অস্থির সময়ে রবীন্দ্রনাথ কেন এত প্রাসঙ্গিক?
সারা বিশ্ব জুড়েই আজ বইছে করোনা লু হাওয়া। মনে হয় দুটো বিশ্বযুদ্ধেও মানুষ এতটা বিপর্যস্ত বোধ করেনি। নামে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হলেও সারা বিশ্বের আনাচে কানাচে তার চাপ ও তাপ পড়েনি। এর প্রভাব ছিল অনেকটাই আঞ্চলিক। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরও বিস্তৃত ছিল।
প্রযুক্তির প্রসারের কারণে আণবিক বোমায় মানবতা জ্বলে খার খার হয়ে গিয়েছিল। এই মহাযুদ্ধের সময় রবীন্দ্রনাথ বিশ্ব বিবেকের বড় কর্ণধার। তাই সভ্যতার সংকটে তিনি কাতর। শান্তির অন্বেষায় তিনি দারুণ তৎপর। জাপানের উগ্র জাতীয়তাবাদের তিনি ছিলেন বড় সমালোচক। তিনি দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পেয়েছিলেন এর পরিণতি কী হতে পারে।
রবীন্দ্রনাথ একই সঙ্গে পূর্ব ও পশ্চিমের সভ্যতা খুব কাছে থেকে দেখেছেন। দুটো বিশ্বযুদ্ধেরই তিনি সাক্ষী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেরও বহু আগেই তিনি বিশ্বায়ন এবং প্রযুক্তির বিকাশের গতি-প্রকৃতি খেয়াল করছিলেন।
আরও পড়ুন : অস্ত্র ও ছলনার বিরুদ্ধে মানুষে আস্থা রবীন্দ্রনাথের
শান্তিনিকেতন স্কুলকে তিনি বিশ্ব সভ্যতার ইতিবাচক বিকাশের জন্য বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করেছেন। পাশাপাশি শ্রীনিকেতন গড়ে তুলেছেন কুটির শিল্প ও সমবায়ের উন্নয়নের জন্য। একইভাবে পূর্ব-বাংলার কৃষকের উন্নয়নের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষির আধুনিকায়নের জন্য কত উদ্যোগই না তিনি গ্রহণ করেছেন।
পূর্ব-বাংলায় তার জমিদারিতে, বিশেষ করে পতিসরে, সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রজারাই ছিলেন মুসলমান। তাদের সাথে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল আত্মিক। তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য গড়ে তুলেছিলেন অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। মেয়েদের শিক্ষার ওপরও জোর দিয়েছিলেন ব্যাপকভাবে। কৃষির উন্নতির জন্য বিশেষ কৃষি গবেষণা ও সমবায় ব্যাংকও গড়ে তুলেছিলেন।
তিনি যেমন ইংল্যান্ডে বছর দেড়েক পড়াশোনা করেছেন তেমনি আবার কৈশোরেই পূর্ব-বাংলার গ্রামের মানুষের দুঃখ-বঞ্চনা দেখেছেন। দুই সভ্যতার শক্তিকেই তাই মানব কল্যাণে ব্যবহার করার জন্য শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন।
বরাবরই অসাম্প্রদায়িক রবীন্দ্রনাথ সম্প্রদায় নয়, সচেষ্ট সমাজের সক্রিয়তার ওপর বেশি আস্থা রেখেছিলেন। ঔপনিবেশিক সাম্প্রদায়িক বিভাজনের নীতির তিনি ঘোর বিরোধী ছিলেন। হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশেই একটি সমন্বিত শান্তিপূর্ণ সমাজের উন্নতি তার আরাধ্য ছিল। রাষ্ট্র নয় সমাজই ছিল তার কাছে মানুষের জন্য বড় আশ্রয়স্থল।
আরও পড়ুন : রবীন্দ্র ভাবনায় তারুণ্য
‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘হিন্দু ও মুসলমান সমাজের মাঝখানে এমন একটি সংযোগস্থল সৃষ্টি হইতেছিল যেখানে উভয় সমাজের সীমারেখা মিলিয়া আসিতেছিল; ...আমাদের দেশে সাধারণের মধ্যে নানা স্থানে ধর্ম ও আচার লইয়া যে-সকল ভাঙ্গাগড়া চলিতেছে শিক্ষিত-সম্প্রদায় তাহার কোনো খবর রাখে না। যদি রাখিতেন তো দেখিতেন, এখনো ভিতরে ভিতরে এই সামঞ্জস্য সাধনের সজীব প্রক্রিয়া বন্ধ নাই।’
মূলত শহুরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের উচ্চাভিলাষ এই সমন্বয়ের ধারাকে আর এগোতে দেয়নি। বরং সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে আরও উৎসাহিত করেছে। এই অশুভ ধারার বিষফল রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় তীব্রভাবে অনুভব করেন।
পূর্ব-বাংলার মুসলমান ও সাধারণ হিন্দুদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিকাশের আকাঙ্ক্ষার গভীরে না গিয়ে বাংলাকে এক রাখার আন্দোলন যে শেষ পর্যন্ত ধোপে টিকবে না তাও তিনি বুঝেছিলেন। তাই শিক্ষা ও সংস্কৃতির সুবাতাস বইয়ে দিয়ে সাম্প্রদায়িক এই বিভেদের মূলের কারণগুলো তিনি দূর করার কাজে বেশি সময় দিতে শুরু করেন।
আরও পড়ুন : বিতর্কিত রবীন্দ্রনাথ?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি দু’বার এসেছিলেন এবং তার সমন্বয় ভাবনার কথা বলে গেছেন। রাজনীতির নষ্ট হাওয়া শেষ পর্যন্ত তার সামাজিক সমন্বয় ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সেই আশা আর পূরণ হতে দেয়নি।
দেশ ভাগ হলো। ধর্ম রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত হলো। কত প্রাণ গেল। কত মানুষ শরণার্থী হয়ে নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে উন্মূল হলো। সেই দুঃখের কথা আমরা সবাই জানি।
অসাম্প্রদায়িক রবীন্দ্রনাথ সম্প্রদায় নয়, সচেষ্ট সমাজের সক্রিয়তার ওপর বেশি আস্থা রেখেছিলেন। ঔপনিবেশিক সাম্প্রদায়িক বিভাজনের নীতির তিনি ঘোর বিরোধী ছিলেন।
দীর্ঘ তেইশ বছর সংগ্রাম শেষে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ সৃষ্টি করেন। সংবিধানে ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার না করার লক্ষ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতি যুক্ত করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশে সামাজিক সমন্বয়বাদী সেই ধারা অনেকটাই বিপন্ন করে ফেলে পাকিস্তানপন্থী সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তি।
আরও পড়ুন : নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা
মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনৈতিক উত্থানও এই নষ্ট ধারায় হাওয়া দেয়। বঙ্গবন্ধু কন্যা অনেক কষ্ট করে সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক সমন্বয়ের ধারাকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করছেন। তা সত্ত্বেও ধর্মীয় উগ্রবাদীরা নানাভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে চেষ্টা করে। সামাজিক শান্তি বিনষ্টের চেষ্টা করে।
বর্তমান সরকার শক্ত হাতে এসব নষ্ট প্রচেষ্টা মোকাবিলা করে যাচ্ছে। তবে টেকসই শান্তির জন্য অসাম্প্রদায়িক চিন্তাকে সমাজের মনে গেঁথে দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। সেজন্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নয়ন অপরিহার্য। ঠিক যেমনটি ভেবেছিলেন বঙ্গবন্ধু। আর সে প্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন মূলত রবীন্দ্রনাথের কাছে।
এই সময়ে সমাজের মনটা খুবই অস্থির। এ সময় সমাজকে সচেষ্ট করা খুবই জরুরি। সারাদেশ, সারা পৃথিবীকে আজ এক হয়ে বাঁচার লড়াই করতে হবে। সভ্যতার এই সংকটকালে আজও তাই রবীন্দ্রনাথ সমান প্রাসঙ্গিক। আসুন সবাই রবীন্দ্রচিন্তার আলোকে সমাজকে সচেষ্ট ও মানবিক রাখার প্রচেষ্টা করি। মানবতার জয় হবেই। সবাই মিলেই আমাদের বাঁচার সংগ্রামে লিপ্ত থাকতে হবে।
ড. আতিউর রহমান ।। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক