ডেঙ্গুতে মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না কেন?
ডেঙ্গুতে পর্যুদস্ত শহর, গ্রাম, গোটা দেশ। রাজধানীসহ সারাদেশের হাসপাতালগুলোয় মূল রোগী ডেঙ্গু। ডেঙ্গু রোগীর চাপে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। আক্রান্ত প্রিয়জনদের হাসপাতালে ভর্তির আকুতি চোখে পড়ার মতো। হাসপাতালে জায়গা পাওয়া নিয়েও চলেছে হাতাহাতি।
বাংলাদেশে ২০২৩ সালে ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ১৭০,৭৬৮। এর মধ্যে ঢাকা সিটির রোগী ৯৬,৬৪১ এবং ঢাকা সিটির বাইরে ৭৪,১২৭। মোট মৃত্যুর সংখ্যা ৮৩৯; ঢাকা সিটির মধ্যে ৫৭৪ এবং ঢাকা সিটির বাইরে ২৬৫ (টেবিল ১)। ১৮ সেপ্টেম্বরও ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হয়েছে ৩,০৮৪ জন রোগী।
করোনা মহামারি ছাড়া একদিনে তিন হাজার রোগী আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে এমন সংক্রামক রোগ বাংলাদেশে বিরল। কিন্তু ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে হয়েছে। রাজধানীর বাইরেও ক্রমাগত বেড়ে চলেছে রোগীর সংখ্যা, আগে যেখানে এককভাবে ঢাকায় প্রায় সব সংক্রমণ হতো এখন ঢাকা সিটি চাপা পড়ে গেছে ঢাকার বাইরের ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যায়।
আরও পড়ুন >>> ডেঙ্গু বিপর্যয় ও মানবিক মানুষের আকাল
১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা সিটির বাইরের রোগী ঢাকা সিটির দ্বিগুণেরও বেশি বা প্রায় তিনগুণ। বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদে ডেঙ্গুর থাবা বিশেষত প্রান্তিক মানুষদের নাভিশ্বাস তুলে ছাড়বে আগামী দিনগুলোয়।
টেবিল ১: বাংলাদেশের ডেঙ্গু চিত্র ২০২৩ (১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত) সূত্র : স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
করোনা মহামারি ছাড়া একদিনে তিন হাজার রোগী আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে এমন সংক্রামক রোগ বাংলাদেশে বিরল। কিন্তু ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে হয়েছে।
টেবিল ২: ঢাকা সিটি ও ঢাকা সিটির বাইরে একদিনের রোগীর চিত্র (১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩) সূত্র : স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
মৃত্যুর সংখ্যাও বেড়ে রেকর্ড করেছে। সিটি কর্পোরেশনগুলো নানা ব্যবস্থা নেওয়া সত্ত্বেও রোগীর সংখ্যা ও মৃত্যুর রাশটানা যাচ্ছে না। তাহলে কি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে?
আরও পড়ুন >>> শিশুরা কেন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়?
এতদিন মহানগরীগুলোর ২/৩ কোটি মানুষ ডেঙ্গু ঝুঁকিতে ছিল, সব জেলায় ছড়িয়ে পড়ায় এখন ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী হলো ১৬/১৭ কোটি। আগের ২/৩ কোটি ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীতে আমরা যদি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ না করতে পারি তা হলে ১৬/১৭ কোটি ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীতে আমরা কীভাবে তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো?
সেই ২০০০ সালে যে প্রথম ব্যাপকহারে ঢাকায় ডেঙ্গু হলো তারপর ২২ বছর কেটেছে, এখনো আমরা ডেঙ্গুর কাছে হেরে যাচ্ছি, এডিস মশা আমাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে, তার বিরুদ্ধে আমরা একটা নিয়ন্ত্রণ কাঠামো গড়ে তুলতে পারলাম না দুই দশকেও।
যখন ডেঙ্গু অনেক বেড়ে যায়, মিডিয়ায় হইচই শুরু হয়, তখন স্থানীয় সরকার, সিটি কর্পোরেশনের বাড়তি কিছু উদ্যোগ দেখা যায়, কিন্তু ততদিনে যা হওয়ার তা হয়েই যায়। মিডিয়ায় যখন কোনো বিষয় আলোচনায় আসে তখন তা ঘটে যাওয়ার পরে আসে। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।
মনে হচ্ছে প্রত্যেকবার আমরা শূন্য থেকে শুরু করি এবং বেলা শেষে আবার শূন্যতেই ফিরে যায়। কিন্তু এডিস মশা থেমে নেই, ঢাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পাশাপাশি এখন তারা সারা দেশে তাদের আস্তানা গেড়েছে, ছড়াচ্ছে ডেঙ্গু।
এডিস মশা আমাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে, তার বিরুদ্ধে আমরা একটা নিয়ন্ত্রণ কাঠামো গড়ে তুলতে পারলাম না দুই দশকেও...
ডেঙ্গু নগরায়ণের রোগ, বিশেষত অপরিকল্পিত নগরায়ণের। আমাদের নগরায়ণের উপাদানের মধ্যে আছে এডিস মশার প্রজনন স্থান। পাকা বাড়িঘর ও অন্যান্য স্থাপনা তৈরির সময় জমে থাকা স্বচ্ছ পানি এডিস মশার আঁতুড়ঘর।
আরও পড়ুন >>> মশার আচরণগত পরিবর্তন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বড় চ্যালেঞ্জ
নগরায়ণে গাড়ির চাকা বেশি ঘোরে, টায়ার পুরোনো হয়, ফেলে রাখা পুরোনো টায়ারে দিব্যি ঘরসংসার পাতে এডিস মশা। এখনকার জীবনে ব্যবহৃত হয় সীমাহীন ডিসপোজাবল প্লাস্টিক কন্টেইনার; পচে না, ধরে রাখে পানি যেখানে আরামে বংশবিস্তার করে এডিস।
সেই গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে দক্ষিণপূর্ব এশিয়া এবং ওশেনিয়া অঞ্চলে সংক্রমণের পর থেকে পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ডেঙ্গু।
বর্তমানে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে, একশত দেশ এই রোগে আক্রান্ত, প্রতিবছর ৪০ কোটির মতো মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে যাদের ১০ কোটির মতো মানুষের লক্ষণ প্রকাশ পায়।
এখন যত ডেঙ্গু সংক্রমণ হয়, তার ৭০ শতাংশের ঠিকানা আমাদের এই এশিয়া। ক্রমান্বয়ে নগরায়ণ আরও বাড়বে, নগরায়ণের বৈশিষ্ট্য গ্রামেও ছড়াবে।
তার সাথে যুক্ত হচ্ছে জলবায়ুতে উদ্ভট সব ঘটনা; শীতকালে শীত পড়ছে না, বর্ষার বৃষ্টি যাচ্ছে শীতকালে; দীর্ঘায়িত হচ্ছে ডেঙ্গুর সিজন। এত সব প্রতিকূলতায়, ব্যর্থতায় তাহলে ডেঙ্গুতে আমাদের ভবিষ্যৎ কী হতে যাচ্ছে?
অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ ।। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ; স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক