ডায়েরিতে আমার একাত্তর (শেষ পর্ব)
২৩ মার্চ মঙ্গলবার, ১৯৭১
‘আজকে পাকিস্তান দিবস উপলক্ষে(?) বদলে স্বাধীন বাংলা প্রতিরক্ষা দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। ধানমন্ডিস্থ শেখ মুজিবের বাসভবনসহ সারা বাংলা দেশে (তখন বাংলাদেশ দুই শব্দে লেখা হতো) স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। আজ চান্দলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের উদ্যোগে চান্দলা বাজারে এক সভার আয়োজন করা হয়। সেখানে আমি একখানা গান ও প্রায় ৫ মিনিট বক্তৃতা করি।’
আরও পড়ুন : ডায়েরিতে আমার একাত্তর (প্রথম পর্ব)
আরও পড়ুন : ডায়েরিতে আমার একাত্তর (দ্বিতীয় পর্ব)
আগের দিন অতিথি বক্তাদের আসার বিষয়ে উল্লেখ ছিল। কিন্তু জনসভায় আর কে কে বক্তৃতা করেছেন তা উল্লেখ নেই। যতদূর মনে আসে অ্যাডভোকেট আমীর হোসেন, মুলফত আলী ভূঁইয়া, সামসুদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ আবদুল কাফি, মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া (শ্যামল ভূঁইয়া) বক্তৃতা করেছিলেন। তাদের সঙ্গে আমিও সুযোগ পেয়েছিলাম। সভাপতিত্ব করেছিলেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি কায়কোবাদ ভূঁইয়া। আমীর হোসেন সাহেবের বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের নির্দেশনার কথা বলা হয়েছিল। তিনি বুড়িচং থানার সকল তরুণকে প্রশিক্ষণ নিতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু যুদ্ধের প্রশিক্ষণ বিষয়টা স্পষ্ট উল্লেখ করেননি। বক্তব্যে ছিল দুর্গতদের সহযোগিতার বিষয়। বলেছিলেন— এমন হতে পারে, বাইরে থেকে মানুষ আশ্রয়ের জন্য আসবে। সেক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ও আওয়ামী লীগের কর্মীরা যেন তাদের সহযোগিতা করেন।
জনসভায় প্রচুর মানুষ হয়েছিল। স্কুলের মাঠ ভরে গিয়ে বাজারেও মানুষ বসেছিল বক্তৃতা শোনার জন্য। প্রায় ৬ বর্গকিলোমিটার আমাদের গ্রাম। এই গ্রাম ছাড়াও আশেপাশের গ্রামগুলো থেকে মানুষ মিছিল নিয়ে জনসভায় উপস্থিত হয়েছিল বক্তৃতা শোনার জন্য।
চান্দলা কে বি হাই স্কুলের পুরান মাঠে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই জনসভা। প্রচুর মানুষ হয়েছিল। স্কুলের মাঠ ভরে গিয়ে বাজারেও মানুষ বসেছিল বক্তৃতা শোনার জন্য। প্রায় ৬ বর্গকিলোমিটার আমাদের গ্রাম। এই গ্রাম ছাড়াও আশেপাশের গ্রামগুলো থেকে মানুষ মিছিল নিয়ে জনসভায় উপস্থিত হয়েছিল বক্তৃতা শোনার জন্য।
ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে আমি স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলনের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। আসলে শুনেছি বাংলা দেশের মানচিত্র খচিত পতাকা তৈরি হয়েছে। কিন্তু সরাসরি পতাকা দেখার সুযোগ হয়নি। চান্দলা বাজারে দর্জির দোকান ছিল ফরিদ খলিফার। তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগের একজন ছিলেন। তিনি বললেন, জাতীয় পতাকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সঠিক না হলে অন্যায় হবে। তবে একটা পতাকা দেখতে পারলে তৈরি করা যেত।
সৈয়দ আবদুল কাফি পতাকা তৈরির জন্য সম্ভবত ২ টাকা দিয়েছিলেন। সেই টাকা আর ফেরত দিয়েছিলাম কি না মনে নেই। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, প্রতিবছর আমাদের স্কুলে পাকিস্তান দিবসে অনুষ্ঠান হতো। স্যারেরা পাকিস্তানের মাহাত্ম্য বর্ণনা করে বক্তৃতা করতেন। কখনো শিক্ষার্থীদেরও বক্তৃতা করতে আহ্বান জানাতেন। আমি এ সুযোগে বক্তৃতা করতাম। কিন্তু ১৯৭১-এ পাকিস্তান দিবসের পরিবর্তে স্বাধীন বাংলা প্রতিরক্ষা দিবস হিসেবে পালন হয়। কিন্তু স্কুল বন্ধ থাকায় কোনো অনুষ্ঠান হয়নি। জনসভাতে বক্তৃতার মধ্যেই স্বাধীন বাংলা দেশ প্রতিরক্ষা দিবস সীমিত ছিল।
চান্দলা বাজারে দর্জির দোকান ছিল ফরিদ খলিফার। তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগের একজন ছিলেন। তিনি বললেন, জাতীয় পতাকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সঠিক না হলে অন্যায় হবে। তবে একটা পতাকা দেখতে পারলে তৈরি করা যেত।
আমি গান শিখিনি। আসলে ওই সময় গ্রামে গান শেখার মতো কোনো সুযোগও ছিল না। তারপরও সত্তরের নির্বাচনি প্রচারণা সভাগুলোতে আলোচনা শুরু হওয়ার আগে কর্মীরা গান গাইত। যেগুলো ছিল প্রায় সবই প্যারোডি ধরনের। দুয়েকটা দেশাত্মবোধক গানও শুনেছি গাইতে। অধিকাংশ অনুষ্ঠানে সিদলাই গ্রামের একজন প্রাইমারি শিক্ষক গান গাইতেন। তার গলা ছিল সুন্দর। তাছাড়া জনপ্রিয় গানের সুর করা ও নিজের লেখা অনেক গান গাইতেন। ২৩ মার্চে চান্দলায় অনুষ্ঠিত জনসভাতেও তিনি গান গেয়েছিলেন।
ওই সময় গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। জনসভাগুলো তাই বেলা থাকতেই শেষ হয়ে যেত মানুষের বাড়ি ফেরার সুবিধার্থে। কিন্তু সেদিন মাগরিবের আজানের পরও সভা চলেছিল। মানুষও ধৈর্য ধরে উপস্থিত ছিল। আসলে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিই মানুষকে রাজনীতিমুখী করে দিয়েছিল।
মোস্তফা হোসেইন ।। সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক