ডিজিটাল ফাইন্যান্সিং ও বাংলাদেশ : এখনো অনেক পথ বাকি

ডিজিটাল ফাইন্যান্সিং (Digital Financing) হলো প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক অর্থায়ন পদ্ধতি। এটি ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, এটিএম কার্ড এবং অন্যান্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আর্থিক সেবা প্রদানে সক্ষম। তবে, ডিজিটাল ফাইন্যান্সিং কী—এই প্রশ্নের চেয়ে আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো এর ব্যাপ্তি কতটা বিস্তৃত। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশে এর ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং প্রতিনিয়তই এর পরিসর আরও সম্প্রসারিত হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
ডিজিটাল ফাইন্যান্সিংয়ের মূল ভিত্তি হলো ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম, যেখানে মোবাইল পেমেন্ট, ই-ওয়ালেট, কিউআর কোড পেমেন্ট এবং আধুনিক পয়েন্ট-অফ-সেলস (POS) সিস্টেমের মতো প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত। অ্যাপল পে, গুগল পে, পেপ্যাল, বিকাশ, নগদের মতো প্ল্যাটফর্ম নগদ লেনদেনের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে, দ্রুত ও সহজ লেনদেনের সুযোগ তৈরি করেছে। বর্তমানে, এসব প্ল্যাটফর্ম বৈশ্বিক লেনদেনের প্রায় ৩৬ ট্রিলিয়ন ডলার পরিচালনা করে। গ্লোবাল পেমেন্ট রিপোর্ট অনুযায়ী, ই-কমার্স ভিত্তিক লেনদেন ইতিমধ্যে বৈশ্বিক লেনদেনের প্রায় অর্ধেক দখল করে নিয়েছে।
অনলাইন ব্যাংকিং বিশ্বব্যাপী আর্থিক সেবায় এক বিশাল পরিবর্তন এনেছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা এখন সহজেই অ্যাকাউন্ট পরিচালনা, অর্থ স্থানান্তর এবং বিল পেমেন্ট করতে পারছেন। মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাপ্লিকেশন এসব সেবা ব্যবহারকারীদের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে, যা আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে আরও ত্বরান্বিত করেছে।
বিজ্ঞাপন
একইভাবে, ডিজিটাল ঋণদান ব্যবস্থা ঋণগ্রহীতা ও ঋণদাতাদের জন্য নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে। পিয়ার-টু-পিয়ার (P2P) ল্যান্ডিং প্ল্যাটফর্ম, যেমন ল্যান্ডিংক্লাব এবং প্রস্পার, তাৎক্ষণিক ঋণের অ্যাপ এবং ‘বাই নাউ, পে লেটার’ পরিষেবা আর্থিক চাহিদা পূরণে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, মোবাইল ব্যাংকিং সেবার জনপ্রিয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। বর্তমানে দেশে মোবাইল ব্যাংকিং গ্রাহকের সংখ্যা ৯ কোটি ২৫ লাখ ছাড়িয়েছে।
বিজ্ঞাপন
ডিজিটাল ঋণের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের সম্ভাবনা উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশ ব্যাংক ডিজিটাল ক্ষুদ্র ঋণের জন্য প্রথমে ১০০ কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করে, যা পরবর্তীতে ৫০০ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। এই তহবিল থেকে ব্যাংকগুলো ডিজিটাল পদ্ধতিতে গ্রাহকদের ঋণ দিয়ে আসছে। বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই তহবিলের প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ব্যবহৃত হয়েছে, যার মাধ্যমে মোট ৬৮৬ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে (সূত্র: প্রথম আলো)।
ডিজিটাল পেমেন্ট এবং মোবাইল ব্যাংকিং বাংলাদেশে জনপ্রিয়তা পেলেও ক্রাউডফান্ডিং প্ল্যাটফর্ম এখনো ততটা পরিচিত হয়ে ওঠেনি। বিশ্বব্যাপী কিকস্টার্টার এবং গোফান্ডমি-এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো অসংখ্য মানুষের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহের সুযোগ করে দিচ্ছে।
অন্যদিকে, ক্রিপ্টোকারেন্সি এবং ব্লকচেইন প্রযুক্তি ডিজিটাল অর্থায়নে বিকেন্দ্রীভূত অর্থায়নের (DeFi) ধারণা চালু করেছে। এই ব্যবস্থায় মধ্যস্থতাকারী ছাড়াই ঋণদান, ঋণগ্রহণ এবং লেনদেন করা সম্ভব। বাইন্যান্স এবং কয়েনবেস-এর মতো ক্রিপ্টোকারেন্সি ট্রেডিং প্ল্যাটফর্মগুলো টোকেনাইজড সম্পদের মাধ্যমে বিনিয়োগের নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
ডিজিটাল ফাইন্যান্সিংয়ের মূল ভিত্তি হলো ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম, যেখানে মোবাইল পেমেন্ট, ই-ওয়ালেট, কিউআর কোড পেমেন্ট এবং আধুনিক পয়েন্ট-অফ-সেলস সিস্টেমের মতো প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত।
বাংলাদেশে, ক্রিপ্টোকারেন্সি এখনো আইনগত বৈধতা পায়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রিপ্টোকারেন্সির লেনদেনকে এখনো স্বীকৃতি দেয়নি এবং এ নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালাও প্রণয়ন করেনি। ফলে, ক্রিপ্টোকারেন্সি কেনা, বেচা বা এর মাধ্যমে কোনো লেনদেন করা আইনত নিষিদ্ধ।
তবে, এর মানে এই নয় যে ক্রিপ্টোকারেন্সি বাংলাদেশে সম্পূর্ণ অপরিচিত। দেশের মানুষ অনেকেই তৃতীয় পক্ষের মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন এবং বিভিন্ন ওয়েবসাইট ব্যবহার করে ঝুঁকিপূর্ণ উপায়ে ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেনে যুক্ত হচ্ছেন। আইনগত বৈধতা না থাকা সত্ত্বেও, বাংলাদেশে ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে।
Chainalysis-এর একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ক্রিপ্টোকারেন্সি গ্রহণে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ৩৫তম। যদিও এ খাতে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে, তবে উপযুক্ত নীতিমালা এবং আইনগত বৈধতার অভাবে বাংলাদেশ এই প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সুফল পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছে না।
বাংলাদেশে ক্রিপ্টোকারেন্সি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পেলেও এটি এখনো সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক-এর কঠোর নজরদারিতে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রিপ্টোকারেন্সিকে কোনো দেশের বৈধ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ইস্যু করা মুদ্রা হিসেবে গণ্য করে না এবং এটিকে কোনো স্বীকৃত আর্থিক দাবি হিসেবে মান্যতা দেয় না।
আরও পড়ুন
২০১৭ সালেই বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেন না করার জন্য একটি সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল। তাদের মতে, এটি সরাসরি অপরাধ না হলেও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, ক্রিপ্টোকারেন্সি মালিকানা, সংরক্ষণ বা লেনদেন অপরাধের মধ্যে পড়ে না। তবে, এর মাধ্যমে মানি লন্ডারিং, সন্ত্রাসে অর্থায়ন বা অন্য কোনো অবৈধ কার্যক্রম সংঘটিত হলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিমা খাতেও ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রভাব দৃশ্যমান, যা বর্তমানে ইনশিওরটেক (InsurTech) নামে পরিচিত। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এবং এআই-চালিত টুল ব্যবহার করে বিমা কেনা, পরিচালনা এবং ক্লেইম প্রক্রিয়া এখন আরও সহজতর হয়েছে। এর ফলে, বিমা সেবা আরও সহজলভ্য ও ব্যক্তিগতকৃত হয়েছে।
অন্যদিকে, সম্পদ এবং বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনায় রোবো-অ্যাডভাইজর যেমন বেটারমেন্ট এবং ওয়েলথফ্রন্ট স্বয়ংক্রিয় পোর্টফোলিও ব্যবস্থাপনার সুবিধা দিচ্ছে। রিটেইল ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম যেমন রবিনহুড এবং ইটোরো বিনিয়োগের সুযোগগুলো সাধারণ মানুষের কাছে সহজলভ্য করেছে। পাশাপাশি, বিশেষায়িত টুলের মাধ্যমে ক্রিপ্টো সম্পদের ব্যবস্থাপনা আরও সহজ হয়েছে।
বাংলাদেশে ডিজিটাল ফাইন্যান্সিং এখনো মূলত বিকাশ, রকেট এবং নগদ-এর মতো মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বাংলাদেশ থেকে সরাসরি ডলারে পণ্য ও সেবা ক্রয় এবং এর মূল্য পরিশোধ এখনো সহজসাধ্য নয়। এ ধরনের লেনদেনের জন্য পূর্ব প্রস্তুতি এবং অনুমোদন প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ, পেপ্যাল, অ্যাপল পে এবং গুগল পে-এর মতো গ্লোবাল পেমেন্ট সার্ভিস এখনো বাংলাদেশের নাগালের বাইরে। এমনকি আমাজন বা আলিবাবা থেকে তৃতীয় পক্ষের সাহায্য ছাড়া সরাসরি পণ্য কেনাও বেশ জটিল।
এ অবস্থায় বিমা এবং ট্যাক্সেশন পরিষেবা রাতারাতি প্রসার লাভ করবে এমন আশা করা অবাস্তব। অথচ, বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল অ্যাকাউন্টিং এবং ট্যাক্সেশন টুল যেমন কুইকবুকস (QuickBooks) এবং টার্বোট্যাক্স (TurboTax) ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের আর্থিক হিসাব রাখা এবং ট্যাক্স ফাইলিংকে অত্যন্ত সহজ করেছে।
অনলাইন ব্যাংকিং বিশ্বব্যাপী আর্থিক সেবায় এক বিশাল পরিবর্তন এনেছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা এখন সহজেই অ্যাকাউন্ট পরিচালনা, অর্থ স্থানান্তর এবং বিল পেমেন্ট করতে পারছেন।
সরবরাহ শৃঙ্খলা অর্থায়নও ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে নতুন মাত্রা পেয়েছে। উদ্ভাবনী সমাধানগুলো, বিশেষ করে ইনভয়েস ফাইন্যান্সিং, ব্যবসার নগদ প্রবাহ উন্নত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আন্তর্জাতিক লেনদেনে ক্রস-বর্ডার পেমেন্ট পরিষেবা যেমন ওয়াইজ (Wise), রেভোলুট (Revolut) এবং পেওনিয়ার (Payoneer), অর্থ স্থানান্তরকে আরও সহজ, দ্রুত এবং খরচ-সাশ্রয়ী করেছে।
আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ডিজিটাল ফাইন্যান্সিংয়ের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য, যেখানে ব্যাংকবহির্ভূত এবং সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে আর্থিক ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করার প্রচেষ্টা চালানো হয়। তবে বাংলাদেশে ডিজিটাল ফাইন্যান্সিং এখনো কাঙ্ক্ষিত পূর্ণতা অর্জন করেনি। দেশের মাইক্রো ট্রানজেকশন সক্ষম ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো এখনো যথাযথভাবে স্থানীয় পর্যায়ে প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি। খুচরা দোকান ও সেবা প্রদানকারী সংগঠনগুলো কিউআর কোড ভিত্তিক পেমেন্ট পদ্ধতির প্রতি আগ্রহী নয়, যার একটি বড় কারণ হলো ক্যাশ ইন এবং ক্যাশ আউটের জন্য পর্যাপ্ত নগদের সংকট।
বর্তমানে বিকাশ, রকেট, নগদ এবং উপায়-এর মতো মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে মাত্র এক-দুটি প্ল্যাটফর্মই কিছুটা পর্যাপ্ত অর্থ সরবরাহ করতে সক্ষম। ফলে ডিজিটাল ফাইন্যান্সিংয়ের মূল লক্ষ্য আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা হলেও এই খাত এখনো উল্লেখযোগ্যভাবে পিছিয়ে রয়েছে। দেশের জনসংখ্যার একটি বৃহৎ অংশকে ডিজিটাল সেবার আওতায় আনতে হলে সচেতনতা বৃদ্ধি, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং বিভিন্ন সেবার অন্তর্ভুক্তি জরুরি।
বাংলাদেশের ডিজিটাল ফাইন্যান্সিং খাতের উন্নয়নের জন্য কার্যকর নীতিমালা এবং সহযোগিতামূলক উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। সঠিক পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে এটি দেশের অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এই খাতের পূর্ণতা অর্জন করতে হলে আমাদের এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।
ড. এ কে এম মাহমুদুল হক ।। অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়