শেখ হাসিনা : মানবতার আলোকবর্তিকা
স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। বিদেশে অবস্থান করায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন। বাঙালির বুকে আশার সঞ্চার হয় হারানো বাংলাদেশকে আবার ফিরে পাওয়ার। এর মধ্যেই সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান একদল সেনাসদস্য কর্তৃক চট্টগ্রামে নিহত হন। এরপর ক্ষমতায় আসেন জেনারেল এরশাদ।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনে এদেশের মানুষ দীর্ঘ দেড় দশক পর গণতন্ত্রের অন্যতম একটি অনুষঙ্গ স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারলেও গণতন্ত্র পুরোপুরি মুক্তি পেল না। পরবর্তী সময়ে আরও দুটি নির্বাচনে ১৯৯৬-এ আওয়ামী লীগ ও পরে ২০০১-এ বিএনপি ক্ষমতায় আসে। এ সময়ে ঘটে ইতিহাসের আরেকটি নৃশংস হত্যার ঘটনা, একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা। নারীনেত্রী বেগম আইভি রহমানসহ অসংখ্য নেতাকর্মী নিহত ও আহত হন এ গ্রেনেড হামলায়। বেঁচে গেলেন জননেত্রী শেখ হাসিনা।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতান্ত্রিকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালিত্ব, অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্যভিত্তিক মানবিক বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়। আর অবশ্যই এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন আজকের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। যে দেশটি অস্তিত্বের সংকটের মধ্যে পড়েছিল, ৪০ শতাংশেরও বেশি মানুষের দারিদ্র্য নিয়ে জঙ্গিগোষ্ঠী উত্থানের মধ্য দিয়ে ব্যর্থ রাষ্ট্রের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছিল, সেটাই আজকে বিশ্বে উন্নয়নের বিস্ময়। ১৯৭২-৭৩ থেকে শুরু করে ২০০৬-০৭ সাল পর্যন্ত ৩৪ বছর সময় লেগেছিল মাথাপিছু আয় ৫৩২ ডলারে আসতে।
২০০৭-০৮ থেকে ২০১৯-২০ এসে মাথাপিছু আয় দাঁড়ায় ২০৬৪ ডলারে। ১১ বছরে প্রায় চারগুণ হয়েছে। ২০২১ সালে আমাদের মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২২২৭ ডলারে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ব্যাপারটি হচ্ছে নেতৃত্বের দূরদর্শিতা। নেতৃত্বের দূরদর্শিতা কীভাবে একটা জাতিকে উন্নয়নের পথ দেখায় তা বোঝার জন্য একটা উদাহরণ দিচ্ছি।
১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পঞ্চগড় সফরে গেলেন। নেত্রীর অগ্রগামী দল হিসেবে আমরা যারা যুবলীগের নেতৃত্বে ছিলাম, আগেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলাম। বিকালে সবাই যখন চা খাচ্ছিলাম তখন প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ করেই বলে বসলেন, ‘ভারতের দার্জিলিংয়ে যদি চা চাষ হতে পারে, তাহলে পঞ্চগড়ে কেন হবে না?’ সেখানে উপস্থিত ছিলেন পঞ্চগড়ের তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. রবিউল হোসেন। সম্ভাবনা যাচাই করতে তিনি মৌলভীবাজার থেকে চারা সংগ্রহ করে টবে লাগালেন। ২৫ বছর পর এখন পঞ্চগড়ে প্রায় ৩০০০ হেক্টর জমিতে চা চাষ হচ্ছে। ২০১৭ সালে উৎপাদন ছিল ৫৫ লাখ কেজি। বছরে তিন কোটি কেজি চা উৎপাদন সম্ভব।
২০০৭-০৮ থেকে ২০১৯-২০ এসে মাথাপিছু আয় দাঁড়ায় ২০৬৪ ডলারে। ১১ বছরে প্রায় চারগুণ হয়েছে। ২০২১ সালে আমাদের মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২২২৭ ডলারে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ব্যাপারটি হচ্ছে নেতৃত্বের দূরদর্শিতা।
শেখ হাসিনার মনোবল কত দৃঢ় এবং তিনি সিদ্ধান্তে কতটা অবিচল তার প্রমাণ পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে। দেশি-বিদেশি সব চাপ উপেক্ষা করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে তিনি ছিলেন আপসহীন। এছাড়া গ্যাস রপ্তানির সুযোগ নাকচ করে দিয়েও তার অদম্য সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বের দৃঢ়তার অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ। দেশি-বিদেশি চক্রান্তে কাল্পনিক দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য দাতা সংস্থা যখন অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়াল, তখন কালবিলম্ব না করে শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত নিলেন পদ্মা সেতু হবে নিজস্ব অর্থায়নে এবং হয়েছেও তাই। পদ্মা সেতু এখন বাস্তবতা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘সাড়ে সাত কোটি বাঙালিরে কেউ দাবায়া রাখতে পারবে না।’ বঙ্গবন্ধুর এই উক্তির স্থাপত্য রূপ হচ্ছে পদ্মা সেতু। ১৯৯৬ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে একই ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ‘সিউল থেকে বুসান’ হাইওয়ে নির্মাণে অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ায় বিশ্বব্যাংক। তখন দক্ষিণ কোরিয়া মহাসড়কটি নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি করে দেখিয়ে দেয় ‘আমরাও পারি’। এরপর থেকে বিশ্বব্যাংকের নির্ভরতা কমিয়ে আনে। ১৯৯৬ সালের পর দক্ষিণ কোরিয়া আর বিশ্বব্যাংকের কোনো ঋণ গ্রহণ করেনি।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত থাকার কারণে বিশ্ব দরবারে অনন্য এক উচ্চতায় আসীন হয়েছেন। সম্প্রতি ইউরোপের একটি গবেষণা সংস্থা ‘পিপলস অ্যান্ড পলিটিক্স’ বিশ্বের ৫ সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানকে চিহ্নিত করেছেন, যাদের কোনো দুর্নীতি স্পর্শ করেনি। তাদের বিদেশে কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই, উল্লেখ করার মতো সম্পদও নেই। ১৭৩ দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের ১০০ নম্বরের ভিত্তিতে স্কোর করা হয়। এই তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেন জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল, তার স্কোর ৯০।
দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুং, স্কোর ৮৮। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৮৭ স্কোর পেয়ে তালিকায় তৃতীয় স্থান অর্জন করেন। নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী ইরনা সোলবার্গ এবং ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি যথাক্রমে চতুর্থ ও পঞ্চম স্থান অধিকার করেন, তাদের স্কোর ছিল যথাক্রমে ৮৫ এবং ৮১। এই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দেশের ৭৮ শতাংশ মানুষ মনে করে শেখ হাসিনা দুর্নীতিমুক্ত এবং লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে। ছোটখাটো দুর্নীতিও তাকে স্পর্শ করতে পারেনি।
জননেত্রী শেখ হাসিনাকে আমরা দেখি বঙ্গবন্ধুর সব মানবিক গুণাবলিকে উত্তরাধিকার হিসেবে নিয়ে আর্তমানবতার সেবায় নিবেদিত হতে। ১৯৮৮ সালের বন্যায় নিজ হাতে বন্যার্তদের জন্য রুটি বানাতে আমরা দেখেছি। একইভাবে নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডে পরিবারের সব সদস্যের হারানো তিন কন্যাকে নিজের কন্যা হিসেবে গ্রহণ করে তাদের বিয়ের আয়োজন করতে দেখেছি। এ রকম আরও অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যাবে, যার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার মানবিকতার পরিস্ফুটন ঘটেছে। চলমান করোনা মহামারির গত এক বছরেও সারা দেশে ৫০ লাখ পরিবারকে আর্থিক মানবিক সহায়তার নতুন রেকর্ড তৈরি করেছেন শেখ হাসিনা। পৃথিবীর ইতিহাসে এটি বিরল।
আগে থেকেই আরও ৫০ লাখ পরিবারের দুই কোটি সদস্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে ছিল। এর আওতায় ভিজিএফ কার্ড, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, শিক্ষা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, স্বামী পরিত্যক্তদের জন্য ভাতা ইত্যাদি চালু করে একটি উন্নয়নশীল দেশে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আদর্শ মডেল হিসেবে বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই স্থান করে নিয়েছে।
জননেত্রী শেখ হাসিনার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির সর্বশেষ মাইলফলক উদাহরণ হচ্ছে গৃহহীনদের গৃহদান। আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে এ মুজিববর্ষে সাড়ে ৮ লাখ গৃহহীন মানুষকে পাকা ঘর তৈরি করে দিচ্ছেন।
করোনা মহামারির গত এক বছরেও সারা দেশে ৫০ লাখ পরিবারকে আর্থিক মানবিক সহায়তার নতুন রেকর্ড তৈরি করেছেন শেখ হাসিনা। পৃথিবীর ইতিহাসে এটি বিরল।
পৃথিবীর ইতিহাসে খুব সম্ভবত এটাই সবচেয়ে বড় দুস্থদের জন্য গৃহায়ন প্রকল্প। বর্তমান বিশ্বের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা মানবিক রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। জাতিসংঘের চলতি সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে যে মানবতা দেখিয়েছেন তা মনে রাখবে বিশ্ববাসী।’
জাতিসংঘের কার্যক্রমে বিশ্ব শান্তি রক্ষায়, জলবায়ু পরিবর্তন ও নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের ভূমিকা প্রশংসা করেন জাতিসংঘের মহাসচিব। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা কতটা মানবিক এর একটা উদাহরণ দিয়েই আজকের আলোচনার শেষ করব। ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ প্রধানমন্ত্রী উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যান। সেখানে এক আবেগঘন পরিবেশে আশ্রয়গ্রহণকারী নির্যাতিত নারী ও শিশুর মুখে নির্বিচারে হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও বর্বরোচিত অত্যাচারের কথা শুনে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রী।
এই রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের উপর একটি সংবাদচিত্র লন্ডনের আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ‘চ্যানেল ফোর’ কর্তৃক প্রচারিত হয়। চ্যানেলটির এশিয়ান করসপন্ডেন্ট জনাথান মিলার তার প্রতিবেদনে প্রধানমন্ত্রী হাসিনার মমত্ববোধ, মানবিকতা, মহানুভবতা ও উদারনৈতিক মানসিকতার জন্য ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ অভিধায় অভিহিত করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা চারবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করে সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, জনসাধারণের ক্ষমতায়ন ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে যুগান্তকারী পরিবর্তনের পাশাপাশি বিশ্ব জলবায়ু ও পরিবেশ রক্ষা, শান্তি ও স্থিতিশীলতা, সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ দমন, মাদক নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি বিষয়ে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। এর স্বীকৃতি হিসেবে বিশ্বের বহু খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করেছে এবং পদকে ভূষিত করেছে।
এ ধারাবাহিকতায় এ বছর জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন সংক্রান্ত নবম বার্ষিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ‘জুয়েল ইন দ্য ক্রাউন অব দ্য ডে’ (মুকুট মণি) হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই সাফল্য দেশ ও জাতির জন্য বয়ে এনেছে গৌরব, আমরা হয়েছি মর্যাদাবান।
ড. মীজানুর রহমান ।। অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়