ট্রাম্পের অভিবাসন নীতি, শ্রমবাজার ও অভিবাসী বাংলাদেশি

শুধু বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে নয়, উন্নত জীবনের প্রত্যাশায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন সবচেয়ে আকর্ষণীয়। বছরের পর বছর বিভিন্ন দেশ থেকে বৈধ এবং অবৈধ পন্থায় মানুষ পাড়ি জমাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটির সরকার বিভিন্ন সময়ে এই অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে আসলেও এক্ষেত্রে সবচেয়ে কঠোর হচ্ছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
বিজ্ঞাপন
প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম মেয়াদে দায়িত্ব পালনের সময়েও (২০১৭-২১) তিনি কঠোর হয়েছিলেন। তবে যে কারণে বিষয়টি নিয়ে তারা শেষ পর্যন্ত খুব একটা সফল হতে পারেন না তা হচ্ছে নির্বাচনী রাজনীতি।
সদ্য সমাপ্ত মার্কিন নির্বাচনের দিকে তাকালে আমরা দেখব ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মধ্যে অন্যতম ছিল অবৈধ অভিবাসীদের বিতারণ করা, যার জন্য তিনি যথেষ্ট জনসমর্থন পেয়েছেন। আর তাই নির্বাচিত হয়েই তিনি এক্ষেত্রে ধরপাকড় শুরু করেছেন।
বিজ্ঞাপন
ইতিমধ্যে অবৈধ অভিবাসীদের মধ্যে বেশ আতঙ্ক কাজ করছে। অনেককে ধরে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসনের ক্ষেত্রে রয়েছে বিশেষ আকর্ষণ। মধ্যপ্রাচ্য এবং মালয়েশিয়ার বাইরে সবচেয়ে বেশি বৈধ এবং অবৈধ বাংলাদেশির বসবাস হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে।
যতদূর জানা যায়, প্রায় ১২ লাখ বৈধ বাংলাদেশি বসবাস করছে সেখানে যার মধ্যে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি ভোটারের সংখ্যা ৬ লাখ ৩০ হাজারের ওপরে। এর বাইরে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ অবৈধ অভিবাসী সেখানে বসবাস করছে। এসব অভিবাসীরা অনেকে ডিভি লটারি, পারিবারিক কোটা, বিশেষ ক্যাটাগরি, বিনিয়োগ এবং আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী কোটায় বৈধ হলেও একটা বড় সংখ্যা অবৈধভাবে গিয়ে পরবর্তীতে নানা প্রক্রিয়ায় বৈধতা লাভ করেছেন।
বিজ্ঞাপন
এখন ট্রাম্পের এই ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতি আর কঠোর হতে যাচ্ছে এবং সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপের পাশাপাশি একমাত্র বৈধ পন্থা ছাড়া অপরাপর দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানো কঠিন হয়ে পড়বে। সেই সাথে এটাও স্বীকার করতে হবে যে আইনত কোনো দেশই অবৈধ পন্থায় নিজের দেশের নাগরিকদের অপরাপর দেশে বাস করাকে সমর্থন করতে পারে না।
বৈদেশিক মুদ্রার জোগান বাড়াতে সব দেশই, বিশেষত দরিদ্র এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো চায় তাদের দেশ থেকে অধিক হারে মানুষ বিদেশে পাড়ি দিক এবং দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখুক। এমন অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতি অনেক দেশের জন্যই একটি বার্তা এই অর্থে যে তাদের নিজ দেশের নাগরিকদের আরও প্রশিক্ষিত করার প্রয়োজন রয়েছে।
আমরা সবাই জানি, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার সবচেয়ে বড় সংস্থান আসে তৈরি পোশাক রপ্তানির আয় থেকে, যেখানে প্রায় ৭০ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে আমরা রপ্তানি বাণিজ্যের দিক থেকে চোখ ফেরালে দেখতে পাবো যে এক্ষেত্রে বাস্তবে সবচেয়ে বড় অবদান রাখছে বিদেশে অবস্থানরত আমাদের মানুষ, যার সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি।
...ট্রাম্পের এই ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতি আর কঠোর হতে যাচ্ছে এবং সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপের পাশাপাশি একমাত্র বৈধ পন্থা ছাড়া অপরাপর দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানো কঠিন হয়ে পড়বে।
মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, আরব আমিরাত, ওমান এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মালয়েশিয়া—এই চারটি দেশে অবস্থানরত কর্মীর সংখ্যা যোগ করলেই তা ১ কোটি অতিক্রম করে। সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় আগের তুলনায় আমাদের শ্রমিক রপ্তানির হার অনেক কমে গেছে। তাছাড়া যারা কাজ করছেন তাদের বেশিরভাগই প্রত্যাশিত আয় করতে পারছেন না।
এর মূল কারণ দক্ষ শ্রমিকের তুলনায় আধাদক্ষ এবং অদক্ষ শ্রমিক প্রেরণের হার অনেক বেশি। এর বাইরে রয়েছে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর দৌরাত্ম্য। সরকারিভাবে মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক নিয়োগে শ্রমিকপ্রতি ৭৮ হাজার ৯শ ৯০ টাকা নির্ধারণ করা হলেও বাস্তবে ৪ থেকে ৭ লাখ টাকা ব্যয়ে শ্রমিকদের বিদেশে পাড়ি দিতে হচ্ছে।
একজন শ্রমিক প্রাথমিকভাবে ২ বছর বা ৩ বছর বিদেশে থেকে যে পরিমাণ অর্থ আয় করেন, এতে তার খরচের অর্থই উঠে আসে না, উপরন্তু ওয়ার্ক পারমিট নবায়ন না করার ফলে নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে শ্রমিকদের দেশে ফিরে আসতে হচ্ছে, যা তাদের জীবনকে আর দুর্বিষহ করে তুলছে।
আরও পড়ুন
আরও উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে স্বাধীনতার পর মধ্যপ্রাচ্য এবং মালয়েশিয়ার বাইরে আমরা নতুন কোনো শ্রমের বাজার তৈরি করতে পারিনি। যেকোনো উন্নয়নশীল দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অন্যতম চাবিকাঠি হচ্ছে জনশক্তি রপ্তানি। আর এক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশ যেখানে সীমিত সম্পদ এবং সীমাহীন চাহিদার কারণে জনসংখ্যাকে উন্নয়নের পথে বড় অন্তরায় হিসেবে বিবেচনা করা হয় সেখানে এই বিশাল জনসংখ্যার একটা অংশকে বাইরে রপ্তানি করতে পারলে একদিকে যেমন ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় জীবনে স্বস্তি ফিরে আসবে, অন্যদিকে একধরনের পারস্পরিক নির্ভরশীলতার কারণে আমাদের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও যোগ হতে পারে ইতিবাচক ভাবমূর্তি। তবে এই জনসংখ্যাকে রপ্তানি করার পূর্বে এদের জনশক্তিতে রূপান্তর করা জরুরি।
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত জনশক্তির বড় অংশ অবৈধভাবে বসবাস করছেন, যারা নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য বিদেশমুখী হলেও প্রতি মুহূর্তে আতঙ্কের মধ্যে জীবন কাটাচ্ছেন। অথচ কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্কসহ উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দক্ষ জনশক্তির বিপুল চাহিদা রয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়াতে জনশক্তি রপ্তানিতে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে পাকিস্তান, ভারত এবং শ্রীলঙ্কা। এই দেশগুলো থেকে প্রেরিত জনশক্তি বাংলাদেশ থেকে প্রেরিত জনশক্তির তুলনায় বেশি দক্ষ হওয়ায় বিদেশের বাজারে তাদের চাহিদাও বাংলাদেশি শ্রমিকদের তুলনায় বেশি যার কারণে বিদেশে তাদের চাহিদাও বেশি।
উপরোক্ত বিষয়ের বিশ্লেষণে এ কথাই স্পষ্ট হয় যে জনশক্তি রপ্তানির মন্দাবস্থার জন্য কোনো বিশেষ দেশ বা অঞ্চলের অস্থিরতার যে যুক্তি দাঁড় করানো হচ্ছে এর বাস্তব ভিত্তি থাকলেও তা বেশ দুর্বল। যে কথাটি সবলভাবে উপলব্ধি করা প্রয়োজন তা হচ্ছে আমরা কি সত্যই আমাদের প্রেরিত জনশক্তির দক্ষতা নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী হতে পারি?
আমাদের নিজের দেশে যখন কোনো কাজে কর্মী নিয়োগের সময় তার দক্ষতা, পেশাদারিত্ব তথা কাজটি কতটা সফলভাবে পরিচালিত হবে সেই ব্যাপারে আপসহীন থাকি সেক্ষেত্রে আমরা কীভাবে আশা করতে পারি আমাদের অদক্ষ লোকজনদের বিদেশে পাঠিয়ে দিলেই আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পাবে? এই বাস্তব অবস্থার উপলব্ধি করে আমাদের কতিপয় বিষয়ের প্রতি গভীর মনোযোগ দেওয়া জরুরি।
বৈদেশিক মুদ্রার জোগান বাড়াতে সব দেশই, বিশেষত দরিদ্র এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো চায় তাদের দেশ থেকে অধিক হারে মানুষ বিদেশে পাড়ি দিক এবং দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখুক।
১। বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে বোঝা হিসেবে বিবেচনা করার সেকেলে মানসিকতা থেকে মুক্ত হয়ে জনশক্তি হিসেবে বিবেচনা করতে হবে, আর এই জনশক্তি তখনই সত্যিকার জনশক্তিতে রূপান্তরিত হবে যখন তাদের ন্যূনতম শিক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত করা যাবে।
২। সরকারের সাথে সরকারের চুক্তির মাধ্যমে বৈধ পন্থায় জনশক্তি প্রেরণের যে উদ্যোগ বর্তমান সরকার হাতে নিয়েছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। এর মাধ্যমে যদিও অনেক কম খরচে জনশক্তি বিদেশে প্রেরণ করা সম্ভব কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এই সংখ্যাটা সন্তোষজনক নয়।
অন্যদিকে এ নিয়ে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সাথে সরকারের দ্বন্দ্বের কারণে এজেন্সিগুলোর মাধ্যমে জনশক্তি প্রেরণ অনেক কমে গেছে। এ নিয়ে সরকারের সাথে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সুসমন্বয়ের মাধ্যমে কীভাবে অধিক সংখ্যক জনশক্তি প্রেরণ করা যায় এই বিষয় নিয়ে সরকারের অগ্রসর হওয়া উচিত।
৩। বাংলাদেশের জনশক্তি প্রেরণের প্রধান গন্তব্য মধ্যপ্রাচ্য—এই মানসিকতা পাল্টে অন্যান্য উন্নত দেশ তথা পশ্চিমা দেশগুলোয় নতুন বাজারের সন্ধান করা অতি আবশ্যক। তথাকথিত আরব বসন্তের যে দোলা মধ্যপ্রাচ্যে লেগেছে যদি তা অব্যাহত থাকে তবে তা আমাদের জন্য খুব একটা হিতকর হবে না।
৪। সরকারের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোকে তাদের নামের প্রতি সুবিচার করে বেকার যুবসমাজের প্রতি বিশেষ মনযোগী হয়ে দেশের সবকটি জেলায় পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের তৈরি করা। সেজন্য এক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দকে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করলে এর প্রতিফল আসবে অনেক বেশি।
৫। উন্নয়নকে তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়ার সরকারের অঙ্গীকার সফল করতে গ্রামীণ বেকার জনগোষ্ঠীর প্রতি বিশেষ মনযোগী হওয়া প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে গ্রাম থেকে যারা বিদেশে যাবে তাদের প্রেরিত অর্থ গ্রামেই ফেরত আসবে এবং এতে করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সরকারের প্রচেষ্টার সাথে তা পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে।
উপরোক্ত অবস্থার আলোকে সরকারের নীতি নির্ধারকদের এখন ভাবার সময় এসেছে জনশক্তি রপ্তানির এই প্রক্রিয়া অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি করা ছাড়া আমাদের উন্নয়ন সম্ভব নয় কারণ উন্নত জনশক্তি উন্নয়নের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।
ড. ফরিদুল আলম ।। অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়