এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়!
১৯৮৬ সালে কবি হেলাল হাফিজের কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ প্রকাশিত হয়। সেই কাব্যগ্রন্থে কবি লিখেছিলেন, ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ মিছিলের সব হাত/কণ্ঠ/পা এক নয়/ সেখানে সংসারী থাকে, সংসার বিরাগী থাকে/ কেউ আসে রাজপথে সাজাতে সংসার/ কেউ আসে জ্বালিয়ে বা জ্বালাতে সংসার/ শাশ্বত শান্তির যারা তারাও যুদ্ধে আসে/ অবশ্য আসতে হয় মাঝে মধ্যে/ অস্তিত্বের প্রগাঢ় আহ্বানে/…এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’
অস্তিত্বের প্রগাঢ় আহ্বানে আসা আবাল, বৃদ্ধ, বণিতা যখন মিলিত হয় যুদ্ধের জোয়ারে, আনে রূপান্তর, আনে বদল, তিমিরের অন্ধকার কেটে আনে আলো, তাই তো তরুণরা বাসতে পারে ভালো, ইতিহাসে তাই তারুণ্যের উপস্থিতে বেশ জমকালো।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তারুণ্যের এ দুর্বার জোয়ার আমরা দেখেছি সময়ের নানান বাঁকে বাঁকে। তিউনিসিয়ার ২৬ বছর বয়সী এক যুবকের গায়ে আগুন দেওয়ার ঘটনা পুরো আরব বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল; গোটা আবরজুড়ে নিয়ে এসেছিল আরব বসন্তের হাওয়া। তারুণ্যে দুর্বার জোয়ারে উড়ে গেছে কত শত শাসক, প্রশাসক, রাজা ও মহারাজা।
তারুণ্যে দীপ্ত হাওয়ায় উড়ে গেছে কত সাদ্দাম কিংবা গাদ্দাফির মতো অজেয় শক্তি। সেই আরব বসন্তের হাত ধরে তাহরির স্কয়ার হয়ে উঠেছে দীপ্ত তারুণ্যের প্রদীপ্ত মোহনা। তাহরির স্কয়ার পরিণত হয় নিখিল বিশ্বের বিদ্রোহী, দেশপ্রেমী, সমাজ সংস্কারকামী, ন্যায্যাতা প্রতিষ্ঠায় নির্ভীক এবং বৈষম্যবিরোধী তরুণ-যুবার তীর্থস্থান।
এমনকি দিল্লির জন্তর-মন্তরও হয়ে ওঠে তারুণ্যের দুর্নিবার সাহসের অনিবার্য ঠিকানা। এক মেডিকেল কলেজ ছাত্রীকে চলন্ত গাড়িতে ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে দিল্লির জন্তর-মন্তর হয়ে ওঠে তারুণ্যের বাঁধভাঙা স্ফুলিঙ্গ। লাখো তরুণ-যুবার শিহরিত শ্লোগানে কেঁপে ওঠে দিল্লির দরবার। তারুণ্যের শক্তি এমনই।
এভাবে তারুণ্য জেগেছে সময়ের ডাকে, ইতিহাসের নানান বাঁকে এবং জীবনের সীমাহীন সম্ভাবনার জয়গানে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন আমাদের আর দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ তারুণ্যকে দাবায়ে রাখা যায় না।
আরও পড়ুন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘সুপ্রভাত’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী,/‘ভয় নাই, ওরে ভয় নাই-/নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান/ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে মাস্টারদা সূর্য সেন, ক্ষুদিরাম বসু, অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের কীর্তিগাঁথা আজও শিহরিত করে মন। তারুণ্য যখন নিঃশেষে প্রাণ দিতে প্রস্তুত তখন তার আর ক্ষয় নেই। আমাদের জাতীয় জীবনেও এর অসংখ্য দৃষ্টান্ত আছে।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন আমাদের তরুণ-যুবকদের ‘নিঃশেষে প্রাণ’ উৎসর্গ করার এক গৌরবোজ্জ্বল ক্যানভাসের নাম। নিজের জীবন দিয়ে, রক্ত দিয়ে মায়ের মুখের ভাষা রক্ষার জন্য, মাতৃভাষার জন্য এবং মায়ের মুখের ভাষার মর্যাদা রক্ষার গৌরবোজ্জ্বল বর্ণনা পৃথিবীর ইতিহাসের পাতায় বিরল।
এভাবে তারুণ্য জেগেছে সময়ের ডাকে, ইতিহাসের নানান বাঁকে এবং জীবনের সীমাহীন সম্ভাবনার জয়গানে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন আমাদের আর দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ তারুণ্যকে দাবায়ে রাখা যায় না।
সালাম, বরকত, জব্বার, রফিক, শফিউল, আউয়াল আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের সাহসী ঠিকানা; আমাদের দেশপ্রেমের উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং আমাদের অমর-অক্ষয়-বীরোচিত ভাষা শহীদ। তারা শিখিয়েছে কীভাবে জীবন দিয়ে, রক্ত দিয়ে লিখতে হয় ইতিহাস।
১৯৬২ সালের পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা আন্দোলন ছিল শরীফ কমিশনের রিপোর্টের বিরুদ্ধে। পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের কাছে সুপারিশকৃত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্ররা বিশেষ করে ঢাকা কলেজের ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করে। সে আন্দোলনে নিহত হয় বাবুল, গোলাম মোস্তফা ও ওয়াজিউল্লাহ। এটাও তারুণ্যের রক্তে লেখা ইতিহাস।
এভাবেই ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলন আমাদের শিখিয়েছে কীভাবে সময়ের প্রয়োজনে বুক সাহস সঞ্চয় করে দাঁড়াতে হয়। কীভাবে প্রতিকুল পরিবেশে জীবনকে বাজি রেখে নির্মাণ করতে হয় ইতিহাস। একইভাবে ১৯৬৯ সালে সংঘটিত ছাত্র-জনতার বিপুল জোয়ারের মাধ্যমে বিরাট গণঅভ্যুত্থান আমাদের ইতিহাসে বড় অর্জন হিসেবে এখনো সমুজ্জ্বল মর্যাদায় লিখিত আছে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় যা বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম দেয়। এ মুক্তিযুদ্ধও ছাত্র-জনতার অকুতোভয় জীবনযুদ্ধের এক অনবদ্য আলেখ্য।
১৯৯০ সালের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনও তারুণ্যের অপ্রতিরোধ্য জোয়ারের আরেক আলেখ্য। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ যা পুরো আন্দোলনের নিউক্লিয়াস হিসেবে কাজ করেছে, সেটা ছিল প্রকারান্তরে তারুণ্যের বিজয়-কীর্তনের আরেক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।
শহীদ নূর হোসেনের বুকে-পিঠে লেখা ছিল—‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ যা হয়ে উঠেছে তারুণ্যের অকুতোভয় এবং নির্ভীক মানসিকতার এক উজ্জ্বল ফেস্টুন। এভাবেই তারুণ্য বারবার এসে দাঁড়িয়েছে ইতিহাসের ডাকে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় যা বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম দেয়। এ মুক্তিযুদ্ধও ছাত্র-জনতার অকুতোভয় জীবনযুদ্ধের এক অনবদ্য আলেখ্য।
আমরা দেখেছি ২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চের ভেতর দিয়ে তারুণ্যের আরেক গৌরবোজ্জ্বল উপাখ্যান। ইতিহাসের শুদ্ধিকরণের উপাখ্যান। তাই তো জাতীয় কবি নজরুল গেয়েছেন তারুণ্যের জয়গান।
কবি নজরুল নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘এই যৌবন জল-তরঙ্গ রোধিবি কি দিয়া বালির বাঁধ?/ কে রোধিবি এই জোয়ারের টান গগণে যখন উঠেছে চাঁদ?/…যে বান ডেকেছে প্রাণ-দরিয়ায়, মাঠে-ঘাটে-বাটে নেচেছে ঢল,/ জীর্ণ শাখায় বসিয়া শকুনি শাপ দিক তারে অনর্গল।/ সারস মরাল ছুটে আয় তোরা! ভাসিল কুলায় যে-বন্যায়/ সেই তরঙ্গ ঝাঁপায়ে দোল রে সর্বনাশের নীল দোলায়! (কবিতা : যৌবন-জল-তরঙ্গ)।
২০২৪ সালের তারুণ্যের জোয়ারও সেই দুর্বার তারুণ্যেরই ধারাবাহিকতা। আবু সাইদ, দীপ্ত দে এবং মুগ্ধের মতো শত তারুণ্যের জীবন উৎসর্গ তারুণ্যের ‘নিঃশেষে প্রাণ’ দান করার আরেক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রচনা করেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, সেটাই মুক্তিযুদ্ধের মূল দর্শন—সাম্য প্রতিষ্ঠা, সামাজিক ন্যায় বিচার ও মানবিক মর্যাদা।
আরও পড়ুন
সংবিধানে প্রস্তাবনাতেই লেখা আছে—‘যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’
অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ অর্জন যেন একটি সত্যিকার বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যেখানে ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ এবং ভাষা নির্বিশেষে সব মানুষ অধিকার নিয়ে সমমর্যাদার সহাবস্থান করতে পারে। শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের সক্ষমতা, সততা এবং শক্তির ওপর আমার পূর্ণ আস্থা আছে।
শেষ করবো, কাজী নজরুলের ইসলামের ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থের ‘প্রলয়োল্লাস’ কাব্যের কয়েকটি লাইন দিয়ে যেখানে কবি তরুণদের জয়ধ্বনি করতে আহ্বান জানিয়েছেন। যারা সব পুরাতনকে ভেঙে গড়তে জানে একটি সুন্দর সমাজ; একটি তিমির অন্ধকার কেটে আনতে পারে রাঙা সুপ্রভাত। কবি লিখেছেন, ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর।/ তোরা সব জয়ধ্বনি কর।।/ ঐ নতুনের কেতন ওড়ে কাল বোশেখীর ঝড়।/ তোরা সব জয়ধ্বনি কর।/ তোরা সব জয়ধ্বনি কর।।’
ড. রাহমান নাসির উদ্দিন ।। নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়