পিএসসি’র সদস্য নিয়োগ : কোন পথে প্রশাসন?
চব্বিশের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের ফসল বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখন দেশ চালাচ্ছে। এই গণঅভ্যুত্থানের শুরুটা কিন্তু হয়েছিল ‘কোটা বিরোধী’ আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই। আর কোটার হিসাব মেলে পিএসসি’র নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে।
ফলে লাখো চাকরি প্রার্থী ও শিক্ষার্থীরা এই কোটা বৈষম্যের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে। এই আন্দোলনই গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। পতন হয় দীর্ঘ দেড় দশক গণতন্ত্রের নামে দেশে চলা স্বৈরশাসনের।
হাজারও শহীদের জীবনের বিনিময়ে চব্বিশের জুলাই বিপ্লবে পাওয়া নতুন বাংলাদেশ গঠনে জাতির আকাঙ্ক্ষা তাই আকাশচুম্বী। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেবে এটাই সবার প্রত্যাশা। কিন্তু এখন প্রশ্ন উঠছে নানা বিষয় নিয়ে।
উপদেষ্টা নিয়োগ থেকে শুরু করে জনপ্রশাসনে বিভিন্ন পদে নিয়োগ-পদায়নে সব জায়গাতেই বিতর্ক আর বিতর্ক। প্রশ্ন উঠছে-কোন পথে হাঁটছে প্রশাসন? তবে এই লেখা আজ শুধু পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে নিয়েই থাকবে।
পাবলিক সার্ভিস কমিশন বা পিএসপি বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মী নিয়োগের জন্য উপযুক্ত ও যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি নির্বাচন করা জন্য পরীক্ষা গ্রহণ করে। তবে বিসিএস পরীক্ষাই প্রধানত আলোচিত বিষয়। এই বিসিএসের নিয়োগে ‘কোটা’ বৈষম্য দূর করার আন্দোলনের ফসল আজকের নতুন বাংলাদেশ।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, নতুন বাংলাদেশ গঠনের এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। কেননা পতিত বিগত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার দেশের সব খাতকে ধ্বংস করে গেছে। তাই সব জায়গায় সংস্কার দরকার।
দেশের আপামর জনসাধারণ ও দলমত নির্বিশেষে সবাই সংস্কার চাইছে। দেশকে যারা ধ্বংসের দিকে ধাবিত করেছে, সহযোগী হিসেবে কাজ করছে তারা এই সংস্কার প্রক্রিয়ার বাইরে থাকবে এটাই এখন স্বাভাবিক।
আরও পড়ুন
যাই হোক, ৫ আগস্ট ২০২৪ গণঅভ্যুত্থানের প্রায় দুই মাস পর ৮ অক্টোবর পুরোনো পিএসসি’র ফুল কমিশন পদত্যাগ করলে সংস্কারের অংশ হিসেবে ৯ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে সরকার পিএসসি’তে প্রথম দফায় নতুন চেয়ারম্যান ও চারজন সদস্য নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করে।
১৫ অক্টোবর চেয়ারম্যানসহ চার সদস্য শপথ গ্রহণ করে পিএসসি’তে যোগদান করেন। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো কমিশন তখনো গঠিত হয়নি। কারণ ৬ সদস্যের কমে পিএসসি কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না।
দ্বিতীয় দফায় ৩১ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে আরও পাঁচজনকে নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করলো সরকার। নভেম্বরের ৬ তারিখে চারজন সদস্য শপথ নিলেন। একজন সদস্য শপথ গ্রহণ করেননি। শপথ না নেওয়া সেই সদস্যকে নিয়ে ‘আলোচনা’ ছিল।
তিনি নাকি ফ্যাসিবাদী সরকারের একজন এমপি’র আত্মীয় ছিলেন। কিন্তু তেমন প্রতিবাদের ঝড় ওঠেনি। যাই হোক, চেয়ারম্যানসহ পিএসসি ৯ সদস্যের কমিশন গঠিত হলো। এবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যাবে।
চাকরি প্রার্থীদের মনের কথা বুঝলেন প্রফেসর ড. মোবাশ্বের মোনেমের নেতৃত্বাধীন কমিশন। এই কমিশন কিছু যুগান্তকারী সিদ্ধান্তও গ্রহণ করলেন। ভাইভার ২০০ নম্বর থেকে কমিয়ে ১০০ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। চাকরি আবেদন ফি কমানোর সিদ্ধান্ত যা সরকার ইতিমধ্যে গেজেট আকারে প্রকাশও করেছে।
চেঞ্জ অ্যান্ড ট্রান্সফরমেশন ম্যানেজমেন্ট টিমও গঠন করেছে। আগামীতে আরও ভালো কিছু দেখার অপেক্ষায় আছি আমরা। কিন্তু এই গতি যেন আবার হোঁচট খেলো নতুন বছরের শুরুতেই। তৃতীয় দফায় ২ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে ৬ জন সদস্য নিয়োগ দিয়ে সরকার যেন এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থার জায়গায় ‘গুড়ে বালি’ দিতে চাইছে।
এতে অবশ্য প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দায়ী করা যাবে না। কারণ তার প্রশাসনে এখনো ঘাপটি মেরে বসে আছে পতিত সরকারের দোসররা। তারাই প্রশাসনকে উল্টো পথে নিয়ে যাচ্ছে। সংস্কারের পথে বারবার বাধার সৃষ্টি করছে। বিতর্ক সৃষ্টি করছে।
এই ৬ জন সদস্যের মধ্যে তিনজন নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। সমালোচনার ঝড় উঠেছে। ইতিমধ্যে তাদের নিয়োগ বাতিলের জন্য চারিদিক থেকে দাবি উঠছে। দাবি না মানলে কঠোর আন্দোলনে নামার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে।
যুগান্তর প্রকাশ করেছে, ‘পিএসসির তিন সদস্য নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক, জানা গেল কারণ’ (যুগান্তর, ৮ জানুয়ারি ২০২৪)। এজন্য এখানে আর সেসব কারণ বিস্তারিত উল্লেখ করলাম না।
৯ জানুয়ারি এই ৬ সদস্যের শপথ গ্রহণের কথা থাকলেও শপথ অনুষ্ঠান স্থগিতের কথাও খবরে প্রকাশিত। কেন পিএসসি’কে বিতর্কিত করার এই অপচেষ্টা? প্রশাসন যেখানে এজেন্সির রিপোর্টের অজুহাত দিয়ে নিয়োগ বাতিল করছে সেখানে কেন সেই এজেন্সি এক্ষেত্রে বিতর্কিত ব্যক্তিদের পক্ষে সত্যায়ন করছে? পিএসসি’র চেয়ারম্যানের দৃঢ় মনোবলকে ভেঙে দেওয়ার জন্য?
কেননা তিনি ইতিমধ্যে বলেছেন, ‘পিএসসি’কে বিশ্বাসের প্রতীক হিসেবে গড়ে তুলতে চাই’ (যুগান্তর, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪)।
তিনি আরও বলেছেন, ‘জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার বিপ্লব আমাদের সামনে পিএসসি’কে নতুন করে গড়ে তোলার একটি সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। এ সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না (প্রথম আলো, ৮ জানুয়ারি ২০২৪)।
বিপ্লবোত্তর বর্তমান বাংলাদেশে আপামর সাধারণ জনগণের প্রত্যাশাকে নিয়ে কেউ এখন খেলবে, তা আর সম্ভব হবে না। বিশেষ করে যেখানে যুব সমাজের স্বার্থ জড়িত সেখানে তো নয়ই।
আমরা সবাই চাই একটি বৈষম্যহীন সুন্দর-উন্নত বাংলাদেশ। প্রশাসনকে এসব বিষয় বুঝেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এতেই মঙ্গল।
ড. শাফিউল ইসলাম ।। অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়