নববর্ষের পোশাকে বাঙালিয়ানা
মানুষের দৈনন্দিন জীবনে আনন্দ, উৎসব উদযাপন, উপহার বিতরণ, নতুন পোশাক এবং খাবার-দাবারে অতিথি আপ্যায়ন এক চিরন্তন ধারা। বাংলাদেশে ধর্মভেদে মূলত চার সম্প্রদায়ের বাঙালি জীবনে এর কোনো ব্যতিক্রম নেই। ক্রেতা, উদ্যোক্তা, পত্রপত্রিকা, ফ্যাশন-ট্রেন্ড ও আকাশ সংস্কৃতি-সবই মিলে এক উৎসব মুখর আবহ তৈরি করে ঈদের সময়ে। প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠান যারা পোশাক বিপণনে সম্পৃক্ত এবং তাদের ডিজাইন স্টুডিওতে এই আয়োজনে উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় জড়িত কারুশিল্পীরা সবাই কাজ ভেদে ২-৮ মাস পর্যন্ত ব্যস্ত থাকেন ‘নতুন’ সৃষ্টি করার পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নে।
ঈদের কেনাকাটায় ভোক্তারা অধীর আগ্রহে খুঁজতে থাকেন নতুন ভাবনার পোশাক। নিজের জন্য, পরিবারের জন্য ও প্রিয়জনকে উপহার দেওয়ার প্রয়োজনে তারা খোঁজেন একবোরেই অন্যরকম কিছু। কারণ সুপ্ত বাসনা থাকে, যেন তার সিদ্ধান্ত প্রশংসিত হয়। ক্রেতার আকাঙ্ক্ষা নতুন বলতে কোন বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তা এক অজানা রহস্য।
ডিজাইনারদের এই বিষয়টি অনুধাবনে যৌক্তিক প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় রাখতে হয়। অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ, বিশ্বায়নের পরিপ্রেক্ষিত এবং আগামী স্বপ্নের সৃজনশীল আলোর মধ্য দিয়ে তার পোশাকের বিষয়বস্তু, স্টাইল, রঙের কম্বিনেশন, প্রচলিত ও অপ্রচলিত উপকরণের প্রয়োজন ইত্যাদির সমন্বয় সাধন করতে হয়।
ঈদের বাজার তাই হয়ে ওঠে নতুন কিছু দেওয়া-নেওয়ার বৈচিত্র্যময় ক্ষেত্র। ক্রেতার ইচ্ছে পূরণের নেপথ্যে সবসময় ক্রিয়াশীল থাকে ডিজাইনার ও উদ্যোক্তাদের সম্মিলিত চিন্তার সৃজনশীল পরিকল্পনা। কনসেপ্ট, রঙ, কাপড়, নকশা ও কৌশলগত অলংকরণের প্রয়োগ এসবই দীর্ঘদিনের চর্চার পরিণত রূপ।
সময়ের মধ্য দিয়ে ডিজাইনার প্রায় উৎসবেই নতুন নতুন ভঙ্গিতে উপস্থাপন করেন নতুন ভাবনায় তৈরি পোশাক যা পরিবর্তিতে ভোক্তার মনোবাসনাকে তৃপ্ত করে। এসবই ঈদ উৎসবকে আরও প্রাণময় করে তোলে।
বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে পোশাকের পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়া কখনোই গতিহীন ছিল না। আমাদের সৃজনশীলতাকে উন্নয়নের ধারায় এবং বিশ্বজনীন কাঙ্ক্ষিত মানে নিজেদের কোনো এক সময় আমরা নিয়ে যেতে পারবো। এই উৎসবমুখী নতুন ভাবনার তাড়নায় সৃজনশীল স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে যদি স্বযত্নে লালন করি ও সঠিক পরিচর্চায় মনোযোগী হই তাহলে বাংলাদেশের ফ্যাশন ভাবনা সময়ের ধারায় একদিন বিশ্বমানের হয়ে উঠবে নিঃসন্দেহে।
সবার জীবনে নতুন পোশাক পরার দিনটি আনন্দ উৎসব, কিছু সুখের মুহুর্তের ও উদযাপনের নেপথ্য কারণ হয়ে থাকে। যখনই দিন গণনার হিসাবে একটি বিশেষ দিন সু-নির্দিষ্ট হয়ে যায় সে ভাবনা থেকেই—১লা বৈশাখের আগমন ঘটে। পুরুষের পোশাক পায়জামা পাঞ্জাবি কিংবা ধুতি-পাঞ্জাবি আর মেয়েদের স্ব-ঐতিহ্যের শাড়ি। সেই সময় পোশাকে বাঙালিয়ানা চর্চিত ঐতিহ্যের ধারায় অভিষিক্ত হয়ে যায়। মানুষের আগ্রহে বৈচিত্র্যের প্রতি রঙের বর্ণিলতায় শুধুমাত্র লাল সাদার প্রাধান্যের বিষয়টি নববর্ষে উদযাপনে সর্বজনীন ভাবনায় সুনির্দিষ্ট গতিময়তাকে চিহ্নিত করে। যার বহমান ধারাবাহিকতা অনস্বীকার্য।
বাংলাদেশে ঈদ, পূজা, একুশে ফেব্রুয়ারি, বসন্ত উৎসব, বিজয় দিবস, ভ্যালেন্টাইন ডে, ইত্যাদি বিষয়ে পোশাকে রঙের অবাধ স্বাধীনতা ও সুনির্দিষ্টতা চর্চার দু’ভাবেই প্রচলন রয়েছে। সেভাবে বৈশাখের আবাহনে বাঙালির ঐতিহ্যে, সংস্কৃতি এবং উৎসব উদযাপনের প্রতিটি পর্যায়ে শতভাগ না হলেও অনেক বেশি পরম্পরা, স্বকীয় জীবনধারা ও জাতিসত্তার প্রতি শ্রদ্ধার বিষয়ে মনোযোগী ভাবনা বৈশাখ উদযাপনে পরিলক্ষিত হয়েছে।
দেশের ফ্যাশন হাউসগুলো বৈশাখী পোশাকের সম্ভারটি সাজিয়ে তোলেন গভীর বিশ্বাসের আন্তরিক অনুভব থেকে। সর্বজনীন উৎসবে চারিদিকে দৃশ্যমান ছবিগুলো তখনই রচিত হয়ে যায়-যখনই পহেলা বৈশাখে সবার মাঝে বাঙালি পোশাকের বর্ণাঢ্য দৃষ্টিনন্দন ছবিটি সবার মুগ্ধতায় ভরে ওঠে এক অনির্বচনীয় আনন্দ আর উদযাপনের উচ্ছ্বাসে। যেখানে প্রতিফলিত হয় দেশজ ভাবনায় রচিত সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতীকী নকশাগুলো আরোহণ করার সচেতন ভাবনাটি।
বাঙালিয়ানায় পোশাক ভাবনার সচেতন বিষয়টি আজ সবার মনোযোগ ধারণ করতে পেরেছে। আগামীর বাংলাদেশে পোশাক সংস্কৃতির পরিবর্তনের ধারায় দেশজ ভাবনা কখনোই বিলুপ্তির অন্ধকারে হারিয়ে যাবে না। বৈশাখ উদযাপনের আলোকিত চিত্রটি এভাবেই প্রমাণিত হয়ে যায় চর্চার বহমানতায়।
চন্দ্রশেখর সাহা ।। গবেষক, বয়ন ও কারুশিল্প, নকশাবিদ