ষা করতে আরও সোচ্চার হতে হবে। বলতে হবে, হামলাকারীরা দুর্বৃত্ত। এই অল্পকিছু দুর্বৃত্ত দিয়ে ইসলামকে বিচার করা যাবে না, বাংলাদেশকে বিচার করা যাবে না।
আমাদের সোচ্চার হতে হবে ইসলামের মর্যাদা রক্ষায়, বাংলাদেশের মূল চেতনা সমুন্নত রাখতে, মানবতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে। তবে এটা ঠিক আমরা যতই সোচ্চার হই, রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, উৎসবমুখর পরিবেশে তাদের ধর্ম পালনের পরিবেশ সৃষ্টি করার দায়িত্ব সরকারের।
৪৭, ৬৬, ৭১, ২০০১-এর মতো কাউকে যেন কখনোই দেশ ছাড়ার কথা ভাবতে না হয়। এই দেশ যতটা আমার, ততটাই রুমা মোদকের, শ্রাবণী জলির বা সিঁদুর খেলতে না পেরে ক্ষুব্ধ সেই নারীর। আমি জানি, এবারের ঘটনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের মনে যে গভীর ক্ষত তৈরি হয়েছে, এইসব মিষ্টি কথায় তা শুকাবে না।
রাষ্ট্রের কঠোর ভূমিকা আর সব মানুষের ঐক্যবদ্ধ সোচ্চার প্রতিবাদই শুধু ধীরে ধীরে তাদের মনে নিরাপত্তা বোধ ফিরিয়ে আনতে পারে। সবাই মিলেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ, সম্প্রীতির বাংলাদেশ ফিরিয়ে আনতে হবে।
প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ