জলবায়ু পরিবর্তন : তলিয়ে যেতে পারে বাংলাদেশের ১৩ শতাংশ ভূমি
জলবায়ু পরিবর্তনে পৃথিবীব্যাপী বাড়ছে তাপমাত্রা। গলছে মেরু অঞ্চলের বরফ। বিপদ সীমা অতিক্রম করছে সমুদ্র ও নদীর পানির উচ্চতা। তলিয়ে যাচ্ছে নিচু অঞ্চলগুলো। ভারী বৃষ্টিপাত, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। বসতঘর ছেড়ে বাস্তুচ্যুত হতে বাধ্য হচ্ছে কোটি কোটি মানুষ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ার সঙ্গে বাড়ছে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যাও।
বিশ্বব্যাংকের একটি সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আগামী তিন দশকে ২১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হবে। বিশ্বজুড়ে কার্বন নিঃসরণ কমাতে এবং সম্পদের ব্যবধান কমিয়ে আনার জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে বলে সতর্ক করেছে বিশ্বব্যাংক।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আগামী তিন দশকে ২১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হবে।
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল জীবিকায়ন এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে দক্ষিণ এশিয়া পৃথিবীর মধ্যে জলবায়ু সৃষ্ট অভিবাসনের ক্ষেত্রে সর্বাধিক সক্রিয় অঞ্চল হিসেবে পরিণত হতে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে সৃষ্ট ঘনঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় এখানকার দেশগুলো দ্রুত পারস্পরিক সহযোগিতাপূর্ণ ও ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে আগামী ৩০ বছরের মধ্যে এখানে জলবায়ু শরণার্থীর সংখ্যা বর্তমান সময়ের চেয়ে তিনগুণ বৃদ্ধি পেতে পারে।
বেশ আশঙ্কার বিষয় হলো, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর গুরুত্বপূর্ণ শহর ও বৃহৎ নগরকেন্দ্রগুলো গড়ে উঠেছে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির আশঙ্কায় থাকা উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে। আর এ কারণে এসব এলাকায় অভিবাসীদের আগমনের হার বাড়তেই থাকবে। তাই সম্ভাব্য জলবায়ু অভিবাসীদের বিষয়টিকে মাথায় রেখে অবিলম্বে নীতিনির্ধারকদের উচিত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় জলবায়ু অভিবাসীর অর্ধেকই হবে বাংলাদেশ থেকে। জরুরি উদ্যোগ এবং কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে বন্যা ও ফসলের উৎপাদন নষ্ট হয়ে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশর প্রায় দুই কোটি মানুষ অভিবাসী হওয়ার ঝুঁকিতে যাবে।
দেশের অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি ব্যবস্থাপনা বিষয়ক জাতীয় কৌশলপত্রে উল্লেখ করা হয়, ২০০৮ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশের ৪৭ লাখেরও বেশি মানুষ ঘরছাড়া হয়েছে।
২০১৯ সালের অর্ধবার্ষিকী প্রতিবেদনের হিসাব মতে, দেশের ২৩টি জেলা থেকে প্রায় ১৭ লাখ মানুষকে বাস্তুচ্যুত হতে হয়েছে। যার বেশিরভাগই ঘটেছে বিভিন্ন উপকূলীয় জেলাগুলোতে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশে প্রতি সাতজনে একজন বাস্তুচ্যুত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ২০৫০ সাল নাগাদ দেশে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা হবে প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এই দুর্যোগকে আরও বাড়িয়ে দিবে। ২০৮০ সালের মধ্যে তলিয়ে যেতে পারে বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলের ১৩ শতাংশ ভূমি।
সমুদ্রপৃষ্ঠে পানির উচ্চতা বৃদ্ধির অনুমেয় সবচেয়ে গুরুতর প্রভাব হলো চাষযোগ্য জমি, মাটি এবং পানিতে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ এবং তার পরিণতিতে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের কৃষিভিত্তিক জীবনযাত্রায় বিরূপ প্রভাব। এটিই উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের বাস্তুচ্যুতির অন্যতম বড় কারণ।
মূল ভূখণ্ড এলাকায় বাস্তুচ্যুতির প্রধান কারণ নদী ভাঙন ও বন্যা। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের এলাকায় নিয়মিত খরাও মানুষের বাস্তুচ্যুতির আরেকটি কারণ। ভূতাত্ত্বিকভাবে কয়েকটি সক্রিয় ভূ-চ্যুতির মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান। এই কারণে ভূমিকম্পের ঝুঁকি প্রবণ উচ্চ মাত্রার তালিকায় বাংলাদেশ অন্যতম।
ভারতীয় টেকটোনিক প্লেট (Plate Tectonics)-এর উত্তরপূর্ব কিনারে বাংলাদেশের অবস্থান এবং সক্রিয় সাবডাকশন জোন ও মেগা থ্রাস্ট ফ্রন্টের কারণে এ অঞ্চলে ভূমিকম্পের ঝুঁকি আগের অনুমানের চাইতেও বেশি হতে পারে। ভূমিকম্প শহর ও উপশহরগুলোতে বড় আকারে বাস্তুচ্যুতি ঘটাতে পারে বলে আশঙ্কাও আছে।
পরবর্তী দশকের মধ্যে অভিবাসন সক্রিয় অঞ্চল (হটস্পট) দেখা দিতে পারে এবং ২০৫০ সাল নাগাদ তা আরও তীব্র হতে পারে। এজন্য জলবায়ু অভিবাসীরা যেসব এলাকায় স্থানান্তরিত হবে এবং তাদের ছেড়ে যাওয়া অঞ্চলে যারা থাকবে তাদের সহায়তার জন্য দ্রুত পরিকল্পনা করা প্রয়োজন।
ক্রমবর্ধমান জলবায়ু সৃষ্ট অভিবাসন সংকট কেবল একটি মানবিক দুর্যোগই নয় বরং এর মধ্য দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাও হুমকির মধ্যে পড়তে পারে। এ অঞ্চলের বড় শহরগুলো এমনিতেই অত্যন্ত জনবহুল। বেঁচে থাকার জন্য যেভাবে গ্রাম ছেড়ে মানুষ শহরে আসছে তাতে অতিরিক্ত জনগণের খাদ্য, বাসস্থান ও জীবিকার চাহিদা মেটাতে শহরগুলোর চলমান সংকটগুলোর সাথে যুক্ত হবে আরও বাড়তি বোঝা।
জরুরি উদ্যোগ এবং কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে বন্যা ও ফসলের উৎপাদন নষ্ট হয়ে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশর প্রায় দুই কোটি মানুষ অভিবাসী হওয়ার ঝুঁকিতে যাবে।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা যেমন, ক্ষয়ক্ষতি তহবিল, অভিযোজন তহবিল, সবুজ জলবায়ু তহবিল থেকে অর্থ সংগ্রহ করার জোর প্রক্রিয়া প্রয়োজন। এ জন্যে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি তহবিল সংগ্রহ ও ব্যয় ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা জরুরি। স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষের অধীনে আলাদা বাজেট বরাদ্দ করা প্রয়োজন।
আন্তর্জাতিক ও দেশীয় শ্রমবাজার বিবেচনায় রেখে ঝুঁকিতে থাকা পরিবারগুলোর দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সরকারি ও বেসরকারি যৌথ অংশীদারির মাধ্যমে টেকনিক্যাল ট্রেনিং প্রদানের ব্যবস্থা করা। বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও রেমিট্যান্স প্রেরণকে জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজনে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে এর স্বীকৃতি দেওয়া এবং বাস্তুচ্যুতি প্রবণ এলাকাগুলো থেকে পরিবারের এক বা একাধিক সদস্যের জন্য আন্তর্জাতিক শ্রম অভিবাসনের সুযোগ তৈরি করা প্রয়োজন।
ক্ষতিকর গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানো এবং সবুজ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও স্থিতিস্থাপক উন্নয়নে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে জলবায়ু পরির্বতনজনিত অভিবাসনের হার ৮০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনা সম্ভব।
অভিবাসী অথবা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুতদের আকর্ষণ করার জন্য জলবায়ুর ঝুঁকি এবং অর্থনৈতিক বাধা মোকাবিলায় প্রতিটি কাঠামোতে নিজস্ব উন্নয়ন এবং অভিযোজন পরিকল্পনার প্রয়োজন হবে।
অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার ।। প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়