ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী : নিন্দিত নন্দন
সাল ১৯৭১। উত্তাল মার্চ। পাকিস্তানিদের শাসন-শোষণ-বঞ্চনার চূড়ান্ত দেখা হয়ে গেছে আরও আগেই। মুক্তিকামী বাঙালির পিঠ ঠেকে গেছে দেয়ালে। যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ছিল ক্রমশই।
৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ডাকে রচিত হয় ইতিহাস। পঁচিশে মার্চ কালরাত্রি—পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নৃশংস গণহত্যা, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতার ঘোষণা, বীর বাঙালির অস্ত্র ধরা, শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ।
প্রিয়ভাষিণীর ব্যক্তিগত জীবন যুদ্ধের ভাঙাচোরা তরী তখন মাঝসাগরে ঝড়ের কবলে। সন্তানদের বাবার সাথে বিচ্ছেদ হয়েছে ততদিনে। তিন পুত্র কখনো দাদির কাছে কখনো নানি বাড়িতে। বন্ধু বীয়ার ভাইয়ের সাথে ঘর বাঁধা যায় কি না সে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো ওই মুহূর্তে সহজ ছিল না।
আরও পড়ুন >>> ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত : ভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশের ইতিহাস
মানুষের কানাঘুষা আর বাঁকা দৃষ্টির তীরে জর্জরিত, অরক্ষিত সমাজে একলা মেয়ের পথ চলা। আরও অনেকের মতো প্রিয়ভাষিণীও খুঁজে ফেরে একটু নিরাপদ আশ্রয়। কিন্তু এই বিরাট সমাজে সন্তানসমেত ঘর ভাঙা মেয়ে, অন্য পুরুষের সাথে সম্পর্কে জড়ানো মেয়ের দেশে যুদ্ধকালীন সময়েও আশ্রয় পাওয়ার অধিকার বুঝি ছিল না!
কয়েক জায়গায় আশ্রয় নেওয়ার পর এই সত্যই প্রকট হয়ে উঠছিল। ভাই চলে গেছে মুক্তিবাহিনীতে, সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিতে। বীয়ার ভাই মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন উপায়ে। মায়ের পরিবার মুখ চেয়ে আছে। বাড়িতে অপেক্ষমাণ দুধের শিশু।
যুদ্ধ বলে ক্ষুধা তো আর থেমে থাকে না! নিজের তিন সন্তানের দুধের বোতলে পানি মিশিয়ে পাতলা করে মায়ের পরিবারের অন্য শিশুদের মুখে দুধ তুলে দিতেন। এই তো ছিলেন আমার মা প্রিয়ভাষিণী!
যুদ্ধ বলে ক্ষুধা তো আর থেমে থাকে না! নিজের তিন সন্তানের দুধের বোতলে পানি মিশিয়ে পাতলা করে মায়ের পরিবারের অন্য শিশুদের মুখে দুধ তুলে দিতেন। এই তো ছিলেন আমার মা প্রিয়ভাষিণী!
মিলের একজন সহকর্মী তাকে কাজে যোগদান করা যাচ্ছে খবর দিয়ে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেওয়ার নামে সুযোগ হাতছাড়া করেনি। সেখান থেকেও পালাতে হয় তাকে। এমনই বিপন্ন সময়ে প্রিয়ভাষিণী ফিরে যেতে বাধ্য হন কর্মস্থল ক্রিসেন্ট জুট মিলে। কারণ সেখানে গেলে বেতন পাওয়া যাচ্ছে। পরিবারের জন্য অর্থ উপার্জনের ব্যবস্থা তাকেই করতে হবে।
আরও পড়ুন >>> প্যারী মোহন আদিত্য : অল্পশ্রুত মহান দেশপ্রেমিকের প্রতিকৃতি
আহা! নীড়হারা সেই একলা ঝড়ের পাখি! যুদ্ধ তার জীবনের সাথে জুড়ে যায়। মিলের কোয়ার্টারে থাকার ব্যবস্থা হয় তার। উপরমহল থেকে নির্দেশ আসে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া মিলের বাইরে যাওয়া যাবে না। ক্রিসেন্ট জুট মিল তখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কব্জায়, প্রিয়ভাষিণীও।
পাকসেনা, নেভাল কমান্ডার, অফিসের পিতৃতুল্য, ভ্রাতৃতুল্য বড়কর্তা থেকে শুরু করে গাড়িচালক, অবাঙালি, মিলিশিয়া, রাজাকার - চারদিকে মানুষের বদলে কেবল ধর্ষকের নাগপাশ। টেলিফোন অপারেটর প্রিয়ভাষিণীকে কখনো স্বীয় কর্মস্থলে, কখনো যশোর ক্যান্টনমেন্টে অথবা তাদের ইচ্ছেমতো জায়গায় হতে হয় নির্যাতনের শিকার।
এক পর্যায়ে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে রেখে আসা হলে অনেক আকুতি মিনতি করে একজন অফিসারের সাহায্যে সেখান থেকে ফিরে আসতে সক্ষম হন। মনোবল ভেঙে দিতে তাকে হত্যা মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়। রাজাকার সাবদুল্লাহ তার মুণ্ডু ঝুলাতে চায় শহীদ মিনারে। জিজ্ঞাসাবাদের নামে নানাভাবে হয়রানি করা হয়।
মধ্যরাতে মিলের কোয়ার্টার থেকে তার লম্বা চুলের মুঠি ধরে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে জিপে তোলা হয়। মটকে দেওয়া হয় হাতের আঙুল। বেয়োনেটের আঘাতে যোনিপথে রয়ে যায় চিরস্থায়ী ক্ষত। শরীর জুড়ে অচেনা, অবাঞ্ছিত নখের আঁচড়, সোনালি দাঁতের বিষাক্ত দংশন। ক্ষতবিক্ষত স্তনের রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে তুলা গুঁজে ব্যথা চেপে সকালবেলা টেলিফোন (পিএবিএক্স) বোর্ডে বসতে হতো তাকে।
বিপদসংকুল সময়েও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফোনে আড়ি পেতে তথ্য সংগ্রহ করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। নিজের দেহে শত্রুর ভ্রূণের উপস্থিতি টের পেয়ে গোপনে টাকা জোগাড় করে ধ্বংস করেছিলেন তা। খুলনা থেকে যশোর ক্যান্টনমেন্ট নেওয়ার পথে আর্মিদের জিপে গণধর্ষণ করা হয় আমার মা প্রিয়ভাষিণীকে।
আরও পড়ুন >>> বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশ চেয়েছিলেন
এসময় হুইস্কি কুলি করে তার মুখে ছুঁড়ে দিচ্ছিল পাকসেনারা। তিনি শুধু অনুরোধ করছিলেন, দয়া করে তাকে যেন হত্যা করা হয়। যতদিন বেঁচেছিলেন এই দৃশ্য তাকে দুঃস্বপ্নে তাড়া করে ফিরেছে। এরপরও বেঁচেছিলেন মানুষটি! নিদারুণ পৈশাচিকতার মাঝে মরতে মরতে তবু বারবার বেঁচে ওঠেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বীরমাতাদের অনেককেই সমাজ ও লোকলজ্জার ভয়ে বাধ্য হয়ে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। মেজর আলতাফ নামের একজন পাকিস্তানি সেনা অফিসার প্রিয়ভাষিণীকে বিয়ে করে নিজের দেশে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। মা তাকে বলেছিলেন, নিজের দেশের চেয়ে বড় আর কিছু নেই, দেশের সাথে এতো বড় হঠকারিতা করতে পারবেন না তিনি। দেশের সাথে বেইমানি তিনি করেননি। মাতৃভূমির সবুজ মাটি আঁকড়ে, কপালে স্বাধীনতার সূর্য এঁকে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাঁথা ছড়িয়ে গেছেন নব নব প্রাণে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত আর আড়াই লক্ষেরও বেশি বীরাঙ্গনা মায়েদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্রাণ হলো বলিদান / লেখা আছে অশ্রুজলে।’
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। বিজয় বাঙালির, বঙ্গবন্ধুর, বাংলাদেশের! বীয়ার ভাই ফিরে এসেছে। মুক্তিযোদ্ধারা বীরবেশে ফিরে আসছে। পরম স্নেহের ভাইটা ঘরে ফিরেছে। লাখো বীরাঙ্গনা মুক্ত হয়েছিলেন, মুক্ত হয়েছিলেন প্রিয়ভাষিণীও।
বিজয় মিছিলে লাল-সবুজ জয়ধ্বজা উড়িয়ে মুহুর্মুহু ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে পৃথিবীর মানচিত্রে সদ্য ভূমিষ্ঠ বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করে। বীয়ার ভাই তাকে সাথে নিয়ে বাংলাদেশের বিজয় দেখতে বের হন।
খুলনা শহরের বাতাসে তখনো রক্তের গন্ধ আর মানুষের মাথার খুলি, হাড়গোড় আর গলিত দেহের পাহাড়। দুর্ধর্ষ রাজাকার সাবদুল্লাহর দুই পা টেনে ফেড়ে ফেলেছে বিক্ষুব্ধ মানুষ।
আরও পড়ুন >>> বীরের জাতি বাঙালি
অসংখ্য পরিবার তখনো সূর্যসন্তানদের ফিরে আসবার অপেক্ষায়। সারাদেশেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জেনোসাইডের টাটকা প্রমাণ। বিজয়ের বীরগাঁথায় মিলেমিশে একাকার হয় কত আত্মত্যাগ, রক্তের ঋণ! কত অশ্রুপাত!
স্বাধীন দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে অগণিত বীরাঙ্গনা মায়ের মতোই প্রিয়ভাষিণীকেও সমাজের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হতে হয়। ক্রমেই উপলব্ধি হয়, বিজয় মিছিলে তাদের স্থান নেই! তারা নাকি সম্ভ্রমহারা! পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে বঙ্গবন্ধুকে লেখা একজন বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার পিতার একটি চিঠি পড়েছিলাম।
তার কন্যা মুক্তিযুদ্ধে পাকসেনাদের হাতে নিজের সবকিছু খুইয়ে এসেছে! এই মেয়েকে ঘরে রাখলে মানুষের কাছে তিনি মুখ দেখাতে পারছেন না! তাই বঙ্গবন্ধুর কাছে আকুল আবেদন জানিয়েছেন একটা কিছু করার। বীরাঙ্গনারা নাকি দেশকে কিছু দিতে পারেনি বরং সব খুইয়ে এসেছে! কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বর্বরোচিত নির্যাতনের পর হত্যা করা হয় যে বীরাঙ্গনাদের, তাদের কাউকে শহীদ বলা হয় না। কী দুর্ভাগ্য আমাদের!
পুনর্বাসন কেন্দ্রে যাদের নেওয়া হয়েছিল, তাদের অনেককেই ফিরিয়ে নিতে চায়নি পরিবারগুলো। যুদ্ধ ফেরত মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়ের মুখখানা দেখবার বড় সাধ জাগে প্রিয়ভাষিণীর। কিন্তু সেই ভাই-ই বাড়ির চৌকাঠে পা রাখতে দেয় না প্রিয়ভাষিণীকে।
মুক্তিযুদ্ধের পর পুনর্বাসনের কোনো সুযোগ প্রিয়ভাষিণীর ভাগ্যে ঘটেনি। বরং সমাজ-সংসারের কাছে নিদারুণ নিগৃহীত হতে হয়েছে। আমি একাত্তর দেখিনি। মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। আমি প্রিয়ভাষিণীকে দেখেছি।
যে পরিবারের অন্ন জোগাতে নিজের জীবন বিপন্ন করতে পিছ পা হননি, যে বিরাট সমাজ যুদ্ধদিনে একলা একটি মেয়েকে আশ্রয় দিতে অস্বীকৃতি জানয়েছিল সেই পরিবার, সেই সমাজের চোখেই মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দ্বারা ধর্ষণের শিকার হওয়ার দায়ে তিনি চরিত্রহীন, নষ্টা, বেশ্যা!
সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে চাকরিচ্যুত করা হয় তাকে। মায়ের বাড়ির দরজা মুখের ওপর সপাটে বন্ধ করে দেয় পরম স্নেহের ভাই শিবলী, পাকসেনাদের গতিবিধি, নীল নকশা সম্বন্ধে যাকে গোপন তথ্য ও নথিপত্র দিয়ে, অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করতো ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী।
আরও পড়ুন >>> সম্প্রীতি ফিরে আসার প্রত্যাশায়
বলতে দ্বিধা নেই, পরবর্তী সময়ে ভাইবোন অন্তপ্রাণ এই ‘চরিত্রহীন’ বোনই সারা জীবন উৎসর্গ করে গেছেন তাদের জন্য। তবুও সামনে, আড়ালে-আবডালে কোনোকালেই এই মানুষটা তাদের অপবাদ, উপহাস আর তুচ্ছতাচ্ছিল্য থেকে রেহাই পায়নি।
মুক্তিযুদ্ধের পর পুনর্বাসনের কোনো সুযোগ প্রিয়ভাষিণীর ভাগ্যে ঘটেনি। বরং সমাজ-সংসারের কাছে নিদারুণ নিগৃহীত হতে হয়েছে। আমি একাত্তর দেখিনি। মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। আমি প্রিয়ভাষিণীকে দেখেছি। দিগন্তজোড়া গভীর, শান্ত, দ্যুতিময় দুটি বাদামি চোখের চাহনি দেখেছি। তার অদম্য মানসিক শক্তি দেখেছি। অবাক বিস্ময়ে দেখেছি ধ্বংসস্তূপ থেকে কীভাবে মাথা তুলে দাঁড়াতে হয়। ছাইচাপা আগুন থেকে কীভাবে ফিনিক্স হয়ে ওঠা যায়।
২০২০ সালে খুলনায় অবস্থিত গণহত্যা আর্কাইভ ও জাদুঘরে গিয়ে দেখেছি প্লাটিনাম জুট মিল থেকে উদ্ধারকৃত পাটের বয়লার যার মধ্যে মানুষ হত্যা হতো একাত্তরে, মায়ের ‘নিন্দিত নন্দন’ বইয়ে যা সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়া মায়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী খুলনার মুনশি বাড়ির গণহত্যার স্থানও চিহ্নিত করে স্মারক ফলক বসানো হয়েছে।
ক্রিসেন্ট জুট মিলেও পা রেখেছিলাম বুকে সাহস নিয়ে। মায়ের অফিসঘর, টেলিফোন অপারেটরের সেই টেবিল, চেয়ারে বসেছিলাম স্তব্ধ আমি। শোবার ঘরের জানালা—যেখান থেকে প্রতিরাতে শোনা যেত মানুষের আর্তনাদ! সেই সিঁড়ি—যেখান থেকে মায়ের চুলের মুঠি ধরে পাকিস্তানি সেনারা টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে জিপে তুলেছিল… একাত্তর থমকে আছে সেখানে। ধরণীর বুকে আমি সেই বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা, অদম্য সাহসী প্রিয়ভাষিণীর সন্তান হয়ে সহস্রবার জন্মাতে চাই।
লেখার উল্লেখযোগ্য অংশ 'ছায়াপাখি' থেকে নেওয়া।
ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী ।। ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর কন্যা