পুলিশ যখন অপরাধী
সিআইডি থেকে বরখাস্ত হওয়া এসআই আকসাদুদ জামানকে নিয়ে গত শনিবার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে প্রথমসারির একটি গণমাধ্যম। ‘পুলিশ থেকে ডাকাত, তাতেই কোটিপতি’ শীর্ষক এই প্রতিবেদনে পুলিশের বরাত দিয়েই বলা হয়েছে, ডাকাতির পাশাপাশি যেকোনো ধরনের অপরাধমূলক কাজে আকসাদুদ জামান ছিলেন সিদ্ধহস্ত। গাড়ি-বাড়ির পাশাপাশি তার রয়েছে হুন্ডি ব্যবসা, গার্মেন্টস, কারখানা আর একটি অনিবন্ধিত এনজিও। ২৬ বছরের চাকরি জীবনে একটি গুরুদণ্ড ও ২৬টি লঘুদণ্ড পেয়েছেন এবং তার বিরুদ্ধে আনা বেশিরভাগ অভিযোগই ছিল অর্থসংক্রান্ত।
কিছুদিন আগেই আমরা জানলাম, রংপুর থেকে দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলায় গিয়ে এক বাড়ি থেকে দুজনকে অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে সিআইডির তিনজন সদস্যকে আটক করা হয়েছে। এর আগে দেখলাম, স্বর্ণের দোকানে ডাকাতির ঘটনায় ফেনী গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম ভুঁইয়াসহ ছয় পুলিশ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
অপরাধ দমনের জন্য রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সুবিধাপ্রাপ্ত একটি আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা যখন নিজেরাই অপরাধে জড়িয়ে যায় তখন সামগ্রিকভাবে এই প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে ভাবতে হয় সংবেদনশীল নাগরিকদের।
আর সম্প্রতি খবর এলো, ই-কমার্স ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের কথিত পৃষ্ঠপোষক বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শেখ সোহেল রানাকে ভারত-নেপাল সীমান্ত এলাকা থেকে আটক করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। এরকম অসংখ্য সংবাদ তুলে আনা যাবে। কিন্তু উপরে যেসব খবর এলো এগুলো খুব সম্প্রতি গণমাধ্যমে জায়গা পাওয়া।
অপরাধ দমনের জন্য রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সুবিধাপ্রাপ্ত একটি আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা যখন নিজেরাই অপরাধে জড়িয়ে যায় তখন সামগ্রিকভাবে এই প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে ভাবতে হয় সংবেদনশীল নাগরিকদের। এসব ঘটনায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার সদস্যদের মধ্যে অর্থলিপ্সা বাড়ছে এবং এজন্য তারা গুরুতর অপরাধ সংঘটনেও পিছপা হচ্ছে না। এটি শুধু উদ্বেগজনক নয়, অত্যন্ত বিপজ্জনকও।
পুলিশকে আমরা অনেকেই বাহিনী বলছি। কিন্তু পুলিশ আসলে একটি জনসেবা সংস্থা। অপরাধের যেসব ঘটনা নিয়মিত ঘটিয়ে চলেছেন এর সদস্যরা, এগুলো এই সংস্থার সদস্যদের নীতি-নৈতিকতার মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
পুলিশের অনেক সদস্য অনেক মানবিক, অনেক ভালো কাজ করেন, করছেন। কিন্তু মানুষের ধারণা ভিন্ন। কারণ, পুলিশ যে নিজেকে নানান ছাড়পত্রের অধিকারী ভাবে, তা দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা থেকেই মানুষ জানে। পথে-ঘাটে, রাস্তার মোড়ে, ট্রাফিক সিগন্যালে, হাটে-বাজারে পুলিশের অনিয়মের অসংখ্য উদাহরণের মুখোমুখি হতে হয় মানুষকে।
‘পুলিশ হলেই নিয়মের ঊর্ধ্বে নন’—এ কথাটা শুরু থেকেই বলছেন বর্তমান আইজিপি বেনজির আহমেদ। কিন্তু মনে হচ্ছে, অনেক পুলিশ সদস্যের মাথায় কথাটা ভালো করে প্রবেশ করেনি।
আইন রক্ষার ভার যাদের হাতে তুলে দিয়েছে রাষ্ট্র, তারাই যদি আইন নিজেদের হাতে তুলে নেন তাহলে মানুষ যাবে কার কাছে? পুলিশের একটা অংশের বিরুদ্ধে ঠিক এই অভিযোগই বারবার উচ্চারিত হয়। দায়িত্ব কাঁধে নিলে তা পালন করার শক্তি ও আন্তরিকতা থাকতে হয়, অন্যথায় এর অপব্যবহার হয়।
আগেও বলেছি, আবারও বলছি, পুলিশ অর্থেই অমানবিক বা অত্যাচারী নয়। অসংখ্য পুলিশ কর্মী আছেন, যারা এর উল্টো পথের পথিক, সমাজ তাদের মান্য করে। কিন্তু মানবিকতার চর্চা আরও পরিশ্রমসাধ্য।
পুলিশ অর্থেই অমানবিক বা অত্যাচারী নয়। অসংখ্য পুলিশ কর্মী আছেন, যারা এর উল্টো পথের পথিক, সমাজ তাদের মান্য করে। কিন্তু মানবিকতার চর্চা আরও পরিশ্রমসাধ্য।
করোনাকালে পুলিশের মানবিক কাজ মানুষ দেখেছে। কিন্তু টেকনাফের ওসি প্রদীপ, সিলেটের এসআই আকবরের কাণ্ড, কিংবা সাম্প্রতিককালের এসব ঘটনা মানুষকে ভিন্ন চিত্রও উপহার দেয়, মানুষকে ভীত করে। একটা ধারণা স্পষ্ট হয় না বা দৃশ্যমান হয় না যে, পুলিশ সদর দফতর অভিযুক্ত সদস্যদের কী ধরনের শাস্তি দেয়।
মানুষের ধারণা গুরুদণ্ড না দিয়ে লঘুদণ্ডই দেওয়া হয়। ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন, ফৌজদারি মামলার অপরাধ করলেও বেশিরভাগ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দিয়েই ইতি টানা হয়। বেশিরভাগ ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় সাজার নামে সবকিছু মানুষের নজরের আড়ালে নিয়ে যাওয়া হয়।
মানুষ মনে করে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের প্রত্যাহার বা সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তারপর কৌশলী তদন্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যকে রক্ষা করা হয়। এই চর্চা অব্যাহত থাকলে পুলিশ সদস্যদের অনেককেই অপরাধের চর্চা থেকে বের করে আনা কঠিন হবে।
মনে রাখা দরকার, সরকারের যত সংস্থা আছে তাদের মধ্যে পুলিশের কাজ সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান। তাই তাদের সতর্কতা বেশি প্রয়োজন। যদি সদস্যদের একজনের মাথায়ও এমন ধারণা পাকাপোক্ত হয় যে, নাগরিকের আবার প্রাণের মূল্য কী? তাহলে বুঝতে হবে সদস্যদের ওরিয়েন্টশনে বড় ঘাটতি আছে।
পুলিশ সদস্যদের অনেকে হৃদয়হীন বা অপরাধ প্রবণ—সমাজের নানা স্তরে তা নিয়ে প্রতিক্রিয়াও অনেক। এসব কিন্তু আজকের বিষয় নয়। ঐতিহাসিক কাল থেকে হয়ে আসছে। আচমকা পুলিশের একাংশ এমন হয়ে পড়েনি। অবশ্যই এর পরিবর্তন প্রয়োজন। এখানে রাজনীতিরও যোগ আছে। সুবিধা অনুযায়ী পুলিশকে ব্যবহার করার রাজনৈতিক প্রবণতা থাকলে বাহিনীর ভেতরের কেউ কেউ অভব্যতা করবেই।
আমাদের মতো দেশে পুলিশের ক্ষমতা অনেক, বলতে গেলে সীমাহীন। কিন্তু ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া প্রতিটি পেশার মানুষকে আরও বেশি সচেতনতার চর্চার মধ্যে থাকা প্রয়োজন। উন্নয়ন স্পৃহার বাংলাদেশে পুলিশ সদস্যরা সেটাই ভাববেন আশা করি।
অপরাধের মাত্রা বাড়লে তার প্রথম দায় নিতে হবে পুলিশ প্রশাসনকে। একটা সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানের কোনো কোনো সদস্যের চরিত্র এভাবে নষ্ট হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করে প্রতিকারের উদ্যোগ নিতে হবে।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, জিটিভি