মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ব্যক্তিদের ফেরত পাঠানো যাবে তো?
মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ ওদের ভৌগোলিক সীমায় আর আটকে থাকছে না। আমাদের সীমানা ঘেঁষে বিদ্রোহী আরাকান আর্মির অবস্থান। ওরা গুলি ছুড়ছে সরকারি সেনাদের দিকে। সরকারি সেনারা মর্টার ছুড়ছে আরাকান আর্মির দিকে। আকাশ থেকেও গুলি করছে, বোমা ছুড়ছে।
মিয়ানমারের সাধারণ মানুষের প্রাণ যাচ্ছে। বুলেট গোলা এরা তো আর সীমানা চেনে না, সীমানা পেরিয়ে আমাদের অভ্যন্তরেও চলে আসছে। ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ বাংলাদেশে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে মিয়ানমার থেকে আসা মর্টার শেলের বিস্ফোরণে। সীমান্তে এখনো সংঘর্ষ চলছে, গোলাগুলি ঠিকই চলছে আমাদের সীমানায়। সেইসাথে আসছে শরণার্থীরাও।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে চেষ্টা করছেই। রোহিঙ্গা ছাড়াও অন্যান্য বিপন্ন মানুষও যুদ্ধের আঘাত থেকে বাঁচতে ছুটে আসছে বাংলাদেশের দিকে। সেইসাথে আসছে ওদের সামরিক আধাসামরিক বাহিনীর লোকেরাও।
আরও পড়ুন
আরাকান আর্মির সাথে টিকতে না পেরে ওদের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ১০৬ জন ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। আমাদের বাহিনীর কাছে অস্ত্রসমর্পণ করে আশ্রয় প্রার্থনা করেছে। যুদ্ধ ও সহিংসতা সংক্রান্ত জেনেভা চুক্তিসহ নানারকম প্রথাগত যেসব বিধিবিধান আছে সেই অনুযায়ী এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ এইসব আশ্রয়প্রার্থীকে ফিরিয়ে দিতে পারে না। ফলে মিয়ানমারের বেসামরিক নাগরিকদের আমরা সীমান্ত থেকে জোর করে তাড়িয়ে দিচ্ছি ঠিকই, কিন্তু বন্দুকধারী এইসব বাহিনীর সদস্যদের তো ফেরানো যাচ্ছে না।
মিয়ানমারের এইসব সীমান্তরক্ষীকে ফিরিয়ে দেওয়া খুবই অমানবিক হবে। এই মুহূর্তে ওরা মিয়ানমারে ফিরে গেলে ওদের হত্যা করা হবে। আরাকান আর্মির হাতে পড়লে ওরা তো মারবেই, সরকারি বাহিনীর হাতে পড়লে ওরাও এইসব সেনাদের হত্যা করবে।
আপনারা জানেন যে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই যুদ্ধ থেকে পালিয়ে আসা যুদ্ধ সংশ্লিষ্ট সব বাহিনীর সদস্যদের জন্যই গুরুতর অপরাধ। এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। যে সৈন্যটি প্রাণের ভয়ে আপনার ঘরে ঢুকেছে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য তাকে আপনি নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে থাকতে দেবেন? তা তো হয় না। কিন্তু সেই সাথে যে প্রশ্নটা আসে, তাহলে কি এইসব সৈন্যরা চিরকালের জন্যে আমাদের এখানেই থেকে যাবে? ওরা কি কখনো ফিরে যাবে না ওদের নিজেদের দেশে? গেলে কখন যাবে? কবে যাবে?
মিয়ানমারের সাথে সীমানা রয়েছে চীনের, থাইল্যান্ডের, ভারতের ও বাংলাদেশের। সীমানা পার হয়ে মিয়ানমারের অসংখ্য নাগরিক থাইল্যান্ডে ঢুকে গেছে। মিয়ানমারের নাগরিকদের এইরকম অনুপ্রবেশ নিয়ে থাইল্যান্ড আগে থেকেই সমস্যায় ছিল—সেই সমস্যা এখন আরও তীব্র হয়েছে।
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া এইসব সামরিক-বেসামরিক লোকজন কবে মিয়ানমারে ফেরত যাবে সেই প্রশ্নের উত্তর এই মুহূর্তে আমাদের কারও পক্ষেই দেওয়া সম্ভব নয়। প্রায় এগারো লাখের মতো রোহিঙ্গা আমাদের এখানে আছে ২০১৭ সাল থেকে। অল্প কিছুসংখ্যক বার্মিজ হিন্দু শরণার্থীও বাংলাদেশে আছে—যদিও ওরা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অংশ নয় বা রোহিঙ্গাদের সাথে ঠিক মৈত্রীভাবাপন্ন নয় তবু ওরাও রোহিঙ্গাদের সাথেই একই সময়ে এসেছে।
আক্রমণ বা যুদ্ধ পরিস্থিতি যখন হয়, তখন তো আসলে হিন্দু মুসলমান ভাগ শনাক্ত করে বিপদ আসে না। সব বেসামরিক মানুষই কোনো না কোনোভাবে বিপন্ন হয়। শুরুতে যে কথাটা একবার বলেছি—বুলেট যেমন সীমান্ত চীনে না, বুলেট তেমন হিন্দু-মুসলমানও চেনে না। একইরকম অবস্থা এখনো হচ্ছে মিয়ানামারের অভ্যন্তরে।
মিয়ানমারে জাতিগত সংঘাত, বিদ্রোহ, গেরিলা সংঘাত এইসব আগে থেকেই ছিল। মিয়ানমারের বর্তমান মিলিটারি জান্তা সরকার যখন থেকে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেছে, তার কয়েকদিন পর দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধরত বিদ্রোহী বাহিনীগুলো মিলে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স নামে একটা জোট করেছে।
আরও পড়ুন
সেই জোটের একটাই লক্ষ্য, বিদ্যমান সামরিক জান্তাকে উৎখাত করা। ২০২৩ সালের বর্ষা শেষ হওয়ার পর থেকেই ওরা সমন্বিত আক্রমণ পরিচালনা করছে সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে এবং উল্লেখযোগ্য সাফল্যও লাভ করেছে। বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর নিজেদের মধ্যে যে জাতিগত ও অন্যান্য বিভেদ ছিল, সেইসব বিভেদ ওরা আপাতত তুলে রেখেছে। এমনকি এটাও দেখা গেছে যে সংখ্যাগুরু মিয়ানমারের জনগোষ্ঠীর লোকজনও কেউ কেউ বিদ্রোহী বাহিনীর সাথে যুক্ত হচ্ছে।
বিদ্রোহীদের জোটবদ্ধ হয়ে আক্রমণের সূচনার কিছুদিন পরই জাতিসংঘ থেকে জানানো হয়েছে যে পাঁচ লাখ মানুষ এই অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের কারণে ঘরছাড়া হয়েছে। এটা ছিল ২০২৩ সালের অক্টোবরের বিবৃতি। এর পরেও তিন মাস সময় পার হয়েছে, এই সংখ্যা এখন অনেক বেড়েছে। মিয়ানমারের সাথে সীমানা রয়েছে চীনের, থাইল্যান্ডের, ভারতের ও বাংলাদেশের। সীমানা পার হয়ে মিয়ানমারের অসংখ্য নাগরিক থাইল্যান্ডে ঢুকে গেছে।
মিয়ানমারের নাগরিকদের এইরকম অনুপ্রবেশ নিয়ে থাইল্যান্ড আগে থেকেই সমস্যায় ছিল—সেই সমস্যা এখন আরও তীব্র হয়েছে। মাঝখানে ওরা কিছু মানুষ মিয়ানমারে পুশব্যাক করে দিয়েছে। তা তো খুবই অমানবিক কাজ। একদল লোক যারা নিরুপায় হয়ে প্রাণ বাঁচাতে আপনার দেশে এসে ঠাঁই নিয়েছে, ওদের এলাকায় প্রতিদিন বোমা পড়ছে বিমান থেকে, হেলিকপ্টার থেকে, মাটিতে গোলাগুলি বিনিময় তা তো আছেই—ওদের আপনি কী করে সেই মৃত্যু উপত্যকায় ফেরত পাঠাবেন?
....এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে মিয়ানমার থেকে একজন বাড়তি মানুষ সীমানা পার হয়ে এলেও আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ি—এদের ফেরত পাঠানো যাবে তো!
থাইল্যান্ডে এই নিয়ে ইতিমধ্যে বেশকিছু কাজ করেছে। ৩ ডিসেম্বর ২০২৩ ব্যাংকক পোস্ট রিপোর্ট করেছে যে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধের শরণার্থীদের গ্রহণ করার জন্য থাইল্যান্ড প্রস্তুত। সম্ভাব্য শরণার্থীদের জন্য ওরা শিবির প্রস্তুত করছে। এরপর ওরা মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সাথে একটা সমঝোতা করেছে।
ডিসেম্বরের শুরুতেই চীনের বেইজিং-এ থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পার্নপ্রি বাহিদধা-নুকারা (Parnpree Bahiddha-nukara) মিটিং করেছে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী থান সোয়ের সাথে। ফলপ্রসূ সভা। সেইখানে ওরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে মিয়ানমারের এইসব শরণার্থী বা ঘরছাড়া মানুষদের জন্য ওরা একটা যৌথ টাস্কফোর্স গঠন করবে।
দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সমিতি আশিয়ানের গৃহীত নীতি অনুযায়ী থাইল্যান্ড কাজ করছে, আশা করা হচ্ছে যে আশিয়ান দেশগুলোও থাইল্যান্ডের পাশে থাকবে। থাইল্যান্ড আবার বিদেশি বাহিনীগুলোর সাথেও আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক পর্যায়ে যোগাযোগ চলছে। ফলে থাইল্যান্ড অন্তত একটা বিষয় নিশ্চিত করেছে যে যুদ্ধের ফলাফল যাইই হোক, যুদ্ধের পর থাইল্যান্ড শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে পারবে।
আরও পড়ুন
এইদিক দিয়ে আমরা রয়েছি বিচিত্র পরিস্থিতিতে। আগে থেকেই প্রায় এগারো লাখ রোহিঙ্গা এসে বসে আছে। এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে মিয়ানমার থেকে একজন বাড়তি মানুষ সীমানা পার হয়ে এলেও আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ি—এদের ফেরত পাঠানো যাবে তো! এই অবস্থা থেকে একা একা তো আমরা আমাদের উদ্ধার করতে পারব না। সংকটটা যুগপৎ আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিকে।
মিয়ানমারের সাথে ছোট সম্ভাবনা আছে বলে এই আপদ আমাদের কাঁধে এসে পড়েছে। মানবিক কারণে আমরা ফেলতে পারছি না, আবার আমাদের অবস্থাও এমন না যে আমরা ওদের দীর্ঘদিন পুষতে পারব।
আমাদেরও কি এখন উচিত নয় কূটনৈতিক দৌড়ঝাঁপ শুরু করা যাতে করে আমাদের অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলো এবং বড় শক্তিশালী দেশগুলোর সঙ্গ যেন পাই। সেইসাথে মিয়ানমারের ভয়ার্ত পক্ষগুলোর সাথেও তো আমাদের আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক দুইরকম যোগাযোগই শুরু করে দেওয়া দরকার। যুদ্ধ শেষে যেন মিয়ানমারের এইসব মানুষ—হোক ওরা রোহিঙ্গা, কারেন, শান বা অন্য কোনো জনগোষ্ঠী—ওরা যেন নিজেদের ঘরে ফিরে যেতে পারে।
ইমতিয়াজ মাহমুদ ।। আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট