ই-বর্জ্যের টেকসই ব্যবস্থাপনা : বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
১. ইলেকট্রনিক বর্জ্যের চিত্র: বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা
ইলেকট্রনিক বর্জ্যের পরিমাণ ও প্রভাব
বাংলাদেশে প্রযুক্তির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে, যার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ইলেকট্রনিক বর্জ্যের পরিমাণ। স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, টেলিভিশন এবং অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ক্রমবর্ধমান চাহিদার ফলে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ ই-বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৪ লাখ মেট্রিক টন ইলেকট্রনিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার মাত্র একটি ক্ষুদ্র অংশ সঠিকভাবে রি-সাইক্লিং করা হয়। এই বর্জ্যের বেশিরভাগই ফেলে দেওয়া হয় ডাম্পিং সাইটে বা অননুমোদিত রি-সাইক্লিং কারখানায়, যা পরিবেশের জন্য গুরুতর হুমকি সৃষ্টি করছে।
ইলেকট্রনিক বর্জ্যের প্রভাব বহুমাত্রিক। এতে থাকা সীসা, পারদ, ক্যাডমিয়ামের মতো ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ, যা মাটির উর্বরতা হ্রাস করে এবং পানির উৎসগুলো দূষিত করে। পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি, ই-বর্জ্য মানুষের স্বাস্থ্যের উপরও বিরূপ প্রভাব ফেলে। এই বর্জ্যের সরাসরি সংস্পর্শে আসা কর্মীরা ত্বকের সমস্যা, শ্বাসকষ্ট এবং ক্যান্সারের মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। তাছাড়া শিশু এবং বৃদ্ধরা এ ধরনের দূষণের ফলে আরও বেশি ঝুঁকির মুখে পড়েন। সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব ইলেকট্রনিক বর্জ্যের প্রভাবকে আরও বিপজ্জনক করে তুলছে, যা দ্রুত সমাধানের দাবি রাখে।
শহর ও গ্রামে এর বিস্তার
বাংলাদেশে ইলেকট্রনিক বর্জ্যের বিস্তার শহর ও গ্রামীণ এলাকায় ভিন্ন মাত্রায় দেখা যায়। শহরাঞ্চলে প্রযুক্তি ব্যবহারের মাত্রা বেশি হওয়ায় এখানে ই-বর্জ্যের ঘনত্ব তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং সিলেটের মতো বড় শহরগুলোয় ই-বর্জ্যের প্রধান উৎস হলো ব্যক্তিগত ডিভাইস, অফিসের ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানের ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি।
আরও পড়ুন
শহরে ব্যবহৃত এসব ডিভাইসের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর সেগুলো সঠিকভাবে ডিসপোজ করার কোনো সংগঠিত ব্যবস্থা না থাকায় এগুলো রাস্তার পাশে, ডাম্পিং সাইটে অথবা অননুমোদিত রি-সাইক্লিং কেন্দ্রগুলোয় জমা হয়। ফলে পরিবেশ দূষণের মাত্রা শহরাঞ্চলে দ্রুত বাড়ছে।
গ্রামীণ এলাকায় ইলেকট্রনিক বর্জ্যের বিস্তার তুলনামূলক কম হলেও এর প্রভাব কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অনেক ক্ষেত্রে শহরের ব্যবহৃত ও বাতিল ইলেকট্রনিক পণ্যগুলো গ্রামীণ এলাকায় কম দামে বিক্রি করা হয়, যা পরে সেখানেও বর্জ্যের সমস্যা তৈরি করে। তাছাড়া, গ্রামাঞ্চলের মানুষ ই-বর্জ্যের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন নয়, ফলে স্থানীয় পরিবেশের উপর এর ক্ষতিকর প্রভাব ধীরে ধীরে বাড়ছে। ইলেকট্রনিক বর্জ্যের ব্যবস্থাপনার অভাব গ্রামীণ এলাকাগুলোয়ও একটি সুদূরপ্রসারী সমস্যা তৈরি করছে, যা পরিবেশগত ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
২. ইলেকট্রনিক বর্জ্যের ক্ষতিকর প্রভাব: পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য
পরিবেশ দূষণের মাত্রা
ইলেকট্রনিক বর্জ্যের অপর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের পরিবেশ দূষণের মাত্রা ক্রমাগত বাড়িয়ে তুলছে। ই-বর্জ্যে থাকা ভারী ধাতু যেমন সীসা, পারদ এবং ক্যাডমিয়াম মাটিতে জমা হয়ে মাটির উর্বরতা হ্রাস করে এবং কৃষিজমির উৎপাদনশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এসব বর্জ্য যখন সঠিকভাবে ডিসপোজ করা হয় না, তখন তা ভূগর্ভস্থ পানির সঙ্গে মিশে যায়, যা দেশের প্রধান জলজ উৎসগুলো দূষিত করে তোলে। বিশেষত শহরাঞ্চলে যেখানে এই বর্জ্যের ঘনত্ব বেশি, সেখানে নদী ও খালগুলোর পানিতে ই-বর্জ্যের রাসায়নিক উপাদান মিশে স্থানীয় জীববৈচিত্র্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এই দূষণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে না আনা গেলে বাংলাদেশের পরিবেশ আরও সংকটময় পরিস্থিতির মুখে পড়বে।
জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলো ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অত্যন্ত সংগঠিত এবং প্রযুক্তিনির্ভর পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। জাপানে ই-বর্জ্য সংগ্রহ এবং পুনর্ব্যবহারের জন্য বিশেষ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে ই-বর্জ্য থেকে মূল্যবান উপাদান পুনরুদ্ধার করা হয়।
পরিবেশ দূষণের আরেকটি মারাত্মক দিক হলো বায়ুদূষণ। অনেক ক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক বর্জ্য পুড়িয়ে ফেলার মাধ্যমে ডিসপোজ করা হয়, যা বাতাসে বিষাক্ত গ্যাস যেমন ডাইঅক্সিন এবং ফিউরান ছড়িয়ে দেয়। এসব গ্যাস শুধুমাত্র স্থানীয় বায়ু মানকে প্রভাবিত করে না, বরং তা জলবায়ুর পরিবর্তনেও ভূমিকা রাখে। এই প্রক্রিয়ায় কার্বন নির্গমনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়, যা বৈশ্বিক উষ্ণায়নকেও ত্বরান্বিত করে। অতএব, ইলেকট্রনিক বর্জ্যের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনার কারণে পরিবেশ দূষণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, যা টেকসই পরিবেশ রক্ষার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
জনস্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকর প্রভাব
ইলেকট্রনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব মানুষের স্বাস্থ্যের উপর গুরুতর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। ই-বর্জ্যে উপস্থিত সীসা, পারদ এবং ক্যাডমিয়ামের মতো ভারী ধাতু মানবদেহের জন্য অত্যন্ত বিষাক্ত। এগুলো সরাসরি সংস্পর্শে এলে বা দূষিত পানি ও খাদ্যের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করলে স্নায়ুতন্ত্র, কিডনি এবং লিভারের কার্যক্রমে বিপর্যয় ঘটাতে পারে।
বিশেষত শিশু ও গর্ভবতী নারীরা এই বিষাক্ত উপাদানের প্রভাবে মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকে, কারণ এটি শিশুর শারীরিক এবং মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এছাড়া ই-বর্জ্যের সঙ্গে কাজ করা শ্রমিকরা প্রায়ই নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছাড়াই কাজ করেন, যার ফলে তাদের শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা, চর্মরোগ, এমনকি দীর্ঘমেয়াদে ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
এছাড়া ইলেকট্রনিক বর্জ্য পুড়িয়ে ফেলার মাধ্যমে বাতাসে ছড়িয়ে পড়া ডাইঅক্সিন এবং ফিউরান জাতীয় বিষাক্ত গ্যাস জনস্বাস্থ্যের জন্য আরও বড় বিপদ ডেকে আনে। এই গ্যাসগুলো শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ এবং ক্যান্সারের মতো জটিল রোগের কারণ হতে পারে। শহরাঞ্চলে যেখানে ই-বর্জ্যের ঘনত্ব বেশি, সেখানে এই দূষণের কারণে স্থানীয় বাসিন্দাদের দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি বাড়ছে।
গ্রামীণ এলাকাগুলোয়ও পরিস্থিতি ভিন্ন নয়, কারণ দূষিত পানি ও খাদ্যের মাধ্যমে এই বিষাক্ত উপাদান মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে ই-বর্জ্যের কারণে জনস্বাস্থ্যের উপর এই ক্ষতিকর প্রভাব ক্রমাগত বাড়ছে, যা সমাধানের জন্য অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজন।
৩. ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আন্তর্জাতিক উদাহরণ
উন্নত দেশগুলোর টেকসই পদ্ধতি
উন্নত দেশগুলো ইলেকট্রনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় টেকসই পদ্ধতির মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোয় 'ইলেকট্রনিক বর্জ্য নির্দেশিকা' (Waste Electrical and Electronic Equipment Directive) কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা হয়, যা ই-বর্জ্যের রি-সাইক্লিং এবং সঠিক ডিসপোজাল নিশ্চিত করে। এই নির্দেশিকার অধীনে ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদকদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিতে হয়, যা উৎপাদক-দায়িত্ব সম্প্রসারণ (Extended Producer Responsibility) নামে পরিচিত। এ ধরনের ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ইউরোপে ই-বর্জ্যের পুনর্ব্যবহারের হার বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পরিবেশ দূষণ কমানো সম্ভব হয়েছে।
জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলো ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অত্যন্ত সংগঠিত এবং প্রযুক্তিনির্ভর পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। জাপানে ই-বর্জ্য সংগ্রহ এবং পুনর্ব্যবহারের জন্য বিশেষ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে ই-বর্জ্য থেকে মূল্যবান উপাদান পুনরুদ্ধার করা হয়।
দক্ষিণ কোরিয়া ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আইনি কাঠামো প্রণয়ন করেছে, যা পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপাদান সংগ্রহ এবং পরিবেশবান্ধব প্রসেসিংকে উৎসাহিত করে। এ উদ্যোগগুলো শুধুমাত্র পরিবেশ রক্ষা করে না, বরং অর্থনৈতিক সম্পদ সৃষ্টির মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগও বৃদ্ধি করে। উন্নত দেশগুলোর এসব টেকসই পদ্ধতি বাংলাদেশের জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে, যা পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
কীভাবে উন্নত দেশগুলোর টেকসই পদ্ধতি বাংলাদেশের জন্য প্রাসঙ্গিক হতে পারে
উন্নত দেশগুলোর ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার টেকসই পদ্ধতি থেকে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের উৎপাদক-দায়িত্ব সম্প্রসারণ (Extended Producer Responsibility - EPR) মডেল বাংলাদেশের জন্য একটি কার্যকর উদাহরণ হতে পারে। এ মডেলের মাধ্যমে উৎপাদকদের তাদের পণ্যের পুরো জীবনচক্রের জন্য দায়বদ্ধ করা হয়, যা ইলেকট্রনিক বর্জ্যের পুনর্ব্যবহার এবং সঠিক ডিসপোজাল নিশ্চিত করে।
বাংলাদেশে এই নীতি প্রয়োগ করা গেলে উৎপাদক এবং আমদানিকারকদের ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দায়িত্ববান করে তোলা সম্ভব হবে। এটি ই-বর্জ্য পুনর্ব্যবহারের হার বাড়ানোর পাশাপাশি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা খাতে বিনিয়োগের নতুন সুযোগ তৈরি করতে পারে। জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার প্রযুক্তিনির্ভর পদ্ধতি বাংলাদেশের জন্যও প্রাসঙ্গিক। এই দেশগুলোয় ই-বর্জ্য রি-সাইক্লিং বা পুনর্ব্যবহারের জন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং সংগঠিত পুনর্ব্যবহার কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।
বাংলাদেশেও এ ধরনের প্রযুক্তি ও কেন্দ্র চালু করা গেলে ই-বর্জ্য থেকে মূল্যবান উপাদান পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে, যা অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হতে পারে। তাছাড়া, দক্ষ জনবল তৈরির জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা গেলে টেকসই ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পথে আরও দ্রুত অগ্রগতি সম্ভব হবে। উন্নত দেশগুলোর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশগত সমস্যা মোকাবিলা করার পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়নের নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে পারে।
৪. বাংলাদেশে বিদ্যমান নীতিমালা: সীমাবদ্ধতা ও উন্নয়নের সুযোগ
বর্তমান নীতিমালার পর্যালোচনা
বাংলাদেশে ইলেকট্রনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত নীতিমালার বিকাশ এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। ২০১১ সালে প্রণীত পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা এবং ২০২১ সালের ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা কিছু প্রাসঙ্গিক দিক নির্দেশনা দিলেও, এগুলোর কার্যকর প্রয়োগ এবং সুনির্দিষ্ট কাঠামোর অভাব স্পষ্ট। বিদ্যমান নীতিমালাগুলোয় ই-বর্জ্য পুনর্ব্যবহার এবং ডিসপোজাল বা নিষ্পত্তির জন্য সুনির্দিষ্ট দায়বদ্ধতা নির্ধারণ করা হয়নি, যা উৎপাদক, আমদানিকারক এবং ব্যবহারকারীদের জন্য একটি পরিষ্কার নির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তদুপরি, ই-বর্জ্যের রি-সাইক্লিংয়ের জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামোর অভাবের কারণে নীতিমালার কার্যকারিতা ব্যাপকভাবে সীমিত।
নীতিমালার আরও একটি বড় সীমাবদ্ধতা হলো ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অংশীজনদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা। দেশে উৎপাদক- দায়িত্ব সম্প্রসারণ (Extended Producer Responsibility - EPR) মডেলের মতো কাঠামো এখনো কার্যকরভাবে চালু হয়নি, যা ই-বর্জ্যের সঠিক নিষ্পত্তি নিশ্চিত করার জন্য অপরিহার্য।
তদুপরি, ই-বর্জ্যের প্রভাব সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলোর সম্পৃক্ততা বাড়ানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো নীতিমালায় উপেক্ষিত রয়ে গেছে। বাংলাদেশের বর্তমান নীতিমালা পর্যালোচনায় স্পষ্ট যে, ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় একটি আধুনিক ও সমন্বিত কাঠামো প্রতিষ্ঠার জন্য নীতিমালা সংস্কার এবং প্রয়োগের সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি।
বিদ্যমান আইনগুলোর উন্নয়নের প্রয়োজন
বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিদ্যমান আইনগুলোয় বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যা উন্নয়নের মাধ্যমে আরও কার্যকর ও প্রাসঙ্গিক করা জরুরি। বর্তমানে আইনগুলোয় ই-বর্জ্য উৎপাদক, আমদানিকারক এবং ব্যবহারকারীদের জন্য সুনির্দিষ্ট দায়বদ্ধতা এবং দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয়নি।
উদাহরণস্বরূপ, উৎপাদক-দায়িত্ব সম্প্রসারণ (Extended Producer Responsibility - EPR) মডেল কার্যকর করার জন্য কোনো স্পষ্ট নির্দেশনা বা কাঠামো নেই। ফলে, ই-বর্জ্যের সঠিক পুনর্ব্যবহার ও নিষ্পত্তি নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। বিদ্যমান আইনগুলো আরও স্পষ্ট ও কঠোর করে প্রণয়ন করা হলে, সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের দায়িত্ববোধ বাড়বে এবং ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আরও কার্যকর হবে।
তাছাড়া, ই-বর্জ্য রি-সাইক্লিংয়ের জন্য উন্নত প্রযুক্তি এবং পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে আইনগুলোর অনুপ্রেরণা দেওয়ার সক্ষমতাও সীমিত। রি-সাইক্লিং প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ করতে পারে, তার জন্য বিদ্যমান আইনগুলোয় কর প্রণোদনা, ঋণ সুবিধা এবং নীতিগত সহায়তা অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। এছাড়া আইনগুলোয় রি-সাইক্লিংয়ের প্রক্রিয়া এবং পরিবেশ দূষণ কমানোর জন্য নির্দিষ্ট মান নির্ধারণ করা প্রয়োজন, যা এখন পর্যন্ত অনুপস্থিত। এটি প্রবর্তন করা গেলে পরিবেশগত ঝুঁকি কমানোর পাশাপাশি পুনর্ব্যবহারের কার্যক্রমে মান নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত হবে।
আরেকটি বড় ঘাটতি হলো ই-বর্জ্যের সঠিক সংগ্রহ এবং প্রক্রিয়াকরণে স্থানীয় সরকারের ভূমিকা স্পষ্ট নয়। আইনগুলোয় স্থানীয় প্রশাসন ও পৌরসভার জন্য সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব নির্ধারণ করে ই-বর্জ্যের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা যেতে পারে। স্থানীয় পর্যায়ে বর্জ্য সংগ্রহ, পরিবহন এবং প্রাথমিক প্রক্রিয়াকরণের দায়িত্ব আইনগতভাবে নির্ধারণ করলে এটি একটি সংগঠিত কাঠামো তৈরিতে সহায়ক হবে। পাশাপাশি, বেসরকারি খাতের সঙ্গে সমন্বয় বাড়ানোর জন্য আইনগুলোয় স্পষ্ট নির্দেশনা প্রয়োজন, যা এই ব্যবস্থাপনাকে আরও কার্যকর করে তুলবে।
জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিদ্যমান আইনগুলোয় বিশেষ ধারা যোগ করা প্রয়োজন। ই-বর্জ্যের ক্ষতিকর প্রভাব এবং পুনর্ব্যবহার যোগ্যতার গুরুত্ব সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করতে আইনগতভাবে সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালানোর বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত। এটি মানুষকে ই-বর্জ্য সঠিকভাবে ডিসপোজ করতে উৎসাহিত করবে। উন্নত দেশগুলোর অভিজ্ঞতা বিবেচনায় এনে, বাংলাদেশে বিদ্যমান আইনগুলো যুগোপযোগী এবং টেকসই কাঠামোতে উন্নীত করা সম্ভব, যা পরিবেশ রক্ষা এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৫. ই-বর্জ্য পুনর্ব্যবহারযোগ্য পদ্ধতি: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
পুনর্ব্যবহারের জন্য কার্যকর উপায়
ইলেকট্রনিক বর্জ্য পুনর্ব্যবহারের জন্য কার্যকর উপায় নিশ্চিত করতে হলে একটি সংগঠিত ও পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।
প্রথমত, ই-বর্জ্য সংগ্রহের জন্য একটি কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। স্থানীয় পর্যায়ে বর্জ্য সংগ্রহ কেন্দ্র স্থাপন এবং সেগুলোয় সাধারণ মানুষের জন্য সহজলভ্য ব্যবস্থা তৈরি করলে ই-বর্জ্য সঠিকভাবে সংগৃহীত হবে। এই সংগ্রহকৃত বর্জ্য পুনর্ব্যবহারের জন্য কেন্দ্রীয় প্রক্রিয়াকরণ ইউনিটে পাঠানো যেতে পারে, যেখানে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে বর্জ্য থেকে মূল্যবান ধাতু ও উপাদান পুনরুদ্ধার করা সম্ভব।
দ্বিতীয়ত, ই-বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণের জন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ অপরিহার্য। উন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও এমন প্রযুক্তি চালু করা দরকার, যা ই-বর্জ্য থেকে সোনা, রূপা এবং তামার মতো মূল্যবান উপাদান পুনরুদ্ধার করতে পারে। এসব উপাদান স্থানীয় শিল্প খাতে পুনরায় ব্যবহার করা গেলে তা অর্থনৈতিক দিক থেকেও উপকারী হবে। এছাড়া, পুনর্ব্যবহারের জন্য সঠিক মান বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে পরিবেশ দূষণ কমিয়ে পুনর্ব্যবহারযোগ্য সামগ্রী নিরাপদে পুনঃব্যবহৃত হতে পারে।
তৃতীয়ত, ই-বর্জ্য পুনর্ব্যবহারের কার্যক্রমে বেসরকারি খাতের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা উচিত। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো এ খাতে বিনিয়োগে উৎসাহিত করার জন্য বিশেষ নীতিগত সহায়তা প্রয়োজন। তদুপরি, বর্জ্য পুনর্ব্যবহারের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা গেলে এটি শুধু পরিবেশ সংরক্ষণেই নয়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখবে। এ ধরনের উদ্যোগ মানুষের সচেতনতা বাড়াবে এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য ই-বর্জ্যের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করবে। বাংলাদেশে ই-বর্জ্যের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হলে এই কার্যকর উপায়গুলোকে বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ভূমিকা
ইলেকট্রনিক বর্জ্য পুনর্ব্যবহারযোগ্য পদ্ধতিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (SME) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলাদেশের মতো দেশে এই শিল্প খাত রি-সাইক্লিং বা পুনর্ব্যবহারের কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করতে পারে, কারণ এরা স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য উপকরণ এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করে ই-বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করতে পারে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলো বর্জ্য থেকে সোনা, তামা এবং অন্যান্য মূল্যবান ধাতু পুনরুদ্ধার করতে পারে, যা স্থানীয় বাজারে সরবরাহের মাধ্যমে শিল্প খাতের চাহিদা মেটায়। এটি শুধু ই-বর্জ্য সমস্যার সমাধান নয়, বরং অর্থনীতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ সৃষ্টি করে।
তাছাড়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের মাধ্যমে ই-বর্জ্যের পুনর্ব্যবহারের কার্যক্রমে স্থানীয় কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়। এ খাতে প্রশিক্ষিত কর্মী নিয়োগ এবং দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে আরও কার্যকর করে তোলে। পাশাপাশি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য কর সুবিধা এবং প্রযুক্তি সহায়তার ব্যবস্থা করা গেলে তারা ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারবে। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলোর জন্য ই-বর্জ্য পুনর্ব্যবহারযোগ্য কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী কাঠামো তৈরি করা সম্ভব, যা বাংলাদেশের পরিবেশ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে।
৬. অর্থনৈতিক সম্ভাবনা: ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থান
ই-বর্জ্য থেকে অর্থনৈতিক সম্পদ সৃষ্টি
ইলেকট্রনিক বর্জ্য (ই-বর্জ্য) শুধুমাত্র পরিবেশের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ নয়, এটি একটি মূল্যবান অর্থনৈতিক সম্পদের উৎস হিসেবেও কাজ করতে পারে। ই-বর্জ্যের মধ্যে সোনা, রূপা, তামা এবং প্যালাডিয়ামের মতো মূল্যবান ধাতু রয়েছে, যা পুনর্ব্যবহার করা হলে স্থানীয় এবং বৈশ্বিক বাজারে বিক্রি করা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, এক টন ই-বর্জ্য থেকে প্রায় ৪০ থেকে ৮০০ গ্রাম সোনা পুনরুদ্ধার করা যায়, যা খনিতে থেকে সোনা উত্তোলনের তুলনায় অনেক বেশি লাভজনক। পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে এই মূল্যবান ধাতুগুলো স্থানীয় ইলেকট্রনিক শিল্পে সরবরাহ করা গেলে আমদানির উপর নির্ভরতা কমবে এবং দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
ই-বর্জ্যের ক্ষতিকর প্রভাব এবং পুনর্ব্যবহারের গুরুত্ব সম্পর্কে জনগণকে জানাতে শিক্ষা কার্যক্রম, গণমাধ্যম প্রচারণা এবং স্থানীয় কর্মশালার আয়োজন জরুরি।
এছাড়া ই-বর্জ্য থেকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য অন্যান্য উপাদান যেমন প্লাস্টিক, গ্লাস এবং অ্যালুমিনিয়াম পুনরায় ব্যবহার করে নতুন পণ্য উৎপাদন করা সম্ভব। এভাবে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে স্থানীয় শিল্প খাতের প্রসার ঘটানো এবং রপ্তানিমুখী পণ্য উৎপাদনের সুযোগ তৈরি করা যায়। তদুপরি, ই-বর্জ্য পুনর্ব্যবহার প্রক্রিয়ায় বিনিয়োগের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলোর জন্য নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনা তৈরি হয়। এটি শুধুমাত্র পরিবেশগত ঝুঁকি কমায় না, বরং জাতীয় আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি স্থানীয় বাজারকে শক্তিশালী করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এ কারণে, ই-বর্জ্য থেকে অর্থনৈতিক সম্পদ সৃষ্টির জন্য সঠিক পরিকল্পনা ও নীতিমালা প্রণয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কর্মসংস্থানের সুযোগ
ইলেকট্রনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করলে বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের একটি বিশাল ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে। ই-বর্জ্যের সংগ্রহ, প্রসেসিং এবং পুনর্ব্যবহারের প্রতিটি ধাপেই বিভিন্ন দক্ষতা ও শ্রমের প্রয়োজন হয়। এই খাতে স্থানীয় পর্যায়ে বর্জ্য সংগ্রহ কেন্দ্র স্থাপন এবং বর্জ্য প্রসেসিংয়ের জন্য আধুনিক রি-সাইক্লিং কেন্দ্র তৈরি করা হলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা সম্ভব। বিশেষ করে গ্রামীণ এবং শহরতলির এলাকাগুলোয় এই ধরনের উদ্যোগ স্থানীয় জনগণের জন্য আয়ের একটি নতুন উৎস হিসেবে কাজ করবে।
তদুপরি, ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য প্রযুক্তি-নির্ভর কর্মীদের প্রয়োজন, যারা পুনর্ব্যবহারের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া পরিচালনা করতে সক্ষম। এটি তথ্যপ্রযুক্তি এবং পরিবেশবিদ্যার শিক্ষার্থীদের জন্য একটি নতুন কর্মক্ষেত্র খুলে দিতে পারে। পাশাপাশি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলোয় ই-বর্জ্য প্রসেসিংয়ের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী নিয়োগ করলে স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত হবে। এ ধরনের উদ্যোগ শুধু ই-বর্জ্য সমস্যার সমাধান নয়, বরং নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি করে দেশের যুবশক্তিকে উৎপাদনশীল কাজে যুক্ত করার সুযোগ করে দেয়।
এছাড়া, ই-বর্জ্যের পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপাদান থেকে নতুন পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রেও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। যেমন, পুনর্ব্যবহৃত প্লাস্টিক ও ধাতু ব্যবহার করে ইলেকট্রনিক ডিভাইস বা নির্মাণ সামগ্রী উৎপাদনের নতুন শিল্প গড়ে তোলা যায়। রপ্তানিমুখী এসব পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয় বৃদ্ধি সম্ভব। ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা খাতে সঠিক পরিকল্পনা এবং বিনিয়োগ নিশ্চিত করা গেলে, এটি বাংলাদেশে একটি টেকসই কর্মসংস্থানের মডেল হিসেবে গড়ে উঠতে পারে, যা পরিবেশ রক্ষা ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির মধ্যে একটি ভারসাম্য সৃষ্টি করবে।
৭. জনসচেতনতা ও অংশীদারিত্বের গুরুত্ব
জনগণকে সচেতন করার প্রয়োজনীয়তা
ইলেকট্রনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় জনগণকে সচেতন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি একটি সমষ্টিগত সমস্যা যা সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া সমাধান সম্ভব নয়। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ এখনো ই-বর্জ্যের ক্ষতিকর প্রভাব এবং পুনর্ব্যবহারের গুরুত্ব সম্পর্কে অবগত নয়। ফলে, ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলো প্রায়ই যত্রতত্র ফেলে দেওয়া হয়, যা পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করে। জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক জনসচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো দরকার, যেখানে ই-বর্জ্য সঠিকভাবে নিষ্পত্তি এবং পুনর্ব্যবহারের পদ্ধতি সম্পর্কে সহজবোধ্য তথ্য উপস্থাপন করা হবে।
এছাড়া, ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন। স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ই-বর্জ্যের প্রভাব এবং ব্যবস্থাপনা নিয়ে কর্মশালা এবং সেমিনার আয়োজন করা যেতে পারে। গণমাধ্যম, সামাজিক মাধ্যম এবং স্থানীয় কমিউনিটি নেতাদের সম্পৃক্ত করে এই বার্তাগুলো আরও কার্যকরভাবে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। জনগণ সচেতন হলে তারা ই-বর্জ্য পুনর্ব্যবহারের উদ্যোগে যুক্ত হতে উৎসাহিত হবে, যা ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার একটি টেকসই সমাধানের পথ প্রশস্ত করবে।
সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ
ইলেকট্রনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার টেকসই সমাধানে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সরকারের পক্ষ থেকে একটি সুসংগঠিত নীতিমালা প্রণয়ন এবং এর কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কেন্দ্রীয় পর্যায়ে একটি বিশেষায়িত সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে, যা ই-বর্জ্য সংগ্রহ, প্রসেসিং এবং পুনর্ব্যবহারের কাজ তদারকি করবে।
এছাড়া, সরকার স্থানীয় প্রশাসন ও পৌরসভার মাধ্যমে ই-বর্জ্য সংগ্রহ কেন্দ্র স্থাপন এবং জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির কর্মসূচি পরিচালনা করতে পারে। সরকারি নীতিমালায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলোর জন্য কর প্রণোদনা এবং পুনর্ব্যবহারে উদ্ভাবনী প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ তৈরি করলে এই খাত আরও শক্তিশালী হবে।
বেসরকারি খাতও ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। প্রযুক্তি-নির্ভর কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক পণ্যের পুনর্ব্যবহারযোগ্য নকশা তৈরি এবং সেগুলোর নিষ্পত্তির জন্য নিজস্ব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। পাশাপাশি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো রি-সাইক্লিং সেন্টার এবং প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পরিচালনার মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে পারে।
কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার (CSR) অংশ হিসেবে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বেসরকারি উদ্যোগের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গেলে, এটি দেশের পরিবেশ এবং অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের মধ্যে সমন্বিত প্রচেষ্টাই টেকসই ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ভিত্তি গড়ে তুলতে পারে।
৮. ইলেকট্রনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য সুপারিশমালা
কৌশলগত পরিকল্পনা
ইলেকট্রনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য একটি সুসংগঠিত কৌশলগত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা অত্যন্ত জরুরি, যা দীর্ঘমেয়াদি এবং টেকসই সমাধানের ভিত্তি তৈরি করবে। প্রথম ধাপে, একটি সমন্বিত জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন, যা ই-বর্জ্য উৎপাদক, ব্যবহারকারী এবং পুনর্ব্যবহারকারীদের জন্য সুনির্দিষ্ট দায়বদ্ধতা নির্ধারণ করবে। এই নীতিমালায় ই-বর্জ্যের পুনর্ব্যবহারের জন্য সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড এবং প্রযুক্তিগত নির্দেশনা অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। তদুপরি, স্থানীয় প্রশাসন এবং পৌরসভাগুলোর জন্য দায়িত্ব নির্ধারণ করে বর্জ্য সংগ্রহ এবং প্রাথমিক প্রসেসিংকে সহজ করা জরুরি।
দ্বিতীয় ধাপে, পুনর্ব্যবহারের জন্য উন্নত প্রযুক্তি ও অবকাঠামো তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। কেন্দ্রীয়ভাবে পুনর্ব্যবহার কেন্দ্র স্থাপন এবং স্থানীয় পর্যায়ে বর্জ্য সংগ্রহ কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। এতে ই-বর্জ্যের সঠিক প্রসেসিং এবং পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি, ই-বর্জ্য থেকে মূল্যবান উপাদান পুনরুদ্ধারের জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার এবং গবেষণায় বিনিয়োগ করতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতকে এই প্রক্রিয়ায় অংশীদার করতে বিশেষ নীতি এবং প্রণোদনা প্রদান করা যেতে পারে, যা অর্থনীতির জন্যও উপকারী হবে।
সবশেষে, কৌশলগত পরিকল্পনায় জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নির্ধারিত পদক্ষেপ থাকা আবশ্যক। ই-বর্জ্যের ক্ষতিকর প্রভাব এবং পুনর্ব্যবহারের গুরুত্ব সম্পর্কে জনগণকে জানাতে শিক্ষা কার্যক্রম, গণমাধ্যম প্রচারণা এবং স্থানীয় কর্মশালার আয়োজন জরুরি। তদুপরি, সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যে সহযোগিতার মাধ্যমে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আরও কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এই কৌশলগত পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়ন ই-বর্জ্য সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশকে একটি টেকসই পথের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
ভবিষ্যতের জন্য টেকসই সমাধান
ইলেকট্রনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ভবিষ্যতে টেকসই সমাধান নিশ্চিত করতে হলে একটি সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা অপরিহার্য—
প্রথমত, ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় কৌশল তৈরি করতে হবে, যেখানে উৎপাদক, ব্যবহারকারী এবং সরকার সবার ভূমিকা সুনির্দিষ্ট করা থাকবে। উৎপাদক-দায়িত্ব সম্প্রসারণ (Extended Producer Responsibility - EPR) মডেলকে কার্যকর করার মাধ্যমে উৎপাদকদের ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিতে বাধ্য করতে হবে। তাছাড়া, ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলোর পুনর্ব্যবহারযোগ্য নকশা তৈরির জন্য উৎসাহ প্রদান করা প্রয়োজন, যা ই-বর্জ্যের পরিমাণ কমাতে সহায়ক হবে।
দ্বিতীয়ত, ই-বর্জ্য পুনর্ব্যবহারের জন্য গবেষণা ও উন্নয়নে (R&D) বিনিয়োগ বাড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে আধুনিক পুনর্ব্যবহার প্রযুক্তি চালু করা এবং দক্ষ জনবল গড়ে তোলার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা যেতে পারে। তদুপরি, ই-বর্জ্য থেকে পুনরুদ্ধার করা উপাদানগুলো স্থানীয় শিল্প খাতে পুনরায় ব্যবহার করে একটি পরিবেশবান্ধব অর্থনৈতিক চক্র তৈরি করা সম্ভব। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাত এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলো সম্পৃক্ত করলে পুনর্ব্যবহার প্রক্রিয়া আরও কার্যকর ও লাভজনক হবে।
সবশেষে, ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ভবিষ্যতের টেকসই সমাধানে জনসচেতনতা একটি প্রধান ভূমিকা পালন করবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমের মাধ্যমে জনগণকে ই-বর্জ্যের ক্ষতিকর প্রভাব এবং পুনর্ব্যবহারের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। পাশাপাশি, ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে প্রণোদনা দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এই সমন্বিত উদ্যোগ ভবিষ্যতে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে একটি টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব কাঠামোতে রূপান্তরিত করবে, যা বাংলাদেশের পরিবেশ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সমাধান প্রদান করবে।
লেখাটা তৈরিতে বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক সিনহা আবুল খালেদ বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছেন।
ড. মো. মাহবুবুল আলম জোয়ার্দার ।। অধ্যাপক, তথ্য প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়