দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু কেন বিপজ্জনক?
ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার কারণে ডেঙ্গু জ্বর হয়; যা মশার মাধ্যমে মানুষের শরীরে ছড়ায়। মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক মানুষ ডেঙ্গু জ্বরের ঝুঁকিতে রয়েছেন। প্রতি বছর ৩৯০ মিলিয়ন লোক এই রোগে আক্রান্ত হন।
এই সংক্রমণগুলোর মধ্যে, ৯৬ মিলিয়ন লোকের মধ্যে ডেঙ্গুর উপসর্গ দেখা যায় এবং তাদের মধ্যে ৫ লাখ মানুষের অসুস্থতার তীব্রতার বেশি হওয়ার কারণে হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন হয়। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর মধ্যে ২.৫ শতাংশ মানুষ প্রাণ হারান।
পৃথিবীতে প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ১.৫ জন মানুষের মৃত্যুর জন্য ডেঙ্গু দায়ী। শুধুমাত্র থাইল্যান্ডেই, ২০১৯ সালে ১২৮,৪২১ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছেন, যার মধ্যে ১৩৩ জন মারা গেছেন। বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ১০১,৩০০ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন এবং তা দেশের ৬৪টি জেলায় ছড়িয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন >>> ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমরা ব্যর্থ কেন?
সরকারি হিসাবে ২০২২ ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৬২,৩২১ ও মৃত্যুর সংখ্যা ২৮১ জন। ২০২৩ সালেও ডেঙ্গুর ঊর্ধ্বগতি আমাদের আতঙ্কিত করছে।
ডেঙ্গু এডিস মশাবাহিত একটি ভাইরাসঘটিত জ্বর রোগ। বেশিরভাগ মানুষ ভুল করে বিশ্বাস করেন যে, ডেঙ্গু জ্বরের একটি মাত্র স্ট্রেইন আছে। এই বিপজ্জনক ভাইরাসের ৪টি স্বতন্ত্র স্ট্রেইন রয়েছে।
ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি স্ট্রেইন (ডেন-১, ২, ৩ ও ডেন-৪) এর যেকোনো একটি দিয়ে ডেঙ্গু জ্বর হতে পারে। আর এই ভাইরাস বহন করে এডিস ইজিপ্টি ও এডিস এলবোপিকটাস প্রজাতির মশা।
একবার একজন ব্যক্তি একটি স্ট্রেইনে আক্রান্ত হলে, তার শরীর শুধুমাত্র সেই ভাইরাসের স্ট্রেইনের জন্য একটি অনাক্রম্যতা তৈরি করে। এর মানে হলো একজন ব্যক্তি আরও তিনবার ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হতে পারেন। তাছাড়া, প্রতিটি ডেঙ্গু জ্বরের পুনঃসংক্রমণ আগের সংক্রমণের তুলনায় অনেক বেশি বিপজ্জনক।
ডেঙ্গু এডিস মশাবাহিত একটি ভাইরাসঘটিত জ্বর রোগ। বেশিরভাগ মানুষ ভুল করে বিশ্বাস করেন যে, ডেঙ্গু জ্বরের একটি মাত্র স্ট্রেইন আছে। এই বিপজ্জনক ভাইরাসের ৪টি স্বতন্ত্র স্ট্রেইন রয়েছে।
একজন মানুষ ডেঙ্গুর একটি স্ট্রেইন দিয়ে আক্রান্ত হলে একই টাইপ দিয়ে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি নেই তবে অন্য যেকোনো টাইপ দিয়ে তার দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু আক্রান্ত হতে পারে।
কোনো ব্যক্তি যখন একটি স্ট্রেইন দিয়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে যান তখন তার দেহে ওই টাইপের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। তাই একই স্ট্রেইন দিয়ে দ্বিতীয়বার আর আক্রান্ত হন না।
ধরুন, একজন ব্যক্তি ডেঙ্গু স্ট্রেইন-১ দিয়ে আক্রান্ত হলেন, ওই ব্যক্তি স্ট্রেইন-১ দিয়ে আর আক্রান্ত হবেন না। তিনি স্ট্রেইন-২, ৩, ৪ এর মধ্যে যেকোনো একটি দিয়ে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হতে পারেন। পুনরায় ডেঙ্গু জ্বরের সংক্রমণ ও মৃত্যু ঝুঁকি প্রথমের ডেঙ্গুর তুলনায় অনেক বেশি।
এডিস ইজিপ্টি স্বভাবগতভাবে গৃহপালিত ও নগর কেন্দ্রিক। এটি আমাদের ঘরের ভেতরে এবং এর কাছাকাছি থাকে। এজন্য এটিকে গৃহপালিত মশা বলা হয়ে থাকে। এডিস ইজিপ্টি মশা ডেঙ্গু বিস্তারে ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ ভূমিকা রাখে।
আরেকটি প্রজাতি এডিস এলবোপিকটাস, যাকে এশিয়ান টাইগার মশা বলা হয়। এটি বন্য বা গ্রামের মশা। বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামেই এই মশাটি রয়েছে। এই প্রজাতি ডেঙ্গু বিস্তারে ৫ থেকে ১০ শতাংশ ভূমিকা রাখে। এই মশা বিভিন্ন পাত্র ছাড়াও গাছগাছালি যুক্ত এলাকায় গাছের কোটর, কলাগাছের দুই পাতার মাঝখানে, কচুর পাতার মাঝখানে, কাটা বাঁশের গোড়ায় জমে থাকা পানিতে জন্মায়।
আরও পড়ুন >>> ডেঙ্গু : এত ভয়াবহ আকার ধারণ করল কেন?
নগরে এডিস ইজিপ্টি মশা জন্মানোর জন্য অন্যতম স্থান হলো ড্রাম, টায়ার, বালতি, যেকোনো ধরনের মাটির পাত্র, নির্মাণাধীন ভবনের লিফটের গর্ত, টাইলস ভেজানোর চৌবাচ্চা, কিউরিং-এর পানি জমার স্থান, বিশেষ করে বেজমেন্ট।
একজন ব্যক্তি আরও তিনবার ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হতে পারেন। তাছাড়া, প্রতিটি ডেঙ্গু জ্বরের পুনঃসংক্রমণ আগের সংক্রমণের তুলনায় অনেক বেশি বিপজ্জনক।
ডেঙ্গু জ্বরের সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই নেই তবে এমন কিছু উপায় আছে যা দিয়ে আমরা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমাতে পারি। মশা দিনে বা রাতে যেকোনো সময়ই কামড়াতে পারে। অতএব, আপনি যেখানেই থাকুন না কেন, মশার কামড়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক ব্যবহার করে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। সেইসাথে বাড়িতে বা পানির পাত্রে মশার বংশ বৃদ্ধির সুযোগ সীমিত করা উচিত।
আপনার বাড়ির আশেপাশে যদি মশা জন্মানোর মতো কোনো সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা থাকে বা কোনো নির্মাণাধীন দালান থাকে তাহলে তাদের অবহিত করুন। বাড়ির আশেপাশে গাছের গর্ত বা কাটা বাঁশের গোড়া মাটি দিয়ে বন্ধ করে দিন। কারণ গাছের কোটর বা বাঁশের গর্তে এডিস মশার জন্ম হয়।
দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশে ডেঙ্গু থাকার কারণে ইতিমধ্যে অনেক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। বর্তমান সময়ে ডেঙ্গু ঊর্ধ্বগতি, অনেকেই দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার ডেঙ্গুতে সংক্রমিত হচ্ছেন এবং হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আরও পড়ুন >>> মশার আচরণগত পরিবর্তন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বড় চ্যালেঞ্জ
আপনি বা আপনার পরিবারের কেউ দ্বিতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসায় থাকলে ডেঙ্গুতে মৃত্যু ঝুঁকি কম থাকে।
ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে সতর্ক, সচেতন এবং সম্পৃক্ত হোন। বাড়ির আশেপাশে পানি জমে থাকা পাত্র নিয়মিত পরিষ্কার রাখুন। মশার কামড় থেকে পরিবারের সবাইকে রক্ষা করুন এবং ডেঙ্গু মুক্ত থাকুন।
ড. কবিরুল বাশার ।। অধ্যাপক, কীটতত্ত্ববিদ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]