নীলিমা ইব্রাহিম ও বীরাঙ্গনার কথকতা
যুদ্ধ ফুরিয়ে যায়; ক্ষত কি ফুরায়? রক্তের দাগও হয়তো শুকিয়ে যায়, কিন্তু মনের দাগ? সহজে মোছে না। যুদ্ধ মানেই ক্ষতভরা মন ও শরীরের ইতিহাস; যুদ্ধ মানেই স্মৃতি ও সত্তার অবিরাম সংগ্রামের কথকতা। যুদ্ধ-আখ্যান পড়তে পড়তে ভিজে ওঠে চোখ আর কাগজের পৃষ্ঠা। হোক তা ‘আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি’, ‘স্মৃতি একাত্তর’ কিংবা ‘মুক্তিযুদ্ধের চিঠি’।
‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ বইটি পড়তে পড়তে মনে হয় যুদ্ধের ভেতরই আছি; নিরস্ত্র জনতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে সেনাদল, আছড়ে চূর্ণ করা হচ্ছে শিশুর মগজ, গুলির শব্দে প্রকম্পিত হচ্ছে জনপদ, বিশ্বাসঘাতকতার শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে যাচ্ছে দেশীয় দোসররা। ছিঁড়েখুঁড়ে টুকরো করা হচ্ছে নারীর শরীর।
বীরাঙ্গনার কথকতা পড়তে পড়তেই মনে হয় মুক্তিযুদ্ধের পরও যুদ্ধ ফুরিয়ে যায়নি। নীলিমা ইব্রাহিম আমাদের নিয়ে গিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের অন্য এক অধ্যায়ে; যেখানে বাংলার নারীরা স্বয়ং যুদ্ধের ময়দান; প্রতি মুহূর্তে যুদ্ধরত নারীর নিরস্ত্র শরীর। যুদ্ধশেষেও তাদের দাঁড়াতে হয়েছে সামাজিক যুদ্ধে—সতীত্বের অগ্নিপরীক্ষায়।
আরও পড়ুন >>> তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ?
বইটি পড়তে পড়তে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেইসব নারীর মুখ—যাদের প্রত্যেকে একেকটি ‘প্রতীকী বাংলাদেশ’; যাকে শোষণ করা হয়েছে, ধর্ষণ করা হয়েছে, লিঙ্গ নামক বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে; কিন্তু দমিয়ে রাখা যায়নি।
‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ আমাদের শুনিয়ে যায় ইতিহাসের এই সব অকথিত গল্প। এসব নিয়ে আমরা কানাঘুষা করেছি। রঙচঙ মাখিয়ে বীরাঙ্গনাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছি চারিত্রিক কলুষ। আমরা বোঝার চেষ্টা করিনি, ক্যাম্প, বাংকার আর সেনানিবাসে যৌনসন্ত্রাসের শিকার হওয়া নারীদের বেদনার্ত ভাষা। যদিও মহিমা আরোপ করে আমরা বলেছি ‘মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা।’ কিন্তু ইজ্জত ও শরীর বিনিময়যোগ্য বিষয় নয়; পাকিস্তানি সৈন্য আর রাজাকাররা যা করেছিল প্রশ্নাতীতভাবে তা ছিল লৈঙ্গিক সন্ত্রাস ও আক্রমণ।
পাকিস্তানি তাত্ত্বিক ও গবেষক একবাল আহমদ স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু, লাখ লাখ উদ্বাস্তু, হাজার হাজার নারী ধর্ষণ ও শিশুদের পিতৃহীন করার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের ভাঙন অনিবার্য হয়ে ওঠে।’ জন্মায় বাংলাদেশ।
নীলিমা ইব্রাহিম আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন লিঙ্গীয় নৃশংসতার রক্তাক্ত প্রতিচ্ছবি। ১৯৯৪ সালে তিনি লিখলেন ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’। দুটি খণ্ড বের হওয়ার পর বইটি সাদরে গৃহীত হলো। বীরাঙ্গনার বৃত্তান্তে পাওয়া গেল মেহেরজান, তারা, রীনা, শেফা, ময়না, ফাতেমা ও মিনার গল্প। সবার গল্পই প্রায় এক ও অখণ্ড।
সপ্তনারী কোথায়-কখন-কীভাবে যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। এক কাহিনি থেকে আরেক কাহিনিতে ঢোকার পর মনে হয় নারীটি কি তারা? নাকি মেহেরজান? তাদের প্রত্যেকে ধর্ষিত; প্রত্যেকেই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছেন; প্রত্যেকেই পেরিয়ে আসতে চেয়েছেন শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক সঙ্কট।
নীলিমা ইব্রাহিম লিখেছেন, ‘১৯৭২ সালে যুদ্ধজয়ের পর যখন পাকিস্তানি বন্দিরা ভারতের উদ্দেশ্যে এ ভূখণ্ড ত্যাগ করে, তখন আমি জানতে পারি প্রায় ত্রিশ-চল্লিশজন ধর্ষিত নারী এ বন্দিদের সঙ্গে দেশ ত্যাগ করছেন।’ সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নওসাবা শরাফী, ড. শরীফা খাতুনসহ তিনি সেনানিবাসে যান এবং ‘মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা’র মুখোমুখি হন। একই সময়ের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন বাসন্তী গুহঠাকুরতা।
আরও পড়ুন >> মৃত্যুঞ্জয়ী শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত
সমাজকল্যাণ করতে আসা বিদেশি খ্রিস্টানদের প্রসঙ্গে ‘একাত্তরের স্মৃতি (১৯৯১)’ বইয়ে তিনি লিখেছেন “ওরা এখানে আমাদের নির্যাতিতা মেয়েদের চিকিৎসা করবে। প্রয়োজন হলে abortion করবে। অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তানের দায় থেকে নারীকে মুক্তি দেবে। কিন্তু গর্ভধারণ সাত মাস অতিক্রম করলে তারা abortion করবে না—এটা তাদের ধর্মীয় ও মানবিক বিধিনিষেধ। এরকম রমণীরাই পরে ‘বীরাঙ্গনা’ নামে ভূষিত হয়েছিলেন।” মুক্তিযুদ্ধের ২৩ বছর পর নীলিমা ইব্রাহিম বিস্তৃতভাবে ভাগ করে নিয়েছেন একই রকম অভিজ্ঞতার ঝুলি।
পাকিস্তানি তাত্ত্বিক ও গবেষক একবাল আহমদ স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু, লাখ লাখ উদ্বাস্তু, হাজার হাজার নারী ধর্ষণ ও শিশুদের পিতৃহীন করার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের ভাঙন অনিবার্য হয়ে ওঠে।’ জন্মায় বাংলাদেশ।
নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে নীলিমা ইব্রাহিম আরও গভীরভাবে জানতে পারেন ‘নারকীয় বর্বরতার কাহিনি।’ সেইসব তথ্য, স্মৃতি ও বক্তব্য তিনি টুকে রাখতেন দিনপঞ্জিতে। ইচ্ছে ছিল জনসমাজে তুলে ধরবেন তাদের পরিচয়। কিন্তু সতর্ক ছিলেন। কারণ ‘এই স্পর্শকাতরতা আমাদের অবহেলা এবং ঘৃণা ও ধিক্কারের দান।’ তার সরল অর্থ হলো ‘বীরাঙ্গনা’ নামক অভিধা দিয়েছি ঠিকই, কিন্তু সেই শব্দধৃত ভাবনা ও ব্যক্তির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে পারিনি।
ভয়াবহতা এমনই যে, শত্রুকে বেছে নিতে হয়েছে জীবনসঙ্গী! পালাবার পথ নেই, গন্তব্য নেই, পুরুষতান্ত্রিক বাঙালি সমাজের সমর্থন নেই; আর তাই শত্রুর সঙ্গেই গড়তে হয়েছে শর্তহীন সন্ধি। এইরকম একটি আখ্যানের কথা শুনিয়েছেন মেহেরজান।
বাড়ি ছিল তার কাপাসিয়ায়। ইতিহাস তাকে ঠেলে নিয়ে গিয়েছে পাকিস্তানের করাচিতে। বিজয়ের আগের সন্ধ্যায় তিনি বিয়ে করেছেন ক্যাম্পের বয়স্ক হাবিলদার লায়েক খানকে। কারণটাও তার কাছে স্পষ্ট, ‘আমার সমাজ আমাকে নেবে না এ আমি জানি।’ তীব্র ক্ষোভে মেহেরজান বলে উঠেছিলেন, ‘প্রতিদিন চিড়িয়াখানার জীবের মতো আমাদের দেখবার জন্য দর্শনার্থীর ভিড় হবে। আপনি গর্বিত মুখে আমাকে দেখাবেন। কিন্তু তারপর আমার ভবিষ্যৎ কি হবে?’ আর তাই মেহেরজান দ্বিধা করেনি ষাট ছুঁইছুঁই পাঠান পুরুষ লায়েক খানকে জীবনের অন্তিম গন্তব্য হিসেবে বেছে নিতে।
আরও পড়ুন >>> আমরা কি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের পথে?
মেহেরজানের অনুমানগুলো সত্য হয়ে দেখা দিয়েছিল অন্য নারীদের জীবনে। মেয়ের ক্যাম্প-জীবন নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠেছে পরিবার। প্রবল স্নেহ থাকা সত্ত্বেও বাবা-মাকে আঁকড়ে ধরেছে সামাজিক ভীতি। দীর্ঘদিনের বিচ্ছেদ কাটিয়ে মেয়েকে ফিরে পেয়েও তারা ব্যানার্জীর বাবা বলতে পেরেছেন, ‘আজ তোমাকে আমি নিতে পারব না।’ ভাই বলতে পেরেছেন, ‘আমাদের ঠিকানায় চিঠি লিখবারও দরকার নেই। তুই তো ভালোই আছিস।’
অন্যদিকে স্বামী গ্রহণ করতে চায়নি স্ত্রীকে। মিনাকে শুনতে হয়েছে, ‘তুমি এখানে কেন? মরবার জায়গা পাওনি?’ শরীরী শুদ্ধতাকেন্দ্রিক এইসব নিগ্রহ সামাজিক সত্য আকারে আবির্ভূত হয়েছিল। অথচ ভাবা হয়নি একাত্তরে নিপীড়িত কোনো নারী নিজের ভাগ্য নিজে নির্ধারণ করে নেয়নি। সে কেবলই নিরীহ শিকার।
যুদ্ধ ও ধর্ষণ কী করে মনের ভেতর স্থায়ী ক্ষত তৈরি করতে পারে তার নজির পাচ্ছি ফাতেমার জবানিতে। সমাজের কাছে সে হয়ে উঠেছিল ‘ফতে পাগলী’। তারই হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ছোট ভাই পোনাকে আছড়ে মেরে ফেলা হয়েছিল। যুদ্ধের দাবানল নিভে গেলেও ফাতেমার মনের ভেতর ফিরে আসে ভাইয়ের মৃত্যু স্মৃতি। যুদ্ধের বহু বছর পর—যখন তার সংসার ও সন্ততিতে ভরপুর জীবন তখনো সে আনমনে ছুটে যায় বিহারি কলোনির দিকে; চিৎকার করে বলে, ‘এই যে এইখানে, আমার ছোট ভাই পোনাকে নাসির আলি আছড়ে মেরেছিল।’
‘The Wretched of the Earth’ বইয়ে ফ্রানৎস ফানো (Frantz Fanon) আলজেরিয় মুক্তিসংগ্রামের কিছু কেইস স্টাডি হাজির করেছিলেন। দেখিয়েছিলেন স্ত্রী ধর্ষিত হওয়ার পর একজন মুক্তিসংগ্রামী কী করে মানসিক বৈকল্যে আক্রান্ত হয়, দেখা দেয় যৌন-অক্ষমতা ও অবসাদ।
রাজনীতি ও মুক্তিসংগ্রাম বিষয়ক যেকোনো আলাপ তার কাছে হয়ে পড়ে অসহনীয়। চুপ থাকতে থাকতে এক সময় সংগ্রামী ব্যক্তির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে প্রকৃত অনুভূতি। তাকে খুঁজতে গিয়েই তার স্ত্রীকে ধর্ষণ করেছিল ফরাসি সেনারা। স্ত্রীর অপরাধ? স্বামী এবং তার সংগঠন বিষয়ে তিনি কোনো তথ্য দেননি ফরাসি সেনাদের।
আরও পড়ুন >>> সম্প্রীতি ফিরে আসার প্রত্যাশায়
মুক্তিসংগ্রামী ব্যক্তিটি মনে করেন, ‘এটা কোনো সাধারণ ধর্ষণ নয়, অন্য কিছু করতে না পারার জন্য নয়, ধর্ষকামী (sadist) কারণেও নয়... এই ধর্ষণটি ছিল একটি দুর্দমনীয় মহিলার ওপর ধর্ষণ, যে তার স্বামীর নিরাপত্তার জন্য যে-কোনো শাস্তি মাথা পেতে নিতে পারে।’ একই সঙ্গে তার মনে হয়, তার স্ত্রী ‘অপবিত্র’ হয়ে গেছে। তিনি ছিঁড়ে ফেলেন প্রিয়তম কন্যার ছবি; তিনি ভাবেন তার কন্যাও ‘অপবিত্র’ হয়ে গেছে। এক সময় বুঝতে পারেন, নারীটি তার সর্বস্ব দিয়ে তাকে বাঁচিয়েছে; তাছাড়া অনেক আলজেরিয় নারীর কোলে তিনি দেখতে পেয়েছেন ফরাসি সেনাদের সন্তান—এই নারীরা আরও বেশি ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছেন।
পুরুষের মনোবৈকল্যের কথা বাদ দিয়ে আমরা যদি প্রত্যক্ষ ভিকটিম হিসেবে নারীর কথা ভাবি, তাহলে নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারব, তার মনোজগতে কী ঘটছে! ধর্ষিত নারীর মনে হয়েছে, ‘আমি তো অপবিত্র হয়ে গেছি।’
বাংলাদেশের বীরাঙ্গনাদের মনের ভেতরও জমে উঠেছে ‘অপবিত্র’ হওয়ার অনুভূতি। বারবার স্নান করে পরিশুদ্ধ হতে চেয়েছেন তারা। অনিচ্ছুক গর্ভধারণের মতো মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতা তাদের নিক্ষেপ করেছে হতাশার অতল গহ্বরে। ডাক্তারের হাত ধরে মিনতির সুরে শেফা জানায়, ‘আমি এ পশুর বীজ দেহে রাখতে চাই না।’
নাৎসি শিবির থেকে বেঁচে ফেরা মানুষের মতো বীরাঙ্গনাদের অনেকেই হারিয়ে ফেলেছিল জীবনের অর্থ ও লক্ষ্য। তবু তারা ছুটে গেছেন জীবনের পরমার্থের দিকে। মনে পড়ে যায়, অস্ট্রিয়ান মনোবিদ ভিক্তোর ফ্রাঙ্কলকে। অসউইচের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে হত্যা করা হয়েছিল তার মাকে। স্ত্রী নিহত হয়েছিলেন অন্য এক নির্যাতন কেন্দ্রে।
ভয়াবহতা এমনই যে, শত্রুকে বেছে নিতে হয়েছে জীবনসঙ্গী! পালাবার পথ নেই, গন্তব্য নেই, পুরুষতান্ত্রিক বাঙালি সমাজের সমর্থন নেই; আর তাই শত্রুর সঙ্গেই গড়তে হয়েছে শর্তহীন সন্ধি। এইরকম একটি আখ্যানের কথা শুনিয়েছেন মেহেরজান।
ভিক্তোর ফ্রাঙ্কল খুব কাছ থেকে দেখেছেন মানুষের বিমানবিক দশা। ক্যাম্পের অভিজ্ঞতা ভরসা করে পরবর্তী কালে লিখেছিলেন ‘Man’s Search for Meaning (১৯৪৬)’। মূলত জীবনের অর্থ খুঁজেছিলেন তিনি, বিষাদ থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন। ক্যাম্প ফেরত বাংলাদেশের বিষাদগ্রস্ত বীরাঙ্গনারাও চেয়েছিল জীবনের অর্থ।
আর সবার মতোই তারা চেয়েছিল দেশ, স্বাধীনতা ও মুক্তি। বীরাঙ্গনাদের সবার কাম্য ছিল একটি পরিচয়; ‘বীরাঙ্গনা’ পরিচয় তাদের আপ্লুত ও আনন্দিত করেছে। বঙ্গবন্ধুকে তাদের মনে হয়েছে দেবদূত ও পিতা। পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার প্রবল আকুতি ছিল তাদের। তারা চেয়েছেন সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা, চেয়েছেন দৃঢ় পদক্ষেপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে। কিন্তু বাঙালি সমাজ সহজভাবে তাদের গ্রহণ করেনি।
আরও পড়ুন >>> প্যারী মোহন আদিত্য : অল্পশ্রুত মহান দেশপ্রেমিকের প্রতিকৃতি
পরিবারগুলোর বারবার জিজ্ঞাসার মুখোমুখি পড়তে হয়েছে। এই কারণেই একদিন তারা ব্যানার্জীকে হয়ে যেতে হয় মিসেস টি নিয়েলসেন। পরিবার পরিজনদের কাছে প্রত্যাখ্যাত হতে হতে তারা ব্যানার্জীকে ভাবতে হয়েছিল ‘আমার অতীত মৃত।’ বহু বছর বাদে বাংলাদেশে ঘুরে ফিরে যাওয়ার সময় তারার মনে হয়েছে, ‘আমি শুধু জানি, আসবার জন্য তারা ব্যানার্জী কাঁদবে, কিন্তু মিসেস টি. নিয়েলসেন নাড়ির বন্ধন কেটেই এবার ফিরে যাচ্ছে।’
বীরাঙ্গনাদের অনেকের জবানিতে শুনতে পাই, বাঙালির জাতীয়তাবাদী মুক্তিসংগ্রামে তারা অংশী হয়েছেন, মিছিল করেছেন। শেফা জানিয়েছেন, ‘৬৯-এর আন্দোলনের সময় আমি স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্রী; মিটিং, মিছিল, পিকেটিং করেই স্কুলের পড়াশোনা চালিয়েছি।’ তার লড়াই হয়ে উঠেছিল রাজনৈতিক। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে শরীর দিয়ে পাল্টা লড়াইকে মোকাবিলা করতে হয়েছিল।
দুঃখজনক হলো, দীর্ঘকাল এই সত্যকে উপেক্ষা করা হয়েছিল। চাপা পড়ে ছিল এই ইতিহাস। সত্যি কথা বলতে কি, ইতিহাসে নারীর অংশগ্রহণের বৃত্তান্ত হারিয়ে যায় পুরুষবাদী বীক্ষণের অস্বচ্ছ কুয়াশায়। ঠিক প্রশ্নটিই করেছিল তারা ব্যানার্জী, ‘আপা দেশ স্বাধীন হয়েছে, কেউ গাজী-কেউ শহীদ। কেউ বীরউত্তম, বীরশ্রেষ্ঠ, কেউ মন্ত্রী, কেউ রাষ্ট্রদূত সবার কতো সম্মান সুখ্যাতি আর আমি?’
ভারতীয় উপমহাদেশের সামগ্রিক ইতিহাসের প্রসঙ্গেও তোলা যায় একই প্রশ্ন। গান্ধী, জিন্নাহ, নেহেরু, আজাদ, সোহরাওয়ার্দীকে চিনি, কিন্তু ‘সরোজিনী নাইডু’রা আছেন ইতিহাসের কোন পাতায়?
যে-দেশচেতনা ও মাতৃবন্দনার ঐকতানে জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠে সেই জাতীয়তাবাদ কেন নারীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণের ইতিহাসকে উহ্য রাখে? ‘দেশমাতা’ একটি ভাব বা আইডিয়া। দেশমাতার শরীরে সহিংসতার চিহ্ন মোছার জন্য যুদ্ধ করলাম, অথচ জলজ্যান্ত প্রত্যক্ষ শরীরধারিণী নারীমূর্তির গায়ে লেগে থাকা নিপীড়নের চিহ্নকে দেখলাম ‘কলঙ্ক’ হিসেবে; জাতীয়তাবাদের এই পুরুষতান্ত্রিক দ্বৈততার দিকেও আঙুল তুলে প্রশ্ন করার অধিকার দেয় ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’।
নীলিমা ইব্রাহিম আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছেন ইতিহাসের এক অচেনা প্রবাহে। সাতটি চরিত্রের জীবনবয়ানে ফুটে উঠেছে বাংলাদেশের এক মহাকাব্যিক দলিল।
আরও পড়ুন >>> ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত : ভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশের ইতিহাস
প্রশ্ন হতে পারে, আমি বীরাঙ্গনা বলছি কি গল্প, না ইতিহাস? তথ্য ও সত্যের বস্তুনিষ্ঠতা নিয়েই বীরাঙ্গনাদের বয়ানে উপস্থাপিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। নীলিমা ইব্রাহিম কেবল চরিত্রগুলোর নাম বদলে দিয়েছেন। কখনো কখনো কথক মিশে গিয়েছেন চরিত্রের সঙ্গে। আত্মকথনের ভঙ্গিতে যে বয়ানের শুরু হয়েছে ‘আমি’ দিয়ে, সেই বয়ানের মাঝখানেই ঢুকে পড়েছে লেখক নীলিমা ইব্রাহিমের মন্তব্য; যেন কথক নিজেই বলছেন তারা, মিনা, ফাতেমার গল্প। প্রকৃতপক্ষে ‘আমি বীরাঙ্গনা’ বলছি একটি গল্পায়িত ইতিহাস, ফিকশনাইজড হিস্ট্রি। গল্প ও ইতিহাসের মেলবন্ধনে রচিত এই বইয়ের কাঠামো।
বইটি একাধারে পাঠ করা যায় একটি ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক রচনা হিসেবে। এই বই আমাদের চিনিয়ে দেয় পুরুষতান্ত্রিক বাঙালি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অধঃপতনের সূক্ষ্ম নিশানাগুলোও তিনি গেঁথে দিয়েছেন বইয়ের পাতায় পাতায়।
ইতিহাসে নারীর অংশগ্রহণের বৃত্তান্ত হারিয়ে যায় পুরুষবাদী বীক্ষণের অস্বচ্ছ কুয়াশায়। ঠিক প্রশ্নটিই করেছিল তারা ব্যানার্জী, ‘আপা দেশ স্বাধীন হয়েছে, কেউ গাজী-কেউ শহীদ। কেউ বীরউত্তম, বীরশ্রেষ্ঠ, কেউ মন্ত্রী, কেউ রাষ্ট্রদূত সবার কতো সম্মান সুখ্যাতি আর আমি?’
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, সামরিকায়ন, রাজাকার-আল বদরদের পুনর্বাসন প্রভৃতি প্রসঙ্গ উঠে এসেছে বীরাঙ্গনাদের বয়ানে। এমনকি এই বই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চারও এক ধরনের সমালোচনা। কারণ আমাদের অভ্যস্ত চোখে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রধানত পুরুষদের দ্বারা সংগঠিত ও সংঘটিত ঘটনা এবং পুরুষদের দ্বারা সম্পাদিত ও রচিত ইতিহাস। কিন্তু বাংলাদেশে কেন, পৃথিবীর কোনো ইতিহাসই লিঙ্গবিভাজিত দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষিত হতে পারে না।
ইতিহাসের স্বর সব সময়ই বহুমাত্রিক। নীলিমা ইব্রাহিম দেখিয়েছেন নারীর অভিজ্ঞতা ও বয়ানে মুক্তিযুদ্ধ কী। মার্কসবাদীরা বলেন, ইতিহাস হলো শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস। কিন্তু ইতিহাস একই সঙ্গে লৈঙ্গিক লড়াইয়েরও ইতিহাস।
মুক্তিযুদ্ধের অভিজাত ইতিহাসে বীরাঙ্গনারা হলেন নিম্নবর্গ। ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ নারীর লৈঙ্গিক সংগ্রামের গল্পগাঁথা প্রাণবন্তভাবে হাজির করতে সক্ষম। দেখতে পাই, বীরাঙ্গনারা কখনো হারতে হারতে জিতে গেছেন, কখনোবা জিততে জিততে হেরে গেছেন। এক মুহূর্তের জন্যেও দিশাহারা হননি; অশ্রু মুছতে মুছতে আগুনের শিখার মতো স্থির লক্ষ্য ধরে এগিয়ে গেছেন এবং সামাজিক সত্তায় নিজেদের ভূমিকা জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
নীলিমা ইব্রাহিম একজন গবেষক ও কথাসাহিত্যিক। কিন্তু তার সব কাজকে যেন ছাপিয়ে গিয়েছে ছোট্ট এই বই। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিষয়ক ক্লাসিক বইসমূহের তালিকায় স্থায়ী আসন পেয়েছে ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’।
আরও পড়ুন >>> বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশ চেয়েছিলেন
নীলিমার ইব্রাহিমের পর আরও অনেকে মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ ও আত্মত্যাগ বিষয়ক ইতিহাস লিখেছেন, ইতিহাস পরিবেশন করেছেন গল্পের আশ্রয়ে; কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন ইতিহাস রচনার পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে।
নীলিমা ইব্রাহিমের বইটি অনেকের ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। আমার অনুমান, স্মৃতির আলোয় যারা কথ্য-ইতিহাসকে বুঝতে চান কিংবা যারা নিম্নবর্গীয় লড়াই-সংগ্রাম ব্যাখ্যা করতে চান নারীবাদী সচেতনতায়, তাদের জন্য নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সরবরাহ করবে নারীর স্মৃতি ও সত্তার যুগলবন্দিত্বে গাঁথা বই ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’।
সুমন সাজ্জাদ ।। অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়