মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা ও আমাদের নির্বাচনব্যবস্থা
দেশের অভ্যন্তরে ও বাইরে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে কৌতূহল ও রাজনৈতিক চর্চার কোনো শেষ নেই। এই কারণে একদিকে দেশের অভ্যন্তরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপি তৎপরতা এবং এই দাবির প্রতি পশ্চিমা দূতাবাসগুলো কী করে তার প্রতি সবার আগ্রহ ছিল।
তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচনকে ট্যাগ করে যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে তার প্রতিও সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল। কিন্তু বিএনপিকে হতাশার সাগরে ডুবিয়ে মার্কিন ভিসানীতিতে নির্বাচনে সহিংসতা ও নির্বাচন বানচালকারীদেরও নিষেধাজ্ঞার আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে।
আর এগুলোই বিএনপির জন্য বিপদ ডেকে এনেছে! বিগত নবম এবং দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো বিএনপির লক্ষ্য ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া তারা কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। এজন্য বর্তমান সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে।
আরও পড়ুন >>> ভোটের রাজনীতি, জোটের রাজনীতি
এছাড়া তারা বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন হতে দেবে না। যদি আওয়ামী লীগ তা করতে উদ্যোগ নেয় তাহলে অতীতের মতো এবারেও পেট্রোল বোমা হামলা বা সহিংসতা ছড়িয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিঘ্ন সৃষ্টি করবে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত নীতি অনুসারে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিএনপির আপত্তি থাকলেও তাদের (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের) এবং গণতান্ত্রিক বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রের কোনো আপত্তি নেই।
এরই মধ্যে আবার গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনে অনুষ্ঠিত সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়লাভ করায় বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ‘ক্রেডিবিলিটি’ আরও একবার প্রমাণিত হয়েছে।
একাদশ জাতীয় সংসদ থেকে বিএনপির সাতজন সংসদ সদস্যের পদত্যাগের পর এই দলের আর কোনো সংসদ সদস্য অবশিষ্ট নেই। এখন একাদশ জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টি বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্য হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।
দেশের প্রথম সামরিক শাসক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অনড় অবস্থানে আছে। তাদের এই দাবির প্রতি সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে দলটি বিভিন্ন, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস এবং মার্কিন মুলুকেই তাৎপর্যপূর্ণভাবে অনেক দৌড়ঝাঁপ করেছে।
এইসব কৌতূহলের পরিপ্রেক্ষিতে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন আরও একবার প্রমাণ করেছে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়। অতীতের দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো বিরোধী মহল প্রচার করছিল যে নির্বাচিত দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। কিন্তু এই দাবি মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
আরও পড়ুন >>> ইভিএম ভীতি, ইভিএম রাজনীতি
সদ্য ঘোষিত ভিসা নীতির অধীনে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়া ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে মনে করা যেকোনো বাংলাদেশি ব্যক্তির জন্য ভিসা প্রদান সীমিত করতে সক্ষম হবে। এর মধ্যে বর্তমান ও প্রাক্তন বাংলাদেশি কর্মকর্তা, সরকার সমর্থক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং আইন প্রয়োগকারী, বিচার বিভাগ এবং নিরাপত্তা পরিসেবার সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৩ মে ২০২৩ বাংলাদেশ সরকারকে এই সিদ্ধান্তের কথা জানায়।
মার্কিন ভিসা নীতিতে বলা হয়েছে, ‘গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে এমন কর্মের মধ্যে রয়েছে ভোট কারচুপি, ভোটারদের ভয় দেখানো, সহিংসতার ব্যবহার, যাতে জনগণ তাদের সংগঠনের স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার প্রয়োগ করা থেকে বিরত রাখা এবং রাজনৈতিক দল, ভোটার, সুশীল সমাজ বা প্রতিরোধের জন্য পরিকল্পিত ব্যবস্থার ব্যবহার। মিডিয়া তাদের মতামত প্রচার থেকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব সব ভোটার, রাজনৈতিক দল, সরকার, নিরাপত্তা বাহিনী, সুশীল সমাজ এবং মিডিয়া।’
সাধারণভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কর্মকাণ্ডের প্রতি বাংলাদেশের একটি জন্মগত সন্দেহ রয়েছে। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিরা গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ প্রভৃতির শিকার হলেও পর্যবেক্ষকদের মতে তৎকালীন ‘নিক্সন প্রশাসনের একমাত্র ফোকাস ছিল, চীন।’
নিক্সন কেন ইয়াহিয়া খানের পক্ষে ছিলেন, তার সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ব্যতীত, আর একটি কারণ ছিল যে জেনারেল ইয়াহিয়া ছিলেন চীনের সাথে তার (কিসিঞ্জারের) বাহক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণের ভিত্তি স্থাপনে ইয়াহিয়া খান কার্যকরী গো-বিটুইন হয়ে উঠেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দ্বারা পরিচালিত বাঙালি গণহত্যার প্রতি আমেরিকা সরকারের সমর্থন ছিল। মুক্তিযুদ্ধকে মাঝপথে থামিয়ে দেওয়ার জন্য মার্কিন সপ্তম নৌবহর প্রেরণ করেছিল। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছিল ইত্যাদি।
আরও পড়ুন >>> ক্ষমতাবানদের পেছনে গড্ডলিকা
১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের ভূমিকা এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের রহস্যজনক ভূমিকা।
খুনিদের আশ্রয় প্রশ্রয়, এছাড়া বিএনপির সাম্প্রতিক তৎপরতার কারণে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে ক্ষমতায় এসে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা সৈনিকদের যে বিনা বিচারে হত্যা করেছিল সেই সত্যটিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সব মহলের সামনে চলে এসেছে। যা এতদিন গোপন ছিল।
এইসব পরিস্থিতি অতিক্রম করে সর্বশেষ আগামী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
অধ্যাপক অরুণ কুমার গোস্বামী ।। পরিচালক, সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ, ঢাকা; সাবেক ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, এবং সাবেক চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়