ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহ্বানকারীদের আসল স্বরূপ কী?
প্রথম কিছু রাজনৈতিক এতিম বা উগ্রবাদী পূর্ব-পুরুষদের সূত্রে প্রাপ্ত মনোজগতের দ্বারা তাড়িত হয়ে ভারত বর্জনের ডাক নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠকে গরম করতে চাইলেও বৃহত্তর মানুষ তাতে ভ্রুক্ষেপ করেনি। মানুষ তা উড়িয়ে দিয়েছে এই বলে যে, পাগলে কিনা বলে। কিন্তু ওই এতিম বা উগ্রবাদীদের সঙ্গে বিএনপিকে যোগ দিতে দেখে কিছু মানুষ বিস্ময় প্রকাশ করেছে।
আমি বলেছি এতে বিস্ময় প্রকাশ করার কিছু নেই, এইটাই বিএনপির স্বাভাবিক রাজনীতি। পাকিস্তানের অনুকরণ ‘দ্য কনকোয়েস্ট অব হ্যাপিনেস (The Conquest of Happiness)’ গ্রন্থের এক জায়গায় বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছেন, কোনো রাজনৈতিক পক্ষ অথবা শাসক গোষ্ঠী যখন জনআকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয় এবং নিজেদের ভাগ্য অন্বেষণে ব্যস্ত থাকে তখন তারা কৃত্রিম শত্রু তৈরির মাধ্যমে জনমানুষের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে নিবিষ্ট রাখার চেষ্টা করে। এত হাঁকডাক ও আন্দোলন-সংগ্রামের চরম ব্যর্থতাকে ঢাকা দেওয়ার জন্য বিএনপি এখন বলছে যত দোষ নন্দ ঘোষ।
অর্থাৎ ভারতের কারণেই তারা আওয়ামী লীগকে হটিয়ে ক্ষমতায় যেতে পারেনি। এদের ঠিকুজি নিলে দেখা যাবে এদের পূর্বসূরিরা হয় জামায়াতে ইসলামী আর নয়তো মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল। জামায়াতে ইসলামী অথবা মুসলিম লীগের রাজনীতির মূল অবলম্বনই ছিল ভারত বিদ্বেষ।
আরও পড়ুন
যে কথা বলে তারা ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছে তার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের মর্যাদাকে অবমাননা ও হেয় করা হয়েছে। তারা বলতে চাইছে ভারতই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। তার অর্থ কি এই দাঁড়ায় না যে, বিদেশি কোনো শক্তি বাংলাদেশের যেকোনো দলকে ক্ষমতায় আনতে পারে এবং ইচ্ছা করলে যেকোনো দলকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে? বাংলাদেশের মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো মূল্য নেই? এটা বাংলাদেশের মানুষের জন্য চরম অপমানের। এমন বক্তব্য কোনো দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে প্রত্যাশিত নয়। এটা চরম রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের প্রমাণ এবং দলীয় অসহায়ত্বের বহিঃপ্রকাশ।
নিজেদের ব্যর্থতার দোষ অন্যের ওপর চাপানোর অপচেষ্টা। কিন্তু শুধু একাত্তরে নয়, আরও একাধিকবার বাংলাদেশের মানুষ প্রমাণ করেছে ক্ষমতায় থাকা আর না থাকাটা সম্পূর্ণ বাংলাদেশের মানুষের ওপর নির্ভর করে, অন্য কোনো শক্তির ওপর নয়।
যদি বিদেশি শক্তি কোনো দলকে ক্ষমতায় আনতে পারত, তাহলে তো এবার বিএনপিরই ক্ষমতায় আসার কথা ছিল। কারণ, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে সবকিছু দেখে অনেকেরই মনে হয়েছে বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি এবার নির্ঘাত বিএনপিকে ক্ষমতায় বসাতে চাইছে।
...ঠিকুজি নিলে দেখা যাবে এদের পূর্বসূরিরা হয় জামায়াতে ইসলামী আর নয়তো মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল। জামায়াতে ইসলামী অথবা মুসলিম লীগের রাজনীতির মূল অবলম্বনই ছিল ভারত বিদ্বেষ।
তখন বিএনপি নেতাদের কথাবার্তায়ও তেমনটি মনে হয়েছে। এই দেশের জনমানুষই যে ক্ষমতার উৎস তা আরেকবার প্রমাণিত হয় ২০০৭-২০০৮ মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। তখনো মনে হয়েছিল বিদেশি পরাশক্তির আশীর্বাদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার যতদিন ইচ্ছা ক্ষমতায় থাকতে পারবে। কিন্তু বাংলাদেশের জনমানুষের ধাক্কায় তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও তাদের হোতারা সবকিছু ছেড়ে দিয়ে কোনোরকম প্রাণ নিয়ে বেঁচে গেছে।
তাই বাংলাদেশের মানুষই ক্ষমতার উৎস অন্য কেউ কিছু নয়। এবার আসি ভারতীয় পণ্যের কথায়। ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক কি বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থে, নাকি সাতচল্লিশের ভ্রান্ত অবাস্তব দ্বিজাতি তত্ত্বের উন্মাদনা ছড়াবার প্রয়াস। ভারত থেকে বাংলাদেশে যা আসে তার শতকরা প্রায় ৯৫ ভাগ খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্যজাতীয় পণ্য। চাল, গম, রসুন, পেঁয়াজসহ সবধরনের মশলাজাতীয় দ্রব্য কম সময়ে ও কম খরচে আসতে পারে বিধায় তুলনামূলকভাবে অনেক কম দামে তা বাংলাদেশের মানুষ পাচ্ছে।
আরও পড়ুন
এগুলো অন্য দেশ থেকে আনতে হলে বাংলাদেশের মানুষকে চার-পাঁচগুণ বেশি দাম দিয়ে কিনতে হবে। এটা তো এখন প্রায়শই দেখা যাচ্ছে যে, ভারত থেকে পেঁয়াজ-রসুন আসা বন্ধের খবর আসলেই রাতারাতি তার দাম বেড়ে যায়, আবার এগুলো আমদানির খবর বের হলেই সঙ্গে সঙ্গে দাম নেমে আসে।
ভারতের জিরা, তেজপাতা, দারুচিনি ইত্যাদি মসলা বাংলাদেশে না আসলে ওই বর্জনকারীদের রান্নাঘরও অচল হয়ে যাবে। সুতরাং ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থে নয়, এটা সাতচল্লিশের দ্বিজাতিতত্ত্বের ধারক-বাহক কিছু রাজনৈতিক ভবঘুরেদের অবাঞ্ছিত আস্ফালন। এতে বাংলাদেশের বৃহত্তর মানুষের কোনো সাড়া নেই।
আর বিএনপির কথা বলতে গেলে বলতে হবে ভারতবিদ্বেষী রাজনীতিকে অবলম্বন করেই বিএনপির রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয়েছে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের হাত ধরে। সেইজন্যই লেখার শুরুতে উল্লেখ করেছি বিএনপির ভারত বিদ্বেষ দেখে আমি বিন্দুমাত্র আশ্চর্য হয়নি। কারণ, এইটাই বিএনপির রাজনৈতিক ডিএনএ।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতাকালীন নেতা শাহ আজিজুর রহমান, মশিউর রহমান যাদু মিয়া, মির্জা গোলাম হাফিজ, আবদুল আলিম, কাজী জাফর, আবদুর রহমান বিশ্বাস তারা সবাই প্রত্যক্ষভাবে একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা অর্জনের বিরোধিতা করেছে। এদের ব্রেন চাইল্ড হচ্ছে বিএনপি। তারা একাত্তরে বলেছে, বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতা চায় না, ওটা ভারতের ষড়যন্ত্র।
মুক্তিযোদ্ধাদের তারা ভারতের অনুপ্রবেশকারী চরম দুশমন হিসেবে গণ্য করেছে। তাদের ভারত বিদ্বেষের সীমানা এতদূর ছড়িয়ে যায় যে, তারা মনে করে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে ভারত সহযোগিতা দিয়ে চরম অন্যায় কাজ করেছে। সেইজন্যই দেখা গেছে জিয়াউর রহমানের সময় এবং পরবর্তীতেও বিএনপি যখনই ক্ষমতায় এসেছে তখনই মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর চরম নির্যাতন নেমে এসেছে।
মুক্তিযোদ্ধাদের তারা ভারতের অনুপ্রবেশকারী চরম দুশমন হিসেবে গণ্য করেছে। তাদের ভারত বিদ্বেষের সীমানা এতদূর ছড়িয়ে যায় যে, তারা মনে করে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে ভারত সহযোগিতা দিয়ে চরম অন্যায় কাজ করেছে।
২০০১-২০০৬ মেয়াদে বিএনপি সরকারের মন্ত্রী আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ প্রকাশ্যে বলেছে, একাত্তরে কোনো মুক্তিযুদ্ধ হয়নি, ওটা ছিল ভারতের ষড়যন্ত্র। বিএনপির আরেক নেতা যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের ওরফে সাকা চৌধুরীর কথা সবাই জানেন। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে বিএনপি সরকার সাকা চৌধুরীকে কেবিনেট মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা করেছিল।
আরও পড়ুন
এই সাকা চৌধুরী প্রকাশ্যে জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকার অবমাননা করেছে। গাড়িতে জাতীয় পতাকাকে নির্দেশ করে সাংবাদিকদের বলেছে, ওই যে এক টুকরা নেকড়া, ওটা আমার ভালো লাগে না। ঔদ্ধত্যের সব সীমা লঙ্ঘন করে বলেছে, কোথা থেকে বিদেশি এক হিন্দুকে দিয়ে জাতীয় সংগীত লেখানো হয়েছে, বাংলাদেশে কি কোনো মানুষ ছিল না।
ভারত বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে গিয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বিরোধিতায় নেমে পড়ে বিধায় উপরোক্ত কথাগুলোর পুনরুল্লেখ করতে হলো। ভারতবিদ্বেষী রাজনীতিতে পাকিস্তান এবং এই দেশের জামায়াত ইসলামী-বিএনপি একই কাতারে, কোনো পার্থক্য নেই। আর তাই ২০০১-২০০৬ মেয়াদে জামায়াত-বিএনপি সরকারের মন্ত্রী নেতারা জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোয় যারা সশস্ত্র যুদ্ধ করছে তারা বিচ্ছিন্নদাতাবাদী নয়, তারা হচ্ছে স্বাধীনতাকামী।
সেই জন্যই দেখা যায় পাকিস্তানের স্বার্থে, পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতায় ২০০১-২০০৬ মেয়াদে জামায়াত-বিএনপি সরকার ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সব ধরনের সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়েছে। ২০০৪ সালের পহেলা এপ্রিল চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্রের চোরাচালান ধরা পড়ার পর তা সবাই জানতে পারেন।
সুতরাং আজকে যারা ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়ে মাঠে নেমেছে তাদের পরিচয় সবার জানা। তারা সবাই পুরোনো সেই জামায়াত-মুসলিম লীগের উত্তরসূরি। পাকিস্তান যেমন ২৩ বছর ভারতীয় জুজুর ভয় দেখিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে, তেমনি জামায়াত-বিএনপিও তখন বাংলাদেশের চাদর গায়ে দিয়ে ভারতীয় জুজুর ভয় দেখিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু তারা তাতে সফল হয়নি। কারণ, বাংলাদেশের মানুষ এদের ভালো করেই চেনে।
মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার (অব.) ।। রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
[email protected]