বঙ্গবন্ধু ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি
অসাম্প্রদায়িকতাই ছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের মূল ভিত্তি। তিনি ছোটবেলা থেকেই অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। স্কুল জীবন থেকেই তিনি বন্ধু-বান্ধবের সাথে যে আচরণ করতেন তা ছিল সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক। নিজে মুসলিম লীগের একজন সদস্য হয়েও অন্য কোনো দলের প্রতি তার বিদ্বেষ ছিল না।
কলকাতায় অধ্যয়নরত অবস্থায় ১৯৪৬ সালে যখন হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়েছিল, তখন তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে দাঙ্গা বিরোধী তৎপরতায় নিয়োজিত ছিলেন এবং হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোককে নিরাপদে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। তাছাড়া তখন শেরে বাংলা, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে যে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি এদেশে গড়ে উঠেছিল তিনি ছিলেন তার একজন সমর্থক।
১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবে ভারত বিভাগের পর স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের যে রূপরেখা কল্পনা করা হয়েছিল সেখানে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে তারা ভারত বিভক্তের সমর্থন করেননি। তাই বঙ্গভঙ্গের আন্দোলনে তারা বিরোধী ছিলেন। যা হোক, পাকিস্তান সৃষ্টির পর বেশ কিছুটা মনোক্ষুণ্ন হয়ে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করেন এবং ঐ স্বাধীনতা যে বাঙালির জন্য নয় তা তিনি তার নিকটজনের কাছে বলা শুরু করেন।
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে প্রবেশ করে মুসলিম লীগের রাজনীতি পরিবর্জনের লক্ষ্যে মুসলিম লীগকে আওয়ামী মুসলিম লীগ ও পরে আওয়ামী লীগে পরিবর্তন করেন। এই পরিবর্তনের লক্ষ্য ছিল মুসলিম লীগকে একটা অসাম্প্রদায়িক দলে পরিণত করা।
বঙ্গবন্ধু মনে করতেন ধর্মভিত্তিক দ্বি-জাতি তত্ত্বের উপর ভারত বিভক্ত হলে সাম্প্রদায়িকতার কারণে পরহিংসা ও পরস্পরের বিরোধ অব্যাহত থাকবে। বাস্তবে তাই সত্য হলো।
১৯৪৭ সালের পর থেকে পাকিস্তান-ভারতে যেসব দাঙ্গা হয়েছে তাতে কয়েক লাখ মানুষ জীবন দিয়েছেন, কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়েছে, চরম অশান্তির সৃষ্টি হয়েছে। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে প্রবেশ করে মুসলিম লীগের রাজনীতি পরিবর্জনের লক্ষ্যে মুসলিম লীগকে আওয়ামী মুসলিম লীগ ও পরে আওয়ামী লীগে পরিবর্তন করেন। এই পরিবর্তনের লক্ষ্য ছিল মুসলিম লীগকে একটা অসাম্প্রদায়িক দলে পরিণত করা।
আওয়ামী লীগের ভেতর প্রগতিশীল চিন্তার লোকদের নিয়ে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে অসাম্প্রদায়িক দল সৃষ্টি করেন।
বঙ্গবন্ধু একজন খাঁটি মুসলমান ছিলেন। ইসলামের প্রতি তার ছিল পরম অনুরাগ। এটা প্রমাণিত হয় বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যেভাবে তিনি ইসলাম ধর্মের উন্নতি সাধন করেন তা দেখে, কিন্তু মুসলমান হলেও তার জাতীয়তাবাদী চেতনা এত প্রখর ছিল, সেখানে সাম্প্রদায়িকতা বা ধর্মের কোনো সংঘাত ছিল না।
তিনি নিজে একজন বাঙালি বলে গৌরবান্বিত ছিলেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা সমৃদ্ধ শেখ মুজিব বাংলার ৪টি প্রধান সম্প্রদায় হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সকলকেই সমদৃষ্টিতে দেখতেন। ধর্মীয় কারণে তার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হয়নি। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অমর্ত্য সেনের ভাষায়, বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িকতা পাশ্চাত্য ধারণার মতো ধর্ম বিবর্জিত ছিল না। প্রত্যেক ধর্মের প্রতি ছিল তার শ্রদ্ধা।
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ধর্ম নিরপেক্ষতা হলো প্রত্যেকের স্ব-স্ব ধর্ম পালন করার অধিকার। রাষ্ট্রের ব্যাপারে ধর্ম কোনো হস্তক্ষেপ করবে না, আর ধর্মের ব্যাপারে রাষ্ট্র থাকবে নির্লিপ্ত। সকলকে তিনি বাঙালি হিসেবে দেখতেন।
বাঙালি সংস্কৃতির ভেতর ছিল তার গভীর অনুরাগ। তিনি প্রত্যেক ধর্মীয় অনুষ্ঠানের প্রতি ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। তার ধারণা ছিল হিন্দুর মন্দির, মুসলমানের মসজিদ, খ্রিষ্টানের গির্জা, বৌদ্ধের প্যাগোডা পাশাপাশি থেকে স্ব-স্ব দায়িত্ব পালন করবে। ধর্মীয় বিরোধের কারণে পরস্পর সংঘাতে লিপ্ত হবে না।
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ধর্ম নিরপেক্ষতা হলো প্রত্যেকের স্ব-স্ব ধর্ম পালন করার অধিকার। রাষ্ট্রের ব্যাপারে ধর্ম কোনো হস্তক্ষেপ করবে না, আর ধর্মের ব্যাপারে রাষ্ট্র থাকবে নির্লিপ্ত।
অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন বলেই তার পক্ষে রাজনৈতিক অঙ্গনে সকল বাঙালিকে একীভূত করা সম্ভব হয়েছিল। সকল বাঙালিকে সাথে নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান তিনি। তাই তার ৬ দফা হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সকলকে ধর্মীয় বিরোধ উপেক্ষা করে এক হতে সাহায্য করে। এ কারণেই ৭০-এর নির্বাচনে এক অবিশ্বাস্য ফল দেখা যায় এবং সেকারণেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রকৃত পটভূমি রচিত হয়।
তিনি স্পষ্টভাবে জানতেন যে, ধর্মীয় বিরোধের কারণেই সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব হয়। তাই ধর্মীয় বিরোধ রোধকল্পে তিনি সংবিধানে ধর্ম নিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় মূল চার নীতির অন্তর্ভুক্ত করেন।
জীবন দর্শনে অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্ম নিরপেক্ষ হওয়ায় বাংলায় সকল জনগণ তার উপর আস্থা স্থাপন করেছিল এবং দেশ স্বাধীন হয়েছিল। অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এরূপ নেতা বিরল। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি তার জীবনের রাজনৈতিক সফলতার মূল কারণ।
তার আমলে বাংলাদেশে ধর্মীয় কারণে রাজনৈতিক বিরোধ না থাকার কথা, কিন্তু প্রতিহিংসাপরায়ণ ধর্মীয় গোষ্ঠীর রাজনীতিতে উপস্থিতির কারণেই আজও সাম্প্রদায়িকতা স্বাধীন বাংলাদেশে উৎখাত করা সম্ভব হয়নি।
বঙ্গবন্ধুর মতো তার কন্যাও অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্ম নিরপেক্ষতা নিয়ে কাজ করছেন। তাই বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্ম নিরপেক্ষতা একদিন স্থান করে নেবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
আসুন, আমরা অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশে সর্বাত্মক সহযোগিতা করি। একজন প্রকৃত বাঙালি কখনোই সাম্প্রদায়িক হতে পারে না।
ডা. এস এ মালেক ।। কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক