নরেন্দ্র মোদির তৃতীয় মেয়াদ এবং বিরোধী জোটের চ্যালেঞ্জ
ভারতের লোকসভা নির্বাচনে 'আবকি বার ৪০০ পার (Abki Bar 400 Paar)' অর্থাৎ চারশ’র বেশি আসনে জয়ের বিষয়ে প্রত্যয়ী ছিল বিজেপি। কিন্তু এই পর্যন্ত ঘোষিত ব্যালট বলছে, বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ ২৯২ আসনে জয়ী হয়েছে, আর প্রধান বিরোধী দল ভারতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে 'ইন্ডিয়া' জোট পেয়েছে ২৩৩ আসন।
ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে প্রয়োজন ২৭২ আসন। সেই হিসাবে, এনডিএ সরকার জোট গঠন করতে পারবে। কিন্তু, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় আর সরকার গঠন হচ্ছে না বিজেপির। কারণ এই পর্যন্ত ঘোষিত ফলে তারা ২৪০টি আসন পেয়েছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি একাই ৩০৩টি আসন পেয়েছিল। নির্বাচনী ফল ঘোষণায় এনডিএ জোট ৩০০-এর কাছাকাছি আসন পেতে চলেছে এটি প্রায় নিশ্চিত।
বিজেপির জন্য বড় দুঃসংবাদ হলো দুই লোকসভায় দলের একক যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল—এবার তা থাকছে না। ফলে জোটের দুই মিত্র দল—অন্ধ্রপ্রদেশ চন্দ্রবাবু নাইডুর তেলেগু দেশম পার্টি এবং বিহারে মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারের জনতা দল-ইউনাইটেড (জেডি–ইউ)-এর ওপর আরও নির্ভরশীলতা বাড়বে বিজেপির।
আরও পড়ুন
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তৃতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালন করবেন এটা যেমন ঠিক তেমনি ভারতের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক দৃশ্যপট আগের চেয়ে আরও গতিশীল এবং চ্যালেঞ্জিং হবে। ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ) জোট, যা প্রায় এক দশক ধরে ভারতীয় রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করেছে।
অন্যদিকে ইন্ডিয়া (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স) ব্লক এই নির্বাচনে আশ্চর্যজনকভাবে একটি শক্তিশালী জোট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই জোট, আঞ্চলিক এবং জাতীয় দলগুলোর একটি বৈচিত্র্যময় সমষ্টি যা বিজেপির জোটের বিরুদ্ধে একত্রিত হতে পেরেছে এবং একটি প্রতিযোগিতামূলক রাজনৈতিক পরিবেশের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
৪০০টিরও বেশি আসনের লক্ষ্য থাকা সত্ত্বেও, এনডিএ ২৯২টি আসনে জয় পেয়েছে এবং একটি আসনের ফলাফল এখনো বাকি রয়েছে। অন্যদিকে ইন্ডিয়া ব্লক ২৩৩টি আসনে জয়ী হয়েছে। এককভাবে বিজেপি ৩৭০টি আসনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল কিন্তু ২৪০টি আসনে জয়লাভ করে যা ভোট ফেরত জরিপের তুলনায় অনেক কম।
উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির হার, বেকারত্ব এবং একটি ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (এসএমই) সেক্টর চাপের সমস্যাগুলো মোদি প্রশাসনকে অবশ্যই সমাধান করতে হবে।
কংগ্রেস ৯৯টিরও বেশি আসন জিতেছে, যা ২০১৯ সালের ৫২টি আসনের তুলনায় অনেক বেশি। কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোটের ২৩৩টি'র বেশি আসনে জয়লাভ এই জোটের জন্য বড় অর্জন। একইসঙ্গে, তারা বেশকিছু সুবিধাও পাবে। পার্লামেন্টে সরকারের যেকোনো একপাক্ষিক বা একমুখী সিদ্ধান্তের বিরোধিতায় সুবিধা পাবে কংগ্রেস ও মিত্ররা। কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এটা প্রধানমন্ত্রীর (মোদি) জন্য শুধু রাজনৈতিক নয়, নৈতিক পরাজয়।’
এনডিএ জোট পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে ‘৪০০ পার’ বা ৪০০-এর চেয়ে বেশি আসন না পাওয়ায় নরেন্দ্র মোদির সরকারের জন্য বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। বিশেষ করে, সংবিধানে কোনো ধরনের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে। এই ধরনের সংস্কারের জন্য উচ্চকক্ষ (রাজ্যসভা) ও নিম্নকক্ষ (লোকসভা), উভয় ক্ষেত্রেই দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও বেশিরভাগ রাজ্যেরই সমর্থন প্রয়োজন।
আরও পড়ুন
এক দশকে বিরোধীদলীয় নেতার পদ পায়নি কংগ্রেস। এই পদ কংগ্রেসকে বাড়তি সুবিধা এনে দেবে। সেই ক্ষেত্রে বিরোধী দল আরও বেশকিছু সংসদীয় কমিটিতে সভাপতিত্ব করতে পারবে এবং সরকারি কার্যক্রমের ওপর বাড়তি নজর রাখতে পারবে। এবারের ভোটের বিশেষত্ব হলো হাওয়াহীনতা।
২০১৪ ও ২০১৯ সালে আসমুদ্রহিমাচল নরেন্দ্র মোদির নামে ভেসে গিয়েছিল। জাতীয়তাবাদের নামে হিন্দুত্ববাদে ছেয়ে গিয়েছিল অধিকাংশ প্রদেশ। এবার তা অনুপস্থিত। এমনকি প্রাথমিক ফল বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, হিন্দি–বলয়েও রাম মন্দির ঢেউ তুলতে পারেনি। ভোটের প্রচারে বিরোধীরা বড় করে তুলে ধরেছিলেন তীব্র বেকারত্ব, অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ও সংবিধান–গণতন্ত্র রক্ষার বিষয়। প্রাথমিকভাবে দেখা যাচ্ছে, সেই প্রচার কাজে এসেছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদি তার তৃতীয় মেয়াদে যাত্রা শুরু করার সাথে সাথে, জাতি একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েছে। অর্থনৈতিক উদ্বেগ, সামাজিক ঐক্য এবং আঞ্চলিক প্রভাবের ভারসাম্য বজায় রেখে ক্ষমতা বিরোধী দলের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। একই সাথে, সরকার অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন, সামাজিক সংহতি বৃদ্ধি এবং অবকাঠামো উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
ভারতের অর্থনীতি কোভিড-১৯ মহামারি এবং বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সাথে অসংখ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির হার, বেকারত্ব এবং একটি ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (এসএমই) সেক্টর চাপের সমস্যাগুলো মোদি প্রশাসনকে অবশ্যই সমাধান করতে হবে।
অন্যদিকে, ভারতের বৈচিত্র্যময় সামাজিক কাঠামো একতা ও সম্প্রীতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে অনন্য চ্যালেঞ্জ উপস্থাপন করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা এবং আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বিভাজন দেখা গেছে, যা মোদি সরকারকে অবশ্যই একটি সমন্বিত সমাজ নিশ্চিত করতে সমাধান করতে হবে।
পাশাপাশি, যেকোনো দীর্ঘমেয়াদি সরকারের জন্য ক্ষমতাবিরোধী মনোভাব একটি সাধারণ চ্যালেঞ্জ। মোদির তৃতীয় মেয়াদ বিভিন্ন মহল থেকে যাচাই-বাছাই এবং সমালোচনার সম্মুখীন হবে, যার জন্য শাসন ও জনসাধারণের অংশগ্রহণের জন্য একটি কৌশলগত পদ্ধতির প্রয়োজন হয়।
তৃতীয় মেয়াদে মোদির নেতৃত্বে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের গতিপথ একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র, কারণ এটি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগুলোর জন্য সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতের নেতা হিসেবে তার তৃতীয় মেয়াদ শুরু করার সাথে সাথে, দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতির গতিশীলতা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কগুলোর মধ্যে একটি হলো বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক। এই দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে শুধু দীর্ঘ সীমান্তই নয়, গভীর ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কও রয়েছে।
তৃতীয় মেয়াদে মোদির নেতৃত্বে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের গতিপথ একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র, কারণ এটি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগুলোর জন্য সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে। দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপ দ্রুত বিকশিত হচ্ছে, প্রধান শক্তিগুলো প্রভাব বিস্তারের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।
বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান এই প্রেক্ষাপটে একে একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত করে। মোদির তৃতীয় মেয়াদে বাংলাদেশের সাথে একটি ভারসাম্যপূর্ণ এবং গঠনমূলক সম্পর্ক গড়ে তোলার পাশাপাশি ভারতের স্বার্থ রক্ষার জন্য জটিল ভূ-রাজনৈতিক গতিশীলতা নেভিগেট করা জড়িত থাকবে।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে পানি বণ্টন আলোচিত এবং সমালোচিত ইস্যু, বিশেষ করে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং তিস্তার মতো নদী নিয়ে। পানি বণ্টন চুক্তি উভয় দেশের লাখ লাখ মানুষের জীবিকার জন্য অত্যাবশ্যক। মোদির তৃতীয় মেয়াদ আলোচনা এবং সহযোগিতার মাধ্যমে এই বিরোধগুলো পুনর্বিবেচনা এবং সমাধান করার একটি সুযোগ উপস্থাপন করবে।
আরও পড়ুন
যদিও পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুনরায় বিজয়ী হওয়ায় এই সমস্যা সমাধানকে জটিল করবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার তৃতীয় মেয়াদে যাত্রা শুরু করার সাথে সাথে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ভবিষ্যৎ অপার প্রতিশ্রুতি এবং সম্ভাবনা রয়েছে।
দুই দেশের মধ্যে ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীর সহযোগিতা ও সহযোগিতার জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি প্রদান করে। যাই হোক, বাণিজ্য, সংযোগ, নিরাপত্তা, পানি ভাগাভাগি, সীমান্ত হত্যা এবং ভূ-রাজনৈতিক গতিশীলতা সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জগুলো সক্রিয়ভাবে মোকাবিলা করা দরকার।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদির তৃতীয় মেয়াদ ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ উভয়ই উপস্থাপন করবে। অর্থনৈতিক উদ্বেগ, সামাজিক ঐক্য এবং আঞ্চলিক প্রভাব হলো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র যার জন্য কৌশলগত মনোযোগ এবং কার্যকর নীতি প্রয়োজন।
একই সময়ে, অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন অনুসরণ করা, সামাজিক সংহতি বৃদ্ধি করা এবং পরিকাঠামো উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা ভারতের অগ্রগতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন, স্বচ্ছ শাসন এবং কৌশলগত আন্তর্জাতিক রাজনীতির ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, মোদির তৃতীয় মেয়াদে ভারতকে স্থিতিস্থাপক এবং সমৃদ্ধ দেশে রূপান্তরিত করার সম্ভাবনা রয়েছে।
অধ্যাপক ড. সুজিত কুমার দত্ত ।। সভাপতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]