প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে রবীন্দ্রনাথ
মৃত্যুর এত বছর পেরিয়ে গেছে এখনো রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রভাবনা আমাদের ভাবায়। কেন ভাবায়? ভাবায় একারণে যে রাষ্ট্রশক্তি অকারণে সাধারণ জনগণের ওপর বন্দুকের গুলি ছুড়ছে। ক্রমাগত গণতন্ত্রহীনতার চর্চা, সরকারের একগুঁয়েমি আচরণ, পীড়নমূলক আইন প্রয়োগ রাষ্ট্রকে রণক্ষেত্রে পরিণত করছে। শিখিয়ে দেওয়া বুলি ও জাতীয়তাবোধের ধোয়া তুলে সব ব্যর্থতাকে ঢেকে রাখার অপচেষ্টা চলছে।
এমন চেষ্টা রবীন্দ্রনাথের যুগেও চলেছিল। তাই এই মানুষটির জন্ম বা মৃত্যু দিবসে আমরা বাঙালিরা নতুন করে আবিষ্কার করি রবীন্দ্রনাথকে। ভরসা করি তার ওপর। রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন পীড়নমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও ফ্যাসিবাদী ধারণার বিরোধিতা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ এমন একজন সাহিত্যিক যিনি সত্যিকার অর্থে বহুমুখী প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন।
পৃথিবীর নানা প্রান্তে যখন কোনো নতুন বিষয়ে আন্দোলন সংগ্রাম অথবা সামাজিক ভাবনার জন্ম হয়েছে তখন খোঁজ নিয়ে দেখা যায় রবীন্দ্রনাথ সেই ভাবনা বেশ আগেই ভেবে রেখেছেন, এমনকি তার প্রয়োগও করেছেন। রবীন্দ্রনাথকে বিচার বা ব্যাখ্যা করতে গেলে যে ভুলটি আমাদের প্রথমেই হয় তা হলো রবীন্দ্রনাথ সর্বতোভাবে একজন সাহিত্যিক এটি আমরা মনে রাখি না। আমাদের কেবলই মনে হয় রবীন্দ্রনাথ ওমুক বিষয়ে কেন লেখেননি, তমুক বিষয়ে কেন কথা বলেননি।
অথচ রবীন্দ্রনাথ যেসব বিষয়ে লিখবেন না বা একজন মানুষের সব বিষয়ে লেখা উচিতও না অন্তত যা তার অভিজ্ঞতা ও পরিধির বাইরে সে কথাটি আমরা ভুলে যায়। সাহিত্যিক পরিচয় থেকে আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে রবীন্দ্রনাথ একজন কবি। আধুনিক সাহিত্যের সব স্তরে তার বিচরণ ঘটেছে সফলতার সাথে। একারণে শিক্ষিত সাহিত্যমোদি বাঙালি জন্ম বা মৃত্যু, রোগ বা শোক, আনন্দ বা বিষাদ সবক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ থেকে শক্তি নেন।
রবীন্দ্রনাথই একমাত্র ভারতীয় সাহিত্যিক যিনি ফ্যাসিবাদের ভয়ংকর রূপ প্রত্যক্ষ করে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। এমনকি ফ্যাসিবাদ বিরোধী লেখালেখিও করেছেন।
বর্ষবরণে রবীন্দ্রনাথ আমাদের সামনে এসে হাজির হন। বর্ষাবরণ ও বৃক্ষরোপণেও একই রবীন্দ্রনাথ সামনে এসে আহ্বান করেন। বাংলার ছয় ঋতুর সবক্ষেত্রেই রবীন্দ্রনাথ আমাদের আহ্বান করেন। আজকাল তাই প্রতিরোধ, প্রতিবাদ, প্রতিক্রিয়া ও নিপীড়নের বিরুদ্ধেও রবীন্দ্রনাথকে চাইলে ভরসা করতে পারি আমরা।
যা বলা হচ্ছিলো যে রবীন্দ্রনাথ মূলত কবি, ভাববাদী কবি। ফলে পৃথিবীর সব সংকট বা জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ কেন লেখেননি তা আলোচনা করা একেবারেই অবান্তর। কারণ রবীন্দ্রনাথ সবাইকে নিয়ে লিখতে পারতেন না, আর তিনি সব বিষয়ে আগ্রহও নিশ্চয়ই বোধ করতেন না।
তবে রবীন্দ্রনাথ তার অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞার আলো যেসব ব্যাপারে ফেলতে পেরেছেন তা নিয়ে তার কলম থেমে থাকেনি। রবীন্দ্রনাথকে দেখতে হয়েছে দুটো বিশ্বযুদ্ধ। দেখতে হয়েছে ফ্যাসিবাদী মুসোলিনির নিপীড়ন এবং দেখতে হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের দলকেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থা।
রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষ করেছেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন নানা দেশ দখলের তাণ্ডব। আর সারাজীবন দেখেছেন ব্রিটিশ বিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রাম। রাজনীতির নীতিবিবর্জিত কর্মকাণ্ডে রবীন্দ্রনাথ মুহূর্তের জন্যও চুপ করে থাকেননি। মোদ্দা কথাটি হলো রবীন্দ্রনাথকে যেভাবে বিশ্বকবি উপাধি দিয়ে কবির আড়ালে রবীন্দ্রনাথের বিদ্রোহী সত্তাকে ম্লান করে দেওয়া হয়েছে তা আর কারও ক্ষেত্রে হয়নি।
অথচ রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্ম বিদ্রোহে ভরপুর। রবীন্দ্রনাথ যেমন প্রেম-প্রকৃতির কথা বলেছেন তেমনি প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের কথাও বলেছেন তার সাহিত্যে। রবীন্দ্রনাথের পূজা ও প্রেম পর্যায়ের গানকে যেমন আলাদা করা কঠিন তেমনি তার কবিতা ও গানে স্বদেশপ্রেমের আড়ালে দ্রোহকে আলাদা করা কঠিন। একারণে আমি রবীন্দ্রনাথকে বিপ্লবী ও বিদ্রোহী কবিও বলবো। যদিও বিদ্রোহের কথা বললে বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলামের প্রসঙ্গ প্রথমেই চলে আসে। সেই পথ ধরে বলতে হবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ ও কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার সুর অনেকাংশে একই ঘরনার।
আজকের যুগেও আমরা রাষ্ট্র, রাজনীতি ও অন্যায় শাসনের নিপীড়নে বিক্ষুব্ধ। আমরা সেই বিরুদ্ধতার কারাগার ভাঙতে চাই। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—‘ওরে, চারিদিকে মোর/এ কী কারাগার ঘোর-/ভাঙ্ ভাঙ্ ভাঙ্ কারা,/আঘাতে আঘাত কর্।’
শুধু তাই নয় রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও উৎপীড়নের বিরুদ্ধে শুভ শক্তির জয়ের জন্য কান পেতে ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার বাহিনীর পরাজয়ের খবর শোনার জন্য বারবার তিনি নির্ম্মালা কুমারী মহলানবীশের কাছে খবর নিয়েছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। রবীন্দ্রনাথই একমাত্র ভারতীয় সাহিত্যিক যিনি ফ্যাসিবাদের ভয়ংকর রূপ প্রত্যক্ষ করে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। এমনকি ফ্যাসিবাদ বিরোধী লেখালেখিও করেছেন। যদিও রবীন্দ্রনাথ প্রথম দিকে মুসোলিনিকে চিনতে পারেননি কিন্তু যখনই তিনি জেনেছেন ও বুঝেছেন যে মুসোলিনি একজন চরম ফ্যাসিবাদী নেতা তখনই তিনি তার সব সাহায্য সহযোগিতা প্রত্যাখ্যান করেছেন।
অল্পকথায় ফ্যাসিবাদ হলো উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক ধারা যেখানে গণতন্ত্রের কোনো স্থান নেই। থাকলেও তা একনায়কতন্ত্রেরই ভিন্নরূপ। আর আমরা জানি রবীন্দ্রনাথ আজীবন বিশ্বমানবের সন্ধান করেছেন। তাই তিনি জাতীয়তাবাদী কট্টর চিন্তার প্রবল সমালোচক ছিলেন।
১৯১৯ সালে মুসোলিনি ইতালিতে ফ্যাসিস্ট পার্টির সূচনা করেন। এর নাম ছিল ইতালীয় ফ্যাসিস অফ কমব্যাট (Fasci Italiani di Combattimento)। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইতালিতে দারুণ অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছিল। একে একে সব রাষ্ট্রপ্রধান ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছিলেন। কমিউনিস্ট রাজনীতি ও সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতিও মানুষ বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিল। আর এই সময়ে দলে দলে মানুষ যোগ দিয়েছিল মুসোলিনির দলে।
এ সময় ১৯২২ সালে ইতালির রাজা ভিক্টর ইমান্যুয়েল বেনিতো মুসোলিনিকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দেন। এরপর কেবল ইতালি নয় বরং সারা পৃথিবী অনুভব করে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রনায়কের অসহনীয় কীর্তিকলাপ। পরিণতিতে লেগে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। রবীন্দ্রনাথ তার জীবদ্দশায় তিনবার ইতালি ভ্রমণ করেছিলেন।
প্রথমবার গিয়েছিলেন ১৮৮৭ সালে ১৭ বছর বয়সে। এরপর ১৯২৫ সালে, কিন্তু শরীর ভালো না থাকায় তিনি তখন অধ্যাপক ফর্মিকির উৎসাহিত আন্তরিকতা থাকার পরও দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছিলেন। পরের বছরই মুসোলিনির আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ ইতালি গিয়েছিলেন। এই ভ্রমণের পেছনে কাজ করেছিলেন বিশ্বভারতীর অধ্যাপক কার্লো ফার্মিকি।
রবীন্দ্রনাথ প্রথম দিকে ইতালিতে মুসোলিনির শাসন দেখে মুগ্ধ হলেও পরে বুঝতে পেরেছিলেন যে মুসোলিনি ক্রমেই একনায়কে পরিণত হয়েছেন। কবি রোমে ১৪ দিন ছিলেন। শেষদিন রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে অধ্যাপক বেনেদেত্তো ক্রোচকে কবির সাথে সাক্ষাৎ করতে দেওয়া হয়। ক্রোচে ফ্যাসিস্ট নীতির তীব্র সমালোচক ছিলেন বলে তাকে নেপলসে নজরবন্দি করে রাখা হয়েছিল।
এরপর কবি সুইজারল্যান্ডে এসে রোমাঁ রোলাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন। এই দুই ব্যক্তির সংস্পর্শে এসে রবীন্দ্রনাথ মুসোলিনির আসল রূপ চিনেছিলেন। এরপর মুসোলিনির বিরোধিতা করতে রবীন্দ্রনাথের এতটুকু সময়ও লাগেনি। কবি অ্যান্ড্রুজকে চিঠি লিখে মুসোলিনি সম্পর্কে তার মতামত জানালেন। সেই চিঠি ছাপা হয়েছিল ম্যানচেস্টার গার্ডেনে। মুসোলিনি এই পত্র পাঠ করে রবীন্দ্রনাথের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। ইতালীয় অধ্যাপক তুচ্চিকে সরিয়ে নেওয়া হলো শান্তিনিকেতন থেকে।
রবীন্দ্রনাথ ১৯২৬ সালের ৫ আগস্ট তার চিঠিতে লিখেছিলেন—‘ফ্যাসিবাদের কর্মপদ্ধতি ও নীতি সমগ্র মানবজাতির উদ্বেগের বিষয়। যে আন্দোলন নিষ্ঠুরভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে দমন করে, বিবেক বিরোধী কাজ করতে মানুষকে বাধ্য করে এবং হিংস্র রক্তাক্ত পথে চলে বা গোপনে অপরাধ সংঘটিত করে-সে আন্দোলনকে আমি সমর্থন করতে পারি এমন উদ্ভট চিন্তা আসার কোনো কারণ নেই। আমি বারবারই বলেছি, পশ্চিমের রাষ্ট্রগুলো সযত্নে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব লালন করে সারা পৃথিবীর সামনে ভয়াবহ বিপদের সৃষ্টি করেছে।’
শুধু এই প্রতিবাদ লিপি পাঠিয়ে রবীন্দ্রনাথ তার প্রতিবাদ শেষ করেননি নিজের আঁকা ছবিতে তিনি মুসোলিনির আগ্রাসী মনোভাবকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। মুসোলিনি ১৯৩৫ সালের ৩ অক্টোবর ইথিওপিয়ার রাজধানী আবসিনিয়া আক্রমণ করে। এর প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ‘আফ্রিকা’ নামক কবিতা রচনা করেন। সমগ্র ইউরোপের দখলদারি মনোভাবকে প্রবলভাবে তিনি আক্রমণ করেন।
জেনারেল ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্বে স্পেনে শুরু হয় ফ্যাসিস্ট অত্যাচার। সালটি ১৯৩৬। জার্মানি ও ইতালি সেনা পাঠিয়ে সরাসরি মদদ দিলো ফ্রাঙ্কোকে। বিদ্যালয়, হাসপাতাল সবখানে গুলিবর্ষণ করা হলো। স্পেনে গণতান্ত্রিক শক্তি পরাজিত হলো কিন্তু শুরু হলো দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ। স্পেনের এই ঘটনা যখন ঘটছে তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স পঁচাত্তর। সেঁজুতি কাব্যগ্রন্থের ‘চলতি ছবি’ কবিতায় ফ্যাসিস্ট শক্তির দখলদারিত্বের প্রতিবাদ করেছেন রবীন্দ্রনাথ।
১৯৩৭ সালের জুলাই মাসে চীন আক্রমণ করে বসলো জাপান। চীনের নানকিং ও ক্যান্টন শহরে ব্যাপক গোলাবর্ষণ করা হলো। প্রায় তিন লাখ মানুষ হত্যা করলো জাপানি সৈন্যরা। রবীন্দ্রনাথ এই আক্রমণের তীব্র সমালোচনা করলেন। রচনা করলেন ‘বুদ্ধভক্তি’ নামক কবিতা। ৭ পৌষ ১৩৪৪ বঙ্গব্দে শান্তিনিকেতনের প্রভাতী সম্ভাষণে রবীন্দ্রনাথ বললেন—‘আজ চীনে কত শিশু নারী, কত নিরপরাধ গ্রামের লোক দুর্গতিগ্রস্ত-যখন তার বর্ণনা পড়ি হৃৎকম্পন উপস্থিত হয়।’ কবি চীনের এই স্মৃতি স্মরণে রেখে শান্তিনিকেতনে চীনা ভবন তৈরি করেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয় ১১ নভেম্বর ১৯১৮ সালে আর বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হয় ২৩ ডিসেম্বর ১৯১৮। কবি শান্তি ও বিশ্বমৈত্রীর প্রতীক হিসেবে এই বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা তাকে প্রবলভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিলো। তার গানে তিনি দ্রোহের সুরে যুদ্ধের প্রতিবাদ করলেন—
‘বাধা দিলে বাধবে লড়াই, মরতে হবে।
পথ জুড়ে কী করবি বড়াই, সরতে হবে।।
লুঠ-করা ধন ক'রে জড়ো কে হতে চাস সবার বড়ো--
এক নিমেষে পথের ধুলায় পড়তে হবে।
নাড়া দিতে গিয়ে তোমায় নড়তে হবে।।’
এখনো দেশের যে শাসক অস্ত্রের মুখে আন্দোলন সংগ্রামকে বাধা দেয় সেখানেই সাধারণ সংগ্রামী জনতা লড়াই করে মরতেও ভয় করে না। শাসক জনগণকে নাড়াতে গেলে তাদের গদি যেন নড়ে ওঠে। এসব গানে রবীন্দ্রনাথ আজও প্রাসঙ্গিক।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা ও পরাধীন ভারতবর্ষের গ্লানি বিরাজমান সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ তার ‘সভ্যতার সংকট’-এ উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন—‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব। আশা করব, মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে। আর একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে।’
রবীন্দ্রনাথের বিদ্রোহ প্রকৃত অর্থে বুদ্ধি প্রধান বিদ্রোহ। যে কারণে দেখা যায় তার বিদ্রোহাত্মক চরিত্রগুলো সংলাপের মধ্য দিয়ে শোষকের মুখোমুখি দাঁড়াতে দ্বিধা করে না। আবার এ কারণে যুগে যুগে শোষক পরিবর্তিত হলেও এই বিদ্রোহ চিরকালীন শক্তি হিসেবে আমাদের সাহস জোগায়।
কবি যা চেয়েছিলেন তাই হয়েছে। কেবল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কেন পৃথিবীর সব মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রামে মানুষই রক্ষা করেছে মানুষকে। আর সাহস করে একবার অন্যায়কে অন্যায় বলার যে কথা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন তা সত্যি আজও আমাদের সাহস জোগাবে।
‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া
বুকের মধ্যে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া।’
শেষ করি সমসাময়িক ঘটনার প্রেক্ষিত রবীন্দ্রনাথের নাটকের কথা দিয়ে। ‘মুক্তধারা’ নাটকে রবীন্দ্রনাথ উজানের পানি আটকে রাখাকে অনৈতিক বলেছেন। রবীন্দ্রনাথের এই দর্শনে ভারত-চীন উভয়ই বাংলাদেশের কাছে দোষী। ‘মুক্তধারা’ নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগীর কথা যেন বহু প্রতিবাদের মূল সুরটিকে ধারণ করে আছে—‘ওরে ভীতু, মার এড়াবার জন্য তোরা হয় মরতে নয় পালাতে থাকিস, দুটো একই কথা। দুটোতেই পশুর দলে ভেড়ায়, পশুপতির দেখা মেলে না।’
রণজিৎ যখন জানতে চেয়েছে যে ধনঞ্জয় সব প্রজাদের খেপিয়ে দিয়েছে। তখন অবলীলায় সে স্বীকার করেছে—‘খ্যাপাই বৈকি নিজেও খেপি।’ আবার ‘রক্তকরবী’ নাটকে কিশোর রাজার শোষণ ও মারের মুখেও নন্দিনীকে ফুল এনে দেয়। রাজার সামনে ধনঞ্জয়ের এমন অকপট স্বীকারোক্তি রাজাকে তার ভুলটি ধরিয়ে দেয়। আবার নন্দিনী রাজাকে ভয় আর ভালোবাসার ফারাকটা বুঝতে শেখায়। রাজাকে মানুষ জুজুর মতো ভয় করলে রাজার লজ্জা পাওয়া উচিত নন্দিনী সরাসরি রাজাকে একথাই বলেছে।
আবার এও বলেছে শ্রীকণ্ঠ যাত্রার রাক্ষসের সাজ তাকে দেখে ছেলের দল ভয় পায় আর রাক্ষস আনন্দ পায়। রাজাও কি নিজেকে তেমন রাক্ষস ভাবে? নন্দিনী সরাসরি রাজাকে বলে—আমার কী মনে হয় সত্যি বলব? রাগ করবে না? নেপথ্যে-কী বলো দেখি। নন্দিনী-ভয় দেখাবার ব্যবসা এখানকার মানুষের। তোমাকে তাই তারা জাল দিয়ে ঘিরে অদ্ভুত সাজিয়ে রেখেছে। এই জুজুর পুতুল সেজে থাকতে লজ্জা করে না!
একজন রাষ্ট্রপ্রধানের আশেপাশে অনেক সময় এমন লোকই বসে থাকেন যারা রাজাকে নানা কুপরামর্শ দিয়ে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেন। এক অদ্ভুত জনভাবনাহীন রাজাতে পরিণত হন তিনি। কখনো কখনো ক্ষমতার দম্ভ রাজাকে আনন্দের অনুভূতি দেয়। কেবল নিজেকে আমিত্বের অহংকারে সবাইকে পদানত করতে চায়। কিন্তু সফল ও সৎ শাসক নিজে রাজা হতে চায় না, সবাইকে রাজা বানাতে চায়। নিজের মত অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয় না বরং সবার মতামতের ভিত্তিতে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়। এ কারণেই গানে রবীন্দ্রনাথ সেই বিদ্রোহকেই প্রকাশ করেন—
‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে
আমরা নই বাঁধা নই দাসের রাজার ত্রাসের দাসত্বে’
রবীন্দ্রনাথ হিজলি বন্দিশালায় প্রহরীদের গুলিতে নিহত বিপ্লবীর মৃত্যুতে প্রতিবাদী জনসভায় সভাপতিত্ব করেন। এমনকি আন্দামানে বন্দি বিপ্লবীদের মুক্তির আন্দোলনেও সামিল ছিলেন তিনি। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড যেখানে হাজারখানেক লোকের মৃত্যু হয়েছিল সেই খবর পেয়ে রবীন্দ্রনাথ গান্ধী ও চিত্তরঞ্জনকে জানিয়েছিলেন প্রতিবাদ সমাবেশ করতে।
কেউ রাজি না থাকলে তিনি নিজেই সমাবেশে সভাপতিত্ব করবেন। কিন্তু তিনি এই দুই নেতার কারও সমর্থন পাননি। ফলে ইংরেজদের দেওয়া নাইট উপাধি ত্যাগ করেছেন। ইংরেজ সরকারের সামরিক শাসন ও নিরস্ত্র মানুষ হত্যার প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ এভাবে প্রতিবাদ করেছিলেন। আজও আমাদের দেশে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করা হয়। আজও কেউ না কেউ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পায় কিন্তু পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়ার লোকের বড্ড অভাব। এই রবীন্দ্রনাথ আমাদের প্রতিরোধ করতে শেখান, সত্যে আহ্বান করেন।
রবীন্দ্রনাথের বিদ্রোহ প্রকৃত অর্থে বুদ্ধি প্রধান বিদ্রোহ। যে কারণে দেখা যায় তার বিদ্রোহাত্মক চরিত্রগুলো সংলাপের মধ্য দিয়ে শোষকের মুখোমুখি দাঁড়াতে দ্বিধা করে না। আবার এ কারণে যুগে যুগে শোষক পরিবর্তিত হলেও এই বিদ্রোহ চিরকালীন শক্তি হিসেবে আমাদের সাহস জোগায়। ফ্যাসিস্টের জবাবের উপযুক্ত জবাব যে পাল্টা আক্রমণ রবীন্দ্রনাথ শেষদিকে তাই বুঝেছিলেন। এ কারণে তার প্রান্তিক কবিতায় বলেছেন—
‘নাগিনীরা চারি দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস,
শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস--
বিদায় নেবার আগে তাই
ডাক দিয়ে যাই
দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে
প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে।’
আমরাও কি সেই আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণের মধ্যে পড়ে খেই হারিয়ে ফেলবো নাকি নতুন পথের দিশা পাবো?
সঞ্জয় সরকার ।। সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়