আমি তোমাদেরই লোক
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। তিনি সকল পেশা ও শ্রেণির মানুষকে এই বার্তায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন যে, স্বাধীনতা ছাড়া বাঙালি জনগণের মুক্তি নেই এবং এজন্য জীবন বাজি রেখে প্রয়োজনে সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে। এই কাজটি অত্যন্ত দুরূহ ছিল।
ধর্মীয় দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিল, বাংলার মুসলমানেরা পাকিস্তান সৃষ্টির মধ্যে মুক্তির পথ অন্বেষণ করেছে এবং শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সহকর্মীরা মুসলিম লীগের এই দাবির সপক্ষে আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন।
পাকিস্তানের শাসকবর্গ আমাদের জাতি পরিচয়ের সাথে ধর্ম পরিচয়ের দ্বন্দ্ব আবিষ্কার করেছে এবং এ ধারা শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে সন্নিবেশিত করার সকল প্রয়াস গ্রহণ করেছে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির এই করাল গ্রাস থেকে মুক্তি সহজ ছিল না।
পাকিস্তান আমলের দুই দশকের অধিককাল যাবৎ বহু রাজনীতিবিদ, শিল্পী, সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী বিশেষত—ছাত্র সমাজ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তবে ধাপে ধাপে আন্দোলন ও ত্যাগের মধ্য দিয়ে সঠিক সময়ে সঠিক দাবি উত্থাপন করে বিশেষত—১৯৬৬ সালে ছয় দফা উত্থাপনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করতে সমর্থ হয়ে মহানায়কে পরিণত এবং সর্বশ্রেণির মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
এই দুরূহ কর্ম সম্পন্ন করার পশ্চাৎপট বিবেচনা করা একান্ত প্রয়োজন এবং বর্তমানে প্রাসঙ্গিক। কারণ পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের পর সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পুনরুত্থান ঘটেছে এবং কেবল বাংলাদেশ নয়, সমগ্র উপমহাদেশে নুতন পরিবর্তিত বিশ্বে নতুন অবয়বে ধর্ম বিদ্বেষ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বঙ্গবন্ধু যে সমতাভিত্তিক সমাজের বাংলাদেশ চেয়েছিলেন সে দেশে ধন বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশ যখন উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে তখন লোভের সর্বগ্রাসী বিস্তার সমাজে অস্থিরতা ও অবক্ষয়ের জন্ম দিচ্ছে। অথচ, বঙ্গবন্ধু তার মাত্র তিন বছরের শাসনামলে এই প্রবণতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।
উপমহাদেশের শীর্ষ স্থানীয় রাজনীতিবিদদের সাথে বাংলার রাজনীতিকদের পার্থক্য ছিল আর শেখ মুজিব তাদের মধ্যে সবচেয়ে ব্যতিক্রমী চরিত্র।
বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের মধ্যেই বাঙালির সমাজ ও মনোজগতের এই উত্তরণের উত্তর পাওয়া যাবে। প্রথমত, উপমহাদেশের শীর্ষ স্থানীয় রাজনীতিবিদদের সাথে বাংলার রাজনীতিকদের পার্থক্য ছিল আর শেখ মুজিব তাদের মধ্যে সবচেয়ে ব্যতিক্রমী চরিত্র।
মহাত্মা গান্ধী ব্যারিস্টারি পাস করার পর দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনীতিতে প্রবেশ করেছেন, পরে ভারতে প্রত্যাবর্তন করে অহিংসার আদর্শিক অবস্থান থেকে দরিদ্রজনের পোশাকে স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
জওহরলাল নেহেরু ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান, বুদ্ধিবৃত্তির চর্চায় অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাইকোর্টের বিচারপতির সন্তান ও বিশিষ্ট আইনবিদ আর মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ পোশাক ও খাদ্যাভ্যাসে এলিট শ্রেণির দৃষ্টান্ত।
এ. কে. ফজলুল হক বরিশালে, গ্রামে জন্মগ্রহণ করলেও তার রাজনীতিতে প্রবেশ ঘটে বিশিষ্ট আইনজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর, তবে গ্রামীণ পরিবেশের সাথে সম্পৃক্ত থাকার ফলে কৃষকদের দুঃখ মোচনের জন্য প্রজাস্বত্ব আইন প্রবর্তন করেন। অন্যদিকে পূর্ববাংলার মুসলিম লীগের নেতৃত্ব নওয়াব পরিবারের হাতে।
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সাধারণ মানুষের স্বার্থের রাজনীতি করেছেন, কিন্তু বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণ, অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে ষাটের দশকে চীনের নেতৃত্বের সমর্থক হয়ে পড়ায় বারবার মত পরিবর্তন করেছেন।
বঙ্গবন্ধু কোনো এলিট শ্রেণির মানুষ নন। এই ব্যতিক্রমীজন জন্মগ্রহণ করেছেন গোপালগঞ্জের নিভৃত গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায়। দ্বিতীয় প্রজন্মের শিক্ষিত ব্যক্তি হিসেবে বেড়ে উঠেছেন গ্রামীণ পরিবেশে...
অপরদিকে বঙ্গবন্ধু কোনো এলিট শ্রেণির মানুষ নন। এই ব্যতিক্রমীজন জন্মগ্রহণ করেছেন গোপালগঞ্জের নিভৃত গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায়। দ্বিতীয় প্রজন্মের শিক্ষিত ব্যক্তি হিসেবে বেড়ে উঠেছেন গ্রামীণ পরিবেশে, আর নিজেকে যুক্ত করেছেন কলকাতার তরুণ শিক্ষিত সমাজের সাথে। একাধারে দরিদ্র কৃষককুল ও পূর্ববঙ্গের তরুণ মুসলিম সমাজের মধ্যে পদচারণার সাথে যুক্ত হয়েছে তার মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা ও অসাধারণ নেতৃত্বগুণ।
শেখ মুজিবের নিজস্ব বয়ানে পাকিস্তানের দ্বি-জাতি তত্ত্বের প্রতি মোহভঙ্গ ঘটে পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পরে। স্বাধীনতার পর অন্নদাশংকর রায়কে সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন যে, তিনি ১৯৪৭ সালেই মনে করেছিলেন বাংলার স্বাধীনতা ছাড়া মুক্তি নেই।
এজন্য এই দূরদর্শী নেতা ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রতিটি আন্দোলনে হঠকারিতা অবলম্বন করেননি, বরং সময়োচিত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এটি সম্ভব হয়েছিল কারণ তিনি আন্দোলন ও ত্যাগের মধ্য দিয়ে জনগণের হৃৎস্পন্দন উপলব্ধি করতে পেরেছেন। এজন্য বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের সৃষ্টি এবং ইতিহাসের স্রষ্টা।
এর ফলে বঙ্গবন্ধু ক্রমান্বয়ে জাতির অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়েছেন। বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশের জনগণ একাত্তরের ১ মার্চ তার হাতে দেশের শাসনক্ষমতা প্রদান করেছিল, তার নির্দেশে এই অঞ্চল পরিচালিত হয়েছে। দেশের সর্বজন বিশ্বাস করেছে ‘তিনি আমাদেরই লোক।’
আজ তার জন্ম শতবর্ষের জাতীয় শোক দিবসে সমাজ ও রাজনীতিতে অশুভ প্রবণতার জন্য যে অশনি সংকেত লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা থেকে মুক্তির পথ বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের মধ্যে সন্ধান করতে হবে।
ডা. সারওয়ার আলী ।। ট্রাস্টি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর; নির্বাহী সম্পাদক, ছায়ানট