তালেবান কেন আবার ক্ষমতায়?
দুই দশকের সামরিক উপস্থিতির অবসান ঘটানোর মার্কিন সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর থেকে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় তালেবান বাহিনীর হাতে কাবুলের পতন ঘটল। কাবুলে ঢুকে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের নিয়ন্ত্রণ এখন তালেবানদের। পালিয়ে গেলেন আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদেশসমূহ ও ভারত দূতাবাস খালি করে তাদের কূটনৈতিকদের নিজ দেশে ফিরিয়ে আনছে। বলা যেতে পারে, প্রায় বিনা প্রতিরোধে তালেবান বাহিনী বিস্ময়কর সামরিক সাফল্য অর্জন করল।
তালেবানদের এই সামরিক বিজয় আফগানিস্তানের ক্ষমতার রাজনীতির দৃশ্যপট সম্পূর্ণ উল্টে দিয়েছে। দীর্ঘ বিশ বছর ক্ষমতাসীন একটি সরকার এবং তাদের সামরিক ও নিরাপত্তা বাহিনীর এই পরাজয় নানা ধরনের প্রশ্ন সৃষ্টি করছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আফগান সরকারকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ব্যাপক সামরিক ও অর্থনৈতিক সমর্থন দেওয়া হয়েছিল।
মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর মতো আধুনিক অস্ত্র ও কৌশলে সজ্জিত বাহিনী কাবুল সরকারের সক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু মধ্য আগস্ট ২০২১ এর মধ্যে আফগান সরকারের করুণ পরিণতি ভোগ করতে হলো।
মার্কিন সামরিক অভিযানের ব্যর্থতাকে বিশ্লেষণ করে ‘ভিয়েতনাম’ পরাজয়ের সঙ্গে তুলনা করছেন অনেকে। তবে মার্কিন প্রশাসন আফগান সামরিক অভিযানের চূড়ান্ত ফলাফলের ব্যাপারে স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীনভাবে মেনে নিয়েছেন যে আরও বিশ বা পঞ্চাশ বছর দেশটিতে অবস্থান করলেও কোনো গুণগত পরিবর্তন কিংবা সাফল্য অর্জিত হবে না।
তালেবানরা একদিকে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে তথাকথিত দোহা শান্তি আলোচনা করেছে, অন্যদিকে পাকিস্তান, চীন, রাশিয়া ও ইরানের মতো আঞ্চলিক মিত্র রাষ্ট্রদের সঙ্গে সম্পর্ক উষ্ণ করেছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের এ উপলব্ধির পেছনে কাজ করছে একদিকে তালেবান বাহিনীর অব্যাহত সহিংসতার প্রয়োগ ও সামরিক শক্তি প্রদর্শন, অন্যদিকে কাবুল সরকারের সামগ্রিক ব্যর্থতা।
দুর্গম পাহাড়-পর্বত ঘেরা, জাতিগত বিভেদ ও উগ্রবাদের চারণভূমি ভূ-পরিবেষ্টিত রাষ্ট্র হচ্ছে আফগানিস্তান। বহিঃশক্তিসমূহকে পরাজিত করার অনন্য ঐতিহ্য থাকলেও অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বরাবরই অনৈক্য, সহিংসতা, উগ্রবাদ ও গোষ্ঠীগত মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত। ফলে তালেবানদের ক্ষমতা দখল আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো আশাবাদের সুযোগ তৈরি করছে না। বরং গৃহযুদ্ধের নতুন একটি অধ্যায় শুরুর অপেক্ষা করছে।
তালেবানদের পক্ষ থেকে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর, অতীতে নিবর্তনমূলক শাসন পরিহারের ঘোষণা দিলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন ঘটছে না।
তালেবান বাহিনীর সামরিক শক্তি প্রয়োগ, আফগান বাহিনীর সদস্যদেরকে হত্যা ও নারীদের প্রতি আচরণ থেকেই অনুমান করা যায় যে, তালেবান-১ ও তালেবান-২ এর মধ্যে গুণগত কোনো পার্থক্য নেই। রাজনৈতিক মতাদর্শের মধ্যে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। তবে গত কয়েক বছরব্যাপী এই বাহিনীর কূটনৈতিক কৌশলের পরিবর্তন লক্ষণীয়।
আশির দশকের আফগান যোগাযোগই বাংলাদেশে জঙ্গির বিস্তার ঘটিয়েছিল। এর ধারাবাহিকতায় তালেবানদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
তালেবানরা একদিকে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে তথাকথিত দোহা শান্তি আলোচনা করেছে, অন্যদিকে পাকিস্তান, চীন, রাশিয়া ও ইরানের মতো আঞ্চলিক মিত্র রাষ্ট্রদের সঙ্গে সম্পর্ক উষ্ণ করেছে। ফলে এই বাহিনীর সামরিক বিজয়টি সহজ হয়েছে।
আফগানিস্তানের এই পরিস্থিতি বা সংকট শুধু দেশটির জনগণের সমগ্র অঞ্চলের জন্য এক অশনি-সংকেত। ফলে স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশের জন্য আফগান সংকট একটি নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
এ কথা সকলেই জানেন যে, আশির দশকের আফগান যোগাযোগই বাংলাদেশে জঙ্গির বিস্তার ঘটিয়েছিল। এর ধারাবাহিকতায় তালেবানদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ফলে তালেবানদের বিজয় বাংলাদেশসহ সমগ্র দক্ষিণ ও মধ্য-এশিয়ায় জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদের নতুন হুমকি তৈরি করতে পারে। এ আশঙ্কা ও উদ্বেগ তালেবানদের মিত্র রাষ্ট্রসমূহের মধ্যেও আছে।
দ্বিতীয়ত, তালেবানদের সামরিক বিজয় শুধু আফগানিস্তানকে গৃহযুদ্ধের দিলে ঠেলে দিবে না, এই অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলবে।
গ্রেট গেম, শক্তির রাজনীতি, অবিশ্বাস ও বৈরী পরিবেশ আরও বাড়বে যা নতুন কূটনৈতিক ঝুঁকি তৈরি করবে। শান্তি ও উন্নয়নের কূটনীতিতে বিশ্বাসী বাংলাদেশের জন্য এ বিষয়টি অস্বস্তিকর ও চ্যালেঞ্জিং।
এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে আরও সতর্ক অবস্থায় যেতে হবে। একদিকে রোহিঙ্গা সংকট, মিয়ানমারের সামরিক জান্তাদের শাসন, অন্যদিকে নতুন আফগান সংকট, তালেবানদের শাসন এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তিসমূহের ভূ-রাজনৈতিক লড়াই বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির পথে বড় ধরনের অন্তরায় হয়ে উঠতে পারে।
ড. দেলোয়ার হোসেন ।। অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ ও পরিচালক, দ্য ইস্ট এশিয়া স্টাডি সেন্টার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়