উন্নয়নের স্বার্থে হোক নীতি প্রণয়ন

সাত কলেজের জন্ম ইতিহাস হচ্ছে ব্যক্তি দ্বন্দ্ব। এটি একটি সরকারি নীতির বলিদানের উদাহরণও বটে। সরকারি নীতি কীভাবে গ্রহণ করা হয় সে বিষয়ে বিস্তারিত বলার জায়গা এখানে নয়। দুই দশকের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে (যদিও নীতি নির্ধারকদের ইচ্ছাই প্রাধান্য পায়), সার্বিক পরিস্থিতির প্রয়োজনে এবং অনেক সময় দাবি-দাওয়া বা আন্দোলনের চাপে ‘সরকারি নীতি’ গ্রহণ করা হয়। ‘সাত কলেজ’ সৃষ্টির পেছনের এর কোনোটিই ছিল না। ছিল শুধু ব্যক্তি দ্বন্দ্ব। দেশের উন্নয়নের স্বার্থেই নীতি গ্রহণ করা উচিত। তাহলেই দেশ উন্নতির দিকে এগিয়ে যাবে।
আমরা সবাই জানি, সাত কলেজ সৃষ্টির সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসির (অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক) সাথে তার রানিংমেট অর্থাৎ যিনি প্রো-ভিসি (প্রফেসর ড. হারুন অর রশিদ) ছিলেন, তার সাথে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব। সেই প্রো-ভিসিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরিয়ে দিতে সেই ভিসি সক্ষম হয়েছিলেন। আবার সেই প্রো-ভিসি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হয়ে আরও ক্ষমতাবান (!) হয়ে উঠলেন। শুরু হলো ‘ইগো’ সমস্যা।
এক বনে দুই বাঘ থাকতে নেই। যেই ইচ্ছা সেই কাজ। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ও পুরাতন সাত কলেজকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে আনা হলো। সেই সময়ের শিক্ষামন্ত্রীর ভূমিকাও এখানে বিবেচ্য। সেই সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হলো। কারও ক্ষমতা বাড়লো, আবার কারও ক্ষমতা কমলো। এর সাথে আরও একটি কাজ হলো। রথও দেখা হলো, কলাও বেচা হলো। তা হলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতি এক ধরনের ‘হেয় মনোভাব’ পোষণ করা অর্থাৎ বিএনপি সরকারের আমলে গঠিত প্রতিষ্ঠান ‘বন্ধ’ বা ‘অপ্রয়োজন’ ছিল বলে প্রমাণ করা।
যাই হোক, আমরা দেখেছি এবং জানি যে, ১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে সারাদেশের কলেজগুলো বিভাগীয় শহরে বিদ্যমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অধীনে পরিচালিত হতো। যেমন ঢাকা ও বরিশাল বিভাগের কলেজগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। রাজশাহী বিভাগের কলেজগুলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। ঠিক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধীনে ছিল সেই বিভাগের কলেজগুলো। বিএনপি সরকার কেন আলাদাভাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গঠন করলো? কেন এই নীতি গ্রহণ করেছিল? সরকারি নীতি গ্রহণে ওপরে বর্ণিত কারণ বা ফর্মুলাগুলো বিবেচনায় নিয়ে প্রিয় পাঠক আপনারাই এই ব্যাখ্যা করুন।
এরপর আসি অন্য কথায়। সরকারি নীতি বাস্তবায়নে প্রাতিষ্ঠানিক, প্রশাসনিক ও ব্যক্তিগত (ওই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তির) দক্ষতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় এবং পরবর্তীতে এসব বিষয়ে উন্নতি নিয়ে খুব বেশি কাজ হয়েছে এমন উল্লেখযোগ্য কিছু জানা যায় না।
কম বেশি প্রায় দুই হাজারের বেশি কলেজের অভিভাবক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। তবে ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়’ সেশন জট এবং অনিয়মের ‘সমার্থক’ হিসেবে বারবার মিডিয়ার শিরোনাম হয়েছে। অন্যদিকে, বাড়তি সাত কলেজকে সার্বিকভাবে পরিচালনা করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই কি সেই প্রাতিষ্ঠানিক ও কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা-সক্ষমতা ছিল? সেই প্রশ্ন তো প্রথম থেকেই ছিল। তার ফলাফল তো আমরা দেখতেই পেলাম।
আবার ফিরে যাই আসল কথায়। ব্যক্তি দ্বন্দ্বে। চব্বিশের ছাত্র-জনতার সফল জুলাই বিপ্লবে পতিত আওয়ামী সরকারের সর্বশেষ শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। আর সেই পতিত সরকারের পতনের সাথে সাথে গা ঢাকা দেওয়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ ভিসি ছিলেন প্রফেসর মশিউর রহমান। এই দুই জনের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের কারণে আবারও বলি হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরের ঘটনা। শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরও ৯টি বড় কলেজকে বের করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। রাজশাহী বিভাগের চারটি কলেজকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আর চট্টগ্রাম বিভাগের পাঁচটি কলেজকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
আমরা ভেতরের খবর জানি। শিক্ষার সাথে জড়িত সম্ভবত সবাই জানে। এটি করা হয় শিক্ষামন্ত্রীর আর সেই সময়ের ভিসি’র দ্বন্দ্বের কারণে। ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের কারণে একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর কত বড় আঘাত। ভাবা যায়! এটি মেনে নেওয়ার মতো বিষয়?
আপনারাই বলুন, এই নীতি গ্রহণের জন্য ওপরে বর্ণিত কোন কোন ফর্মুলা অনুসরণ করা হয়েছে, তা আপনারাই বিচার-বিশ্লেষণ করুন। আবারও বলি, প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত পেশাগত দক্ষতা ছাড়া কোনো নীতি সফলভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। নীতির সুফল দেশ ও দেশের জনগণ পায় না। ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব আর স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক চিন্তা দেশের নীতি নির্ধারণে প্রাধান্য পেলে দেশ উন্নতি দিকে এগিয়ে যেতে পারবে না।
আরও পড়ুন
আসল কথায় আসি। সাত কলেজ এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত থেকে মুক্ত। সরকারিভাবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছেন। সাত কলেজ আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকবে না। কয়েক বছরের আন্দোলনে সফল হলো অরাজনৈতিক সরকারের নিয়োগ প্রাপ্ত একজন দক্ষ ভিসি প্রফেসর ড. নিয়াজ আহমেদ খানের হাত ধরে। তিনি ধন্যবাদ পাওয়ার উপযুক্ত বিষ ফোঁড়া’র সার্জারি দলের সফল নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য। আমরা দেখতে পেলাম, সরকার এই নীতি গ্রহণ করল ওপরে বর্ণিত একটি ফর্মুলার প্রয়োগ থেকে। আন্দোলন বা দাবি দাওয়া ফর্মুলা। তবে, আমাদের অভিজ্ঞতা হলো, দাবির প্রেক্ষিতে গৃহীত নীতি টেকসই হয় না।
আরেকটি কথা না বললেই নয়। তাহলো, যাদের অপরিণামদর্শী পদক্ষেপের কারণে এবং ব্যক্তি দ্বন্দ্বের কারণে আজকে লাখো শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠলো তাদের ব্যাপারে আন্দোলনকারীদের মাঝ থেকে কোনো আওয়াজ নেই। কেন? শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের দায়ে তাদেরও তো কাঠগড়ায় দাঁড়ানো উচিত। তাদের অবশ্যই জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত। আন্দোলনকারীদের এই দাবিও করতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
যাই হোক, এই সাত কলেজ কি আবার এক সাথে থাকবে নাকি আলাদা থাকবে? ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের বলি সাত কলেজ প্রকৃতপক্ষে ‘কলঙ্ক মুক্ত’ হবে নাকি আবার আরেকটি নতুন কোনো ‘আন্দোলন’র বীজ বপন করবে। ‘তিতুমীর’ আন্দোলন কী সেই ‘বীজ’? আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, তিতুমীর কলেজকে এখনই বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করার দাবির পেছনে ষড়যন্ত্র কাজ করছে। ঘোষণা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় হয় না আমার বিশ্বাস আন্দোলনকারীরাও তা জানে। এর পেছনে কিছু আছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বর্তমান সরকারকে বেকায়দায় ফেলা, দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করা, এই সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করার চেষ্টা এসব আন্দোলনের মূল লক্ষ্য।
ঢাকা কলেজ কী তার দু’বছরের ঐতিহ্য নিমিষেই মিলিয়ে দিয়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয় হবে? হওয়া উচিত নয়। এ রকম ‘মামা বাড়ি’র আবদার বন্ধ হওয়া উচিত। আন্দোলনকারীরা যদি দেশপ্রেমিক হন এবং চব্বিশের জুলাই বিপ্লবের ‘স্পিরিট’ ধারণ করেন, তাহলে এমন আবদার নিয়ে আর আন্দোলন করবেন না। এটাই প্রত্যাশা।
দেশ ধ্বংসের ষড়যন্ত্রের এসব ‘বীজ’ বপন হোক, আমরা আর তা চাই না। সাত কলেজ স্বাভাবিকভাবে চলুক এটি প্রত্যাশা, তা একই অভিভাবকের অধীনে হোক কিংবা স্বতন্ত্র অভিভাবকের অধীনে হোক। নীতি নির্ধারকদের বলবো, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করুন। দূরদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন। বিশেষজ্ঞদের সাথে নিয়ে বসুন। কারণ, বহুল প্রচলিত চাইনিজ একটি প্রবাদ আছে, ‘তুমি যদি হাজার বছরের পরিকল্পনা করো, তাহলে মানুষ তৈরি করো। আর যদি দশ বছরের পরিকল্পনা করো, তাহলে গাছ লাগাও। আর যদি এক বছরের পরিকল্পনা করো, তাহলে শস্য রোপণ করো।’
আমরা হাজার বছরের পরিকল্পনা চাই। এজন্য গুণগত ও সুশিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষা নিয়ে সব দল রাজনীতি করেছে। শিক্ষার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় আর মেডিকেল কলেজ স্থাপন করে শিক্ষার কফিনে পেরেক ঠুকিয়ে দিয়েছে।
হাজারও শহীদের জীবনের বিনিময়ে সফল জুলাই বিপ্লবের বর্তমান এই অরাজনৈতিক সরকারের কাছেও শিক্ষা অগ্রাধিকার পায়নি। ১৬টি সংস্কার কমিশন ও কমিটি গঠন হলো, কিন্তু শিক্ষা নিয়ে কোনো কমিশন গঠন করা হলো না। উপদেষ্টারাও তথাকথিত রাজনৈতিক কথার মধ্যেই আটকে আছেন। তাই আমাদের দাবি রাষ্ট্রের প্রয়োজনে শিক্ষা নিয়ে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত।
এতে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত থাকা উচিত। ভবিষ্যতে যে দলই ক্ষমতায় আসুক শিক্ষা নিয়ে গৃহীত পরিকল্পনা এগিয়ে নেবেন সেই প্রতিশ্রুতি তাদের দিতে হবে। ‘মামা বাড়ির আবদার’ মার্কা দাবি থেকে সরে এসে দেশকে এগিয়ে নিতে সবাইকে জুলাই বিপ্লবের ‘স্পিরিট’ ধারণ করে ঐক্যবদ্ধভাবে নিজ নিজ জায়গা থেকে কাজ করতে হবে।
সবশেষে বলতে চাই, শিক্ষাখাতে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি দূর করার এখনই সময়। এজন্য প্রয়োজনীয় দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য বর্তমান সরকারকে আহ্বান জানাচ্ছি। দেশ এগিয়ে যাক শান্তি, সমৃদ্ধি আর উন্নতির দিকে এই প্রত্যাশা আমাদের সবার।
ড. শাফিউল ইসলাম ।। অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়