কোন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের এক ছবি বুকের গভীরে ধারণ করেছিলেন। জনজীবনের সঙ্গে তার যে সম্পৃক্ততা, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জন্য তার দরদ এবং সব রকম বঞ্চনা, দুর্দশা, দুর্গতি থেকে মুক্তি পেয়ে মানুষ পাবে জীবন বিকাশের সুযোগ—এমন প্রত্যাশা থেকে তার যে দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন, সেটা এক অর্থে স্বপ্ন-তাড়িতই বলা যায়।
প্রবল বাঁধার বিরুদ্ধে তার জীবন ভর লড়াইয়ে দেখা গেছে কখনো তিনি হতোদ্যম হননি, এমনকি যখন অন্ধকার হয়ে আসে গভীর, চলার পথের অনেক সঙ্গী চলে গেছেন ভিন্ন পথে, রাষ্ট্র ক্রমে ধারণ করে বিপুল পরাক্রম, এমন দুঃসময়েও তিনি আস্থা হারান না নিজের ওপর এবং তার সংগ্রামী প্রত্যয়ে। বরং দেখা যায় রাষ্ট্র তাকে একের পর এক কঠোর শৃঙ্খলে আটক করতে চাইছে, আর প্রতিবারই তিনি প্রতিপক্ষের মোকাবিলায় হয়ে উঠেছেন শক্তিশালী। তিনি দেশের মানুষের কাছে আরও বরণীয়, আরও অধিকতর আস্থার ও ভালোবাসার মানুষ।
বঙ্গবন্ধুর জীবনের পথ-পরিক্রমণের দিকে তাকালে এখন আমরা বুঝি, ক্রমাগতই তিনি নিজেকে অতিক্রম করে চলেছেন, এই পরিবর্তনময়তার পাশাপাশি তার ছিল এক অপরিবর্তনীয় দিক। তিনি সেই বিচারে থেকে গিয়েছিলেন একই মানুষ, অন্তরে ছিল এক স্বপ্ন যা কখনো পাল্টায়নি, পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে পাল্টে গেছে তার রাজনৈতিক সংগ্রামের পথ ও পদ্ধতি, কিন্তু লক্ষ্য থেকে গেছে স্থির।
এই লক্ষ্য বাংলার জন্য তার ভালোবাসা এবং বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য তার রাজনীতি। এই লক্ষ্য নিয়ে ধাপে ধাপে তিনি অগ্রসর হয়েছেন, রাজনীতিতে যারা ছিলেন অগ্রসর তাদের দ্বিধা ও আপসকামিতা দেখে তিনি পীড়িত বোধ করেছেন এবং নীতির প্রশ্নে তাদের সঙ্গে বিবাদ করতে পিছ পা হননি।
১৯৬৬ সালে তিনি ঘোষণা করলেন ৬ দফা, বাঙালির বাঁচার দাবি, ১৯৬৯ সালে সেনা-সরকারের ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে বের হয়ে এলেন কারাগার থেকে, অভিষিক্ত হলেন বঙ্গবন্ধু রূপে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বয়োবৃদ্ধ শেরে বাংলা দন্তহীন বাঘে পরিণত হয়েছিলেন এবং আপসকামিতায় পিচ্ছিল পথে তলিয়ে গিয়েছিলেন। ফজলুল হকের এই পথভ্রষ্টতার মূল্য দিয়ে বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম এবং তার প্রধান প্রতিপক্ষ হয়েছিলেন শেখ মুজিব। মাওলানা ভাসানীও বারবার পা দিয়েছেন ষড়যন্ত্রকারীদের ফাঁদে এবং তাকে মূলধারায় স্থিত রাখতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন শেখ মুজিব।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাবশিষ্য ছিলেন শেখ মুজিব এবং সোহরাওয়ার্দী যখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় আইনমন্ত্রী হিসেবে যোগ দিলেন, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি পরিহার করে এক ইউনিটে সায় দিলেন তখন তার কঠোর সমালোচক হয়েছিলেন শেখ মুজিব।
এই একনিষ্ঠতা তাকে বাঙালির গণতান্ত্রিক জাতীয় অধিকার আন্দোলনের নেতৃত্বের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেল এবং সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর দলের হাল ধরে সেই নেতৃত্ব তিনি গ্রহণ করলেন। এই পর্ব শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নযাত্রা, ১৯৬৬ সালে তিনি ঘোষণা করলেন ৬ দফা, বাঙালির বাঁচার দাবি, ১৯৬৯ সালে সেনা-সরকারের ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে বের হয়ে এলেন কারাগার থেকে, অভিষিক্ত হলেন বঙ্গবন্ধু রূপে।
১৯৭০ এর নির্বাচনে পেলেন একচ্ছত্র ম্যান্ডেট, একাত্তরে ৭ মার্চ সেই গণতান্ত্রিক শক্তিতে ঘোষণা করলেন বাঙালির সার্বভৌমত্ব। এরপর পাকিস্তানের সশস্ত্র আঘাত মোকাবিলায় মুক্তির যুদ্ধে জাতির ঝাঁপ দিতে আর বিলম্ব হয়নি, নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর প্রতিষ্ঠা পায় বাঙালির স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ।
আজকের বাংলাদেশ অনেকভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে এটা সত্য, তবে তার স্বপ্নের বাংলাদেশ থেকে আমরা রয়েছি অনেক দূরে, সেই স্বপ্ন কেবল প্রবৃদ্ধি দিয়ে পরিমাপ করার নয়।
এই দিন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণের অভিযাত্রার শুরু, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা যত বড় অর্জনই হোক, তা ছিল স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে তোলার বদ্ধদ্বারের উন্মোচন। বিজয়ী বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শুরু করেছিল সেই সংগ্রাম, যা বাঙালির মুক্তির বিরোধী পক্ষ মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় রুদ্ধ ও পথভ্রষ্ট করে দিল চরম নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে।
১৯৭৫-এর সেই নৃশংসতার পর আমরা পাড়ি দিয়েছি দীর্ঘ পথ। আজকের বাংলাদেশ অনেকভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে এটা সত্য, তবে তার স্বপ্নের বাংলাদেশ থেকে আমরা রয়েছি অনেক দূরে, সেই স্বপ্ন কেবল প্রবৃদ্ধি দিয়ে পরিমাপ করার নয়। প্রবৃদ্ধি সাধারণ মানুষ, পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর জীবন বিকাশে কী ভূমিকা পালন করছে সেটা গুরুত্ববহ।
রাষ্ট্রের ওপর নাগরিকের অধিকার এবং সরকারের কর্মকাণ্ডে পিছিয়ে পড়া ও সুবিধা বঞ্চিতদের কল্যাণ নিশ্চিত করা বিশেষ জরুরি। বস্তুত, আমাদের কতক সামাজিক সূচক নির্ধারণ করে সেই আলোকে বিবেচনা করতে হবে প্রবৃদ্ধি ও জনকল্যাণ।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশের একটি সূচক হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ, সেই বিচারে বাংলাদেশের সংবিধান আবার বহুলাংশে ৭২-এর সংবিধানের চার জাতীয় নীতির সমীপবর্তী হয়েছে। কিন্তু এর পাশাপাশি ধর্মীয় সহনশীলতার অভাব, ধর্মকে ব্যবহার করে সংঘাত উসকে দেওয়া এবং সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার আমাদের উদ্বিগ্ন করে। একই সাথে অর্থ ও বিত্তের জোরে রাজনীতি, প্রশাসন, নীতি-নির্ধারণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ধনবান শ্রেণির প্রতিপত্তি বিপুলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যার পরিণামে নব্য-ধনিকের অন্তঃসারশূন্য সংস্কৃতি সমাজকে বিপথে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
সংস্কৃতির যে শক্তিতে জাতীয় জাগরণের উদ্গাতা হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, তার থেকে আমরা সরে এসেছি সহস্র যোজন, এ বড়ই দুর্ভাগ্যের বিষয়।
মফিদুল হক ।। ট্রাস্টি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর