শৈশবের অভিজ্ঞতায় তারুণ্যের অপরাধ : পরিত্রাণের উপায় কী?
শিশুরাই দেশের ভবিষ্যৎ, এ নিয়ে কারও ভিন্নমত থাকার সুযোগ নেই। শিশুর সুষ্ঠু বিকাশ একটি দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শুধুমাত্র একটি প্রজন্মকে যথাযথভাবে গড়ে তুলতে পারলে দেশ তার সুন্দর ভবিষ্যতে সুদৃঢ়ভাবে এগিয়ে চলবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ শৈশব মানুষের জীবনের সেই সময়, যেখানে বিনিয়োগের ফল জাতি দীর্ঘমেয়াদে ভোগ করে।
বাংলাদেশের শিশু আইন, ২০১৩ অনুসারে ১৮ (আঠারো) বছরের নিচের সব ব্যক্তিকে শিশু হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ অনুসারে ‘কিশোর’ বলতে ১৪ (চৌদ্দ) থেকে অনধিক ১৮ (আঠারো) বৎসর পর্যন্ত ব্যক্তিদের বোঝানো হয়। অর্থাৎ বাংলাদেশের আইন অনুসারে কিশোরদেরও শিশু হিসেবে গণ্য করা হয়। আর জাতীয় যুবনীতি ২০১৭ অনুসারে আঠারো থেকে পঁয়ত্রিশ বৎসর পর্যন্ত ব্যক্তিদের তরুণ বা যুব হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
‘শিশু’ বলতে আমি তাই কিশোরদেরও অন্তর্ভুক্ত করেছি। যেহেতু শিশুকাল শেষেই তারুণ্যের সূচনা হয়, কাজেই তারুণ্যের অপরাধের পেছনের কারণ খুঁজতে হলে শৈশবে অপরাধ প্রবণতা কীভাবে গড়ে ওঠে সেটি বোঝা জরুরি।
শিশুদের ভবিষ্যৎ অগ্রযাত্রা কেমন হবে সেটা তাদের পারিবারিক কাঠামো, জীবন দর্শন, পরিবেশ, প্রতিবেশ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বন্ধু নির্বাচনসহ নানা প্রভাবকের ওপর নির্ভরশীল। যদি কোনো কারণে বাল্যকালেই শিশু কিংবা কিশোরদের যথাযথভাবে দিকনির্দেশনা না দেওয়া হয় কিংবা নিয়ন্ত্রণ না করা যায় তবে তাদের মধ্যে বিচ্যুত আচরণের প্রকাশ ঘটতে পারে। অনেক সময় এমন আচরণ তরুণ বয়স পর্যন্ত কিংবা অনেক সময় পুরো জীবনব্যাপী থেকে যেতে পারে। তরুণ কিংবা প্রাপ্তবয়স্কদের অপরাধ প্রবণতা বুঝতে হলে তাই আমাদের তাদের শৈশব বোঝা জরুরি।
আরও পড়ুন
আমরা যদি শিশু-কিশোরদের বিপথগামী আচরণের পেছনের ঝুঁকিপূর্ণ কারণগুলো সম্পর্কে সচেতন হই এবং সেগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি, তবে তাদের অপরাধ প্রবণতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা সম্ভব। আর তরুণ বয়স পর্যন্ত যদি মানুষ অপরাধ প্রবণতা থেকে মুক্ত থাকতে পারে তবে পরবর্তী জীবনে সেটি বহাল থাকার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। অর্থাৎ ভবিষ্যতেও অপরাধের পথে পা বাড়ানোর আশঙ্কা অনেকটাই কমে যায়।
পরিবারের ধরন, স্থানীয় এলাকার পরিবেশ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাঠামো এবং সঙ্গীদের প্রভাব অপ্রাপ্তবয়স্কদের মনে গভীর প্রভাব ফেলে। এর পাশাপাশি, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যগুলোও তাদের মানসিকতার গঠন প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখে। সামাজিক কাঠামোর বাহিরে শিশুদের লৈঙ্গিক পার্থক্য, জিনগত বৈচিত্র্য এবং জৈবিক নানা বৈশিষ্ট্যও তাদের মানসিক বিকাশে প্রভাব বিস্তার করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, পারিবারিক পরিসরে শিশু কোনো প্রতিকূলতার মুখোমুখি হলে তাদের অপরাধ প্রবণতা বাড়তে পারে। শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন, আবেগগত অবহেলা, পিতামাতার বিচ্ছেদ, পারিবারিক সহিংসতা, পরিবারের কারও মাদকাসক্তি বা মানসিক অসুস্থতা, এমনকি কারাগারে অন্তরীণ হওয়া—এ ধরনের পারিবারিক সমস্যাগুলোর সাথে শিশুদের বিচ্যুত আচরণের গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
অভিভাবকদের দুর্বলতা কিংবা বাবা-মা হিসেবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতাও অপ্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে বিচ্যুত আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। শিশুরা যদি পারিবারিক প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয় তবে তাদের মধ্যে বিচ্যুত আচরণের প্রকাশ ঘটে যা তাদের অন্য বিচ্যুত শিশু-কিশোরদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে সহায়তা করে। পারস্পরিক এই ধরনের মিথস্ক্রিয়া তাদের একটি অপরাধমূলক উপসংস্কৃতিতে আবদ্ধ করে ফেলে।
যেসব এলাকায় ভ্রাম্যমাণ মানুষের যাতায়াত বেশি, নাগরিক সুবিধার অভাব, অধিক দরিদ্র লোকের বসবাস, সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি এবং মাদকের সহজলভ্যতা রয়েছে সেসব এলাকা অন্য এলাকার তুলনায় বেশি অপরাধপ্রবণ হয়।
ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পায়। এর সাথে আরও যুক্ত হয় স্থানিক নানা বৈশিষ্ট্যের প্রভাব। যদি তাদের সঠিক সামাজিকীকরণ না হয় এবং তারা নিয়মতান্ত্রিক সামাজিক কাঠামোয় না থাকে তবে তাদের বিচ্যুত আচরণ আরও বেশি হয়।
যেসব এলাকায় ভ্রাম্যমাণ মানুষের যাতায়াত বেশি, নাগরিক সুবিধার অভাব, অধিক দরিদ্র লোকের বসবাস, সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি এবং মাদকের সহজলভ্যতা রয়েছে সেসব এলাকা অন্য এলাকার তুলনায় বেশি অপরাধপ্রবণ হয়। এই ধরনের এলাকায় বসবাসকারী শিশুদের মধ্যে তাই বিচ্যুত আচরণের সম্ভাবনা অন্যদের তুলনায় অধিক হয়।
উদাহরণস্বরূপ, শহরের বস্তি এলাকাগুলোর কথা বলা যেতে পারে, যেখানে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় কিশোর গ্যাং বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। পারিবারিক এবং আর্থসামাজিক নানা সমস্যা এই এলাকাগুলোর অপরাধপ্রবণ বৈশিষ্ট্যকে আরও তীব্র করে তোলে এবং সেখানকার কিশোর-তরুণদের অধিক মাত্রায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত করে।
শিশু-কিশোরদের করা বিচ্যুত আচরণ কিংবা অপরাধের মধ্যে কম গুরুতর থেকে অধিক গুরুতর নানা ধরণের কর্মকাণ্ড রয়েছে। মিথ্যা বলা, স্কুল পালানো, ছোটখাটো চুরি, অবাধ্যতা, অন্যকে বিরক্ত করা, সম্পত্তির ক্ষতি করা, ধূমপান, মাদক সেবন, অশ্লীল ভিডিও দেখা, মারামারি, আইন ভঙ্গ, গ্যাং সদস্য হওয়া, যানবাহন চুরি, অস্ত্র ব্যবহার, ছিনতাই, যৌন হেনস্থা, নরহত্যা প্রভৃতি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে এসব অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েরা জড়িত বলে গবেষণায় দেখা গিয়েছে।
আরও পড়ুন
এখন প্রশ্ন হলো, এসব কম বয়সী ছেলেমেয়েদের এসব বিচ্যুত আচরণ থেকে দূরে রাখার উপায় কী? এর উত্তর অল্প কথায় দেওয়া বেশ কঠিন। কারণ শিশু-কিশোরদের অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠার পেছনে বহুবিধ কারণ রয়েছে। এগুলোর মিথস্ক্রিয়া এবং পরিবার থেকে পাওয়া তাদের প্রাথমিক আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি একত্রিত হয়ে বিভিন্ন কমবয়সী শিশু-কিশোরদের ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় প্রভাবিত করে। অনেক সময় এই মিথস্ক্রিয়া তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা জাগিয়ে তোলে।
শিশু-কিশোরদের বিচ্যুত আচরণ প্রতিরোধ করতে পারিবারিক সচেতনতা, বিদ্যালয়কেন্দ্রিক উদ্যোগ এবং সামাজিক প্রচেষ্টাসহ বহুমুখী এবং সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। বিভিন্ন গবেষণায় এ বিষয়ক কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের কথা উঠে এসেছে।
শুরু থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ বাচ্চাদের শনাক্ত করার মাধ্যমে প্রাথমিক প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। শিশুদের রাগ নিয়ন্ত্রণের কৌশল শেখানো এবং সামাজিক দক্ষতা উন্নত করার মাধ্যমে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। একটি দীর্ঘমেয়াদি গবেষণায় দেখা যায়, প্রাথমিকভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে নীতিগত পরিবর্তনের মাধ্যমে খুব কার্যকরভাবে শিশু-কিশোরদের অপরাধ প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
শিশুদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অপরাধ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বিদ্যালয়ে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করে উদ্যোগ নেওয়া হলে এবং শিক্ষার পরিবেশ উন্নত করা হলে শিশুদের বিচ্যুত আচরণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং শিক্ষার্থীদের ওপর পিতামাতার সঠিক নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব নিশ্চিত করার মাধ্যমে এ প্রক্রিয়া আরও কার্যকর করা যেতে পারে।
শুরু থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ বাচ্চাদের শনাক্ত করার মাধ্যমে প্রাথমিক প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। শিশুদের রাগ নিয়ন্ত্রণের কৌশল শেখানো এবং সামাজিক দক্ষতা উন্নত করার মাধ্যমে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
তবে শিশুদের বিচ্যুত আচরণ এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে তাদের পারিবারিক পরিসরে অভিভাবকদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। অভিভাবকরা যদি শিশুদের জন্য নিরাপদ এবং সহানুভূতিশীল শৈশব নিশ্চিত করতে পারেন, তবে তা শিশুদের অপরাধ থেকে দূরে রাখার একটি শক্তিশালী উপায় হতে পারে। প্রতিবেশীদের সাথে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক থাকলে তাদের মধ্যে সামাজিক মূলধন তৈরি হয় যা শিশুদের অপরাধ প্রবণতা থেকে দূরে রাখতে সহায়ক হয়।
এর পাশাপাশি পরিবারের সদস্য এবং আত্মীয়-স্বজনদের সাথে যদি ভালো সম্পর্ক থাকে, আস্থার সম্পর্ক থাকে এবং তাদের প্রতি নৈতিক দায়বদ্ধতা থাকে তবে সেগুলো অপরাধ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। ইতিমধ্যে যারা বিভিন্ন বিচ্যুত আচরণের সাথে সংশ্লিষ্ট রয়েছে তাদের জন্য পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ধর্মীয় কাউন্সেলিং-এর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। মাদকাসক্তদের জন্য উপযুক্ত নিরাময় কেন্দ্র কিংবা গুরুতর অপরাধে জড়িতদের জন্য পৃথক ও কার্যকরী পুনর্বাসন কেন্দ্র তাদের সমাজে পুনর্বাসন করতে সহায়ক হতে পারে।
অপরাধবিজ্ঞানের অনেক বিখ্যাত তাত্ত্বিক শিশু-কিশোরদের অপরাধ প্রবণতার পেছনের কারণগুলো পরিপার্শ্বের সাথে গভীরভাবে যুক্ত বলে মনে করেছেন। দারিদ্র্য, বঞ্চনা, পারিবারিক অবহেলা এবং সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলো শিশুদের অল্প বয়স থেকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে স্বাভাবিক হিসেবে ভাবতে শেখায়।
এই প্রেক্ষিতে, সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করা এবং পারিবারিক কাঠামো সুসংঘবদ্ধ করা হলে শিশুদের অপরাধের পথ থেকে দূরে রাখা অনেক সহজ হবে বলে অনুমান করা যায়। আর যখন শিশু-কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা কমবে, নিশ্চিতভাবেই সেটি তরুণদের মধ্যেও অপরাধ প্রবণতা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
ড. মো. বশীর উদ্দীন খান ।। সহযোগী অধ্যাপক, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়