সূর্যোদয়ের বঙ্গবন্ধু
সুমহান বাঙালি জাতির অশেষ গৌরবের অন্যতম প্রধান অংশ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্মবৃত্তান্ত। শত-সহস্র বছরব্যাপী খণ্ড খণ্ড বাংলা এক অখণ্ড বাংলায় রূপ নিয়েছিল কখনো কখনো। স্বাধীনতা বা অধীনতায় তার খণ্ডিত রূপ-রস কখনো আত্মপ্রকাশ করেছে। আবার কখনো করেনি। সেই অপূর্ণ বাংলা কখনোই ভাষা বা সংস্কৃতির সম্পূর্ণ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারেনি। ফলে প্রত্ন বাংলা বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে সুগঠিত হয়নি। পাল আমল বা মোগল আমল কোনো আমলেই বাংলা জাতীয়তাবাদী চেতনাঋদ্ধ হয়ে ওঠেনি। শাসনে-শোষণে তা যূথবদ্ধ হয়েছে মাত্র।
এই বাংলাকে বাংলাদেশে রূপান্তরিত করা হয়েছিল ১৯৭১ সালে। ত্রিশ লাখ শহীদ, দুই লাখ নারীর সম্ভ্রম, দুই দশক বিস্তৃত আন্দোলন-সংগ্রাম, নয় মাসব্যাপী সশস্ত্র যুদ্ধ– এসবের অনিবার্য পরিণতি বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হওয়ার পর পৃথিবীতে আত্মপ্রকাশ করল বাংলা ভাষাভাষী বাঙালির একমাত্র রাষ্ট্র। বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা ওখানেই।
এই যে বাঙালির গৌরবদীপ্ত স্বাধীন আবাস, ইতিহাসখ্যাত বাংলাদেশ, তার জন্মদানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা কার? এ জিজ্ঞাসার নির্দ্বিধ উত্তর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি ঘুমন্ত শার্দূলদেরকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। যিনি সাহসে-দ্রোহে প্রোজ্জ্বল করেছিলেন বাঙালিকে।
বাঙালির গৌরবদীপ্ত স্বাধীন আবাস, ইতিহাসখ্যাত বাংলাদেশ, তার জন্মদানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা কার? এ জিজ্ঞাসার নির্দ্বিধ উত্তর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি ঘুমন্ত শার্দূলদেরকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। যিনি সাহসে-দ্রোহে প্রোজ্জ্বল করেছিলেন বাঙালিকে।
স্মর্তব্য বাঙালির ইতিহাস প্রত্ন ইতিহাস, যা শৌর্য-বীর্যে গর্বে-স্পর্ধায় সুপ্রাচীন। জানা যায়, প্রাচীনকালে যে জনপদের নাম ছিল পুণ্ড্র, বরেন্দ্র, সমতট, বঙ্গ, হরিকেল, বঙ্গাল ইত্যাদি তাদের একতাবদ্ধ জনপদটিই আজকের বাংলাদেশ। এ ভূখণ্ডের অধিকাংশ অধিবাসীর ভাষা বাংলা। আর এখানকার বাসিন্দা কোল, শবর, পুলিন্দ, হাঁড়ি, ডোম, চণ্ডালের সঙ্গে অপরাপর জাতি-গোষ্ঠীর সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে বাঙালি জাতি। অনার্য, আর্য-নিষাদ-দ্রাবিড় মিলে বাঙালি।
মহাবীর আলেকজান্ডারের সহযাত্রীদের রচনা এবং মহাভারতের কাহিনি বিশ্লেষণের মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায় যে মহাভারত পূর্বকালে বাঙালির অস্তিত্ব ছিল। তবে সে বাঙালি বহু খণ্ডিত ভূমিখণ্ডে অধিবাসী ছিল। তবে বাঙালি হিসেবে তাদের আত্মপরিচয় নির্ধারিত ছিল না। এই আত্মপরিচয়হীন বহু খণ্ডিত বাঙালিকে একতাবদ্ধ করে বাঙালি জাতি হিসেবে আত্মপরিচিত করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাদের সুনির্দিষ্ট আবাসের ঠিকানা দিয়েছেন তিনি। সে কারণেই তিনি বাঙালি জাতির পিতা এবং বাংলাদেশের স্থপতি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের (১৯২০-১৯৭৫) সমগ্র রাজনৈতিক জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে তিনি প্রধানত বাঙালি ও বাংলাদেশের জন্যই লড়াই-সংগ্রাম করেছেন। আপাদমস্তক একজন বাঙালি হয়ে বাঙালির অস্তিত্বের ঠিকানা নিশ্চিত করতে আন্দোলন করেছেন। বলা যায় বাঙালিকে নিয়ে বাঙালির জন্য লড়েছেন। তার সে লড়াই আপসহীন, বিচ্যুতিহীন এবং দ্রোহময়।
একটু পেছনে তাকালে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। ব্রিটিশ ভারতে তার রাজনীতিতে হাতেখড়ি। স্বভাবতই দাবি নিয়ে মাঠে-ময়দানে সোচ্চার হয়েছেন স্কুলজীবনে। মাধ্যমিক পাস করে যখন কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হয়েছেন, তখন পঞ্চাশের মন্বন্তরে বাংলা বিপন্ন ও বিবর্ণ। অসহায় নিরন্ন বাঙালির দুঃখ-কষ্ট তাকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছে। একজন মানবিক মানুষ হিসেবে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন নিজ জাতির ম্লান-মলিন দশা। তিনি সংক্ষুব্ধ হয়েছেন। চেয়েছেন বাঙালির মুক্তি। ব্রিটিশের ভারত ত্যাগ। স্বজাতির দুঃখ-দুর্দশা তাকে পীড়িত করেছে। ১৯৪৬ সালের মুসলিম লীগের প্রত্যক্ষ আন্দোলনের নামে ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ তাকে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। হিন্দু-মুসলমানের ভ্রাতৃঘাতী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভয়াবহতা তাকে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠে ধর্মনিরপেক্ষ মানুষে রূপান্তরিত করেছে। আবুল হাশিম, শরৎ বসু’র অখণ্ড স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলা ভাবনা তাকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করেছে। ১৯৪৮-১৯৪৯ সালে জিন্নাহ-নাজিমউদ্দিনের বাংলা ভাষা বিদ্বেষ তাকে রুষ্ট করেছে।
মহাবীর আলেকজান্ডারের সহযাত্রীদের রচনা এবং মহাভারতের কাহিনি বিশ্লেষণের মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায় যে মহাভারত পূর্বকালে বাঙালির অস্তিত্ব ছিল। তবে সে বাঙালি বহু খণ্ডিত ভূমিখণ্ডে অধিবাসী ছিল। তবে বাঙালি হিসেবে তাদের আত্মপরিচয় নির্ধারিত ছিল না। এই আত্মপরিচয়হীন বহু খণ্ডিত বাঙালিকে একতাবদ্ধ করে বাঙালি জাতি হিসেবে আত্মপরিচিত করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাদের সুনির্দিষ্ট আবাসের ঠিকানা দিয়েছেন তিনি। সে কারণেই তিনি বাঙালি জাতির পিতা এবং বাংলাদেশের স্থপতি।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন তার মধ্যে যে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনার জন্ম দিয়েছে, তাকে তিনি আশ্রয় করে পূর্ববাংলার বাঙালিদেরকে জাতীয়তাবাদী করে গড়ে তুলেছেন। ’৫২ পরবর্তী পূর্ববাংলার সবকটি আন্দোলন বিশেষ করে শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ক প্রত্যেকটি সংগ্রামে বাঙালির হয়ে বাঙালিকে জাগ্রত করেছেন তিনি।
ব্যক্তিজীবনে মুসলমান হয়েও বাঙালি পরিচয়কে সর্বাগ্রে উচ্চারণ করেছেন। তার অবিনাশী দ্রোহ, উচ্চারণ বাঙালিকে দারুণভাবে প্রাণিত করেছে। ফলে ১৯৬৬ সালে যখন তিনি ৬ দফা নিয়ে বাংলার মাঠে নামলেন, তখন বাঙালি ওই ৬ দফার মধ্যে নিজের আত্মমর্যাদা, আত্মপ্রতিষ্ঠা ও চূড়ান্ত গন্তব্য প্রত্যক্ষ করল। বাঙালি দলে দলে তার পেছনে সমবেত হলো। তিনি হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো বাঁশি বাজিয়ে পূর্ববাংলার বাঙালিকে নিয়ে গেলেন স্বাধীন বাংলাদেশের দ্বারপ্রান্তে।
বাঙালি যে তার পেছনে সারিবদ্ধ হলো তার প্রমাণ পাওয়া গেল ১৯৭০ সালের নির্বাচনে। অকাতরে বঙ্গবন্ধুর সমর্থনে সোচ্চার হলো সকলে। বঙ্গবন্ধু বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হয়ে গেলেন। তখন তিনি এবং বাঙালি অপ্রতিরোধ্য। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ তাই বাঙালিকে একবাক্যে সশস্ত্র করে দিল। ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, বঙ্গবন্ধুর এই বাণী হয়ে উঠল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার নির্দেশনা। এরপর যে যুদ্ধ ও যুদ্ধজয়ের কথা, সেসবই পরিচালিত হয়েছে কারাবন্দি বঙ্গবন্ধুর অদৃশ্য পরিচালনায়।
এই যে ব্রিটিশ ভারত এবং পাকিস্তানি বাংলায় দীর্ঘ তিন দশকের লড়াই-সংগ্রাম, তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন, উপলব্ধি করেছেন, অংশীজন হয়েছেন এবং নেতৃত্ব দিয়ে মহানায়কে রূপান্তরিত হয়েছেন।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার আশিতম জন্মদিনে একটি লিখিত বক্তব্য দিয়েছিলেন, যা তার জীবদ্দশায় সর্বশেষ জন্মদিনের ভাষণ। সেখানে তিনি সুস্পষ্ট করে বলেছেন, আজ আশা করে যাচ্ছি, পরিত্রাণকর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্র্যলাঞ্ছিত কুটিরের মধ্যে, অপেক্ষা করে থাকব, সভ্যতার দৈববাণী সে নিয়ে আসবে, মানুষের চরম আশ্বাসের কথা মানুষকে এসে শোনাবে এই পূর্বদিগন্ত থেকেই। ...আশা করব, মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে। আর একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাওয়ার পথে।
রবীন্দ্র ভাষ্যের পরিপ্রেক্ষিতে সুদৃঢ়ভাবে বিশ্বাস হয় বঙ্গবন্ধুই সেই নেতা। যিনি মানুষকে আশ্বাসের বাণী শুনিয়েছিলেন। এবং জন্মগ্রহণ করেছিলেন বাংলার পূর্বাংশের নিভৃত পল্লি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। আর পূর্বাচলেই সূর্যোদয়ের দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছিল। বস্তুত তিনিই বাঙালিকে অন্তহীন পরাভব থেকে মুক্ত করে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। তার নিরন্তর প্রযত্ন প্রচেষ্টায় জেগেছিল বাঙালি। তার দৃপ্ত উচ্চারণে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে বাঙালি। তার সুস্পষ্ট নির্দেশে জীবনপণ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছে বাঙালি। জন্মলাভ করেছে হাজার বছরের লড়াই সংগ্রামে আত্মনিবেদিত বাঙালির নিরাপদ-নিশ্চিত ঠিকানা-বাংলাদেশ।
অধ্যাপক ড. রতন সিদ্দিকী ।। শিক্ষাবিদ ও নাট্যকার