দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে কাজ করছে ড. ইউনূস সরকার
বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে দুর্নীতির চিত্র অত্যন্ত উদ্বেগজনক। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায়ও বাংলাদেশের অবস্থান নাজুক। আফগানিস্তান ছাড়া এ অঞ্চলের সব দেশের চেয়ে বাংলাদেশে দুর্নীতির হার বেশি। এ অবস্থায় দেশের আর্থিক ও সামাজিক কাঠামো পুনর্নির্মাণ করতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) শক্তিশালী এবং কার্যকর করতে চলেছে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি আনুষ্ঠানিকভাবে শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছে। দুর্নীতি, অনিয়ম, লুটপাটসহ অর্থনীতির নানা বিষয়ে তাদের প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে ৪০০ পৃষ্ঠার শ্বেতপত্র তৈরি করেছে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি।
২ ডিসেম্বর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে এক অনুষ্ঠানে এই শ্বেতপত্র প্রকাশ করেন কমিটির প্রধান অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এর আগে ১ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এই শ্বেতপত্র জমা দেয় কমিটির সদস্যরা।
মোট ১২ জন অর্থনীতিবিদ নিয়ে শ্বেতপত্র কমিটি গঠন করা হয়েছিল। একটি প্রতিনিধিত্বশীল কমিটির মাধ্যমে এই শ্বেতপত্র প্রণয়ন করা হয়েছে। এই শ্বেতপত্রে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নয়, দুর্নীতির পুরো প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেছি। এই কমিটির কাজ চোর ধরা না, চুরির প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করা। ৯০ দিনের মধ্যে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি নিজেদের মধ্যে ১৮ বার সভা করে। নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে ২২ বার সভা করে।
কমিটির পর্যবেক্ষণে যে-সব বিষয় উঠে এসেছে তা হলো-
রাজস্ব ফাঁকি ও আর্থিক ক্ষতি
কর ফাঁকি, কর ছাড়ের অপব্যবহার এবং দুর্বলভাবে পরিচালিত সরকারি অর্থ ব্যবস্থাপনা রাষ্ট্রকে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ থেকে বঞ্চিত করেছে, ফলে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বছরে গড়ে ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার হয়েছে। যা বিদেশি সাহায্য এবং এফডিআই প্রবাহের সম্মিলিত মানের দ্বিগুণেরও বেশি। তদুপরি, কর ছাড় অর্ধেকে নামিয়ে আনলে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দ্বিগুণ এবং স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ তিনগুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব।
সরকারি বিনিয়োগ
বড় আকারের সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতির কারণে গড় ব্যয় ৭০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সময়সীমা পাঁচ বছরের বেশি পেরিয়ে গেছে। গত ১৫ বছরে এডিপি এবং উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করা ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মধ্যে ১৪ থেকে ২৪ বিলিয়ন বা ১ লাখ ৬১ হাজার থেকে ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির কারণে নষ্ট হয়েছে। রাজনৈতিক চাঁদাবাজি, ঘুষ এবং ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তৈরি বাজেটের কারণে সম্পদ হারিয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণের সময় তহবিলের অপব্যবহার এবং পক্ষপাতদুষ্ট প্রকল্প পরিচালকদের নিয়োগ আরও বেশি সম্পদ সংকট সৃষ্টি করেছে। যার ফলে অবকাঠামো ও সামাজিক বিনিয়োগ থেকে সম্ভাব্য সুফল হ্রাস পেয়েছে।
খাদ্যপণ্যের সরবরাহ চেইন ধ্বংস
গৃহস্থালির উৎপাদন পরিসংখ্যান বিকৃত করা এবং চাহিদা কম দেখানো হয়েছে। বিশেষ করে চাল, ভোজ্য তেল এবং গমের মতো প্রধান পণ্যের ক্ষেত্রে এমন চিত্র দেখা গেছে। যা বাজারকে অস্থিতিশীল করেছে। এলোমেলো ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত ক্রয় নীতিমালা শক্তিশালী ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলোকে সুবিধা দিয়েছে এবং সাধারণ ভোক্তাদের দুর্ভোগ বাড়িয়েছে। নিয়মিত মজুত পর্যবেক্ষণের অভাবে এই সমস্যাগুলোকে আরো জটিল করেছে।
ব্যাংকিং এবং আর্থিক ব্যবস্থা
রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত ঋণদান প্রক্রিয়া ব্যাংকিং খাতের সংকটকে আরও গভীর করেছে। ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত আর্থিক মূল্য হিসাব করলে ১৪টি ঢাকা মেট্রো সিস্টেম বা ২৪টি পদ্মা সেতু নির্মাণের সমান হবে। ধারাবাহিক ঋণ খেলাপি এবং উচ্চ প্রোফাইল জালিয়াতি আর্থিক স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং উৎপাদনশীল খাত থেকে মূলধন সরিয়ে নিয়েছে।
আরও পড়ুন
শ্রম অভিবাসন
গত এক দশকে ১৩ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা হুন্ডির মাধ্যমে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো ভিসা ক্রয়ের জন্য ব্যয় করেছে। যা ঢাকা এমআরটি-৬ (উত্তরা-মতিঝিল) নির্মাণের খরচের চার গুণ। সিন্ডিকেট এবং শোষণমূলক রিক্রুটমেন্ট কার্যক্রম অভিবাসী শ্রমিকদের ন্যায্য চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছে। যার রেমিট্যান্স প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
সামাজিক সুরক্ষা নেট
সামাজিক সুরক্ষা প্রোগ্রামের মধ্যে তহবিলের অযথা ব্যয় লাখ লাখ মানুষকে বিপন্ন অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। ২০২২ সালে ৭৩ শতাংশ সামাজিক সুরক্ষা সুবিধাভোগী গরিব হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ হয়নি।
পরিবেশ ব্যবস্থাপনা
জলবায়ু অভিযোজন তহবিলের মধ্যে দুর্নীতি পরিবেশগত অবক্ষয়কে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। রাজনৈতিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত জলবায়ু সম্পদের অপব্যবস্থাপনা স্থায়িত্বমূলক উদ্যোগগুলোকে ব্যাহত করেছে এবং জলবায়ু-উদ্ভূত ঝুঁকির বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, জবাবদিহিমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা ছাড়া দুর্নীতিবিরোধী শাসন টিকবে না। এই উদ্দেশে তার সরকার রাজনৈতিক ব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিচার ব্যবস্থা এবং পুলিশেও সংস্কারের কাজ শুরু করেছে। জনবান্ধব প্রশাসন গড়তে চাইছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। এই প্রশাসনে দুর্নীতিবাজ কারও ঠাঁই হবে না। সুশাসন নিশ্চিতে প্রত্যেককে কাজের ক্ষেত্রে সৎ থাকতে হবে। সরকারি কেনাকাটায় পরিচয় দিতে হবে নৈতিকতা ও সর্বোচ্চ দেশপ্রেমের।
১ সেপ্টেম্বর সব কর্মচারীর সম্পদের হিসাব বিবরণী জমা দিতে বলেছে সরকার। বর্তমানে জনপ্রশাসনে এটিই সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। বেশির ভাগ কর্মকর্তা এটিকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন। তারা বলছেন, ১৫ লাখ সরকারি কর্মচারীর মধ্যে অপকর্মে জড়িত গুটি কয়েক। তাদের কারণে সবার দুর্নাম হয়। এ পদক্ষেপের মাধ্যমে সৎ ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তাদের মর্যাদা সমুন্নত হবে।
সমাজ থেকে দুর্নীতির মূল উপড়ে ফেলতে হবে। বিগত সরকারের প্রধান থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার পর্যন্ত, রাষ্ট্রের প্রায় সর্বস্তরে দুর্নীতির যে ছাপ প্রতিভাত হয়েছে, তা সত্যিই ভয়াবহ। গত ১৫ বছরে শুধু দেশের সম্পদ ও বিপুল অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়নি, দেশের সাধারণ মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যারা দুর্নীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত নন, তাদেরও নিত্যপণ্যের অত্যাধিক মূল্য দিতে হচ্ছে—যেমন গ্যাস, বিদ্যুৎ, তেল, পেঁয়াজ, মরিচ ইত্যাদির মূল্য বেড়ে গেছে। এ পরিস্থিতির ফলে সাধারণ মানুষের জীবনে এক ধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে এবং তাদের জন্য জীবনযাপন করা দিনদিন কঠিন হয়ে উঠছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করা পর্যন্ত দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার উন্নতি সম্ভব নয়। সঠিকভাবে প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে দুর্নীতি নির্মূল করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক : কলামিস্ট ও চবি অ্যালামনাই বসুন্ধরার সভাপতি। সাবেক ট্রাস্টি, বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট