বাংলা ভাষা ও তথ্যপ্রযুক্তি : আমরা কতটা সমন্বয় করতে পারছি
৭১ বছর আগে আমাদের মুখের ভাষা বাংলা রক্ষায় ভাষা আন্দোলনে শহীদ সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউরসহ যারা শহীদ হয়েছেন তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। মাতৃভাষা বাংলার জন্য একমাত্র বাঙালি জাতি লড়াই করেছে। সর্বপ্রথম রক্ত দিয়ে মাতৃভাষাকে রক্ষা করার ইতিহাস পৃথিবীতে কেবল বাঙালি জাতিরই রয়েছে। তাদের রক্তের বিনিময়ে বিশ্বের প্রায় ৩৫ কোটি মানুষ বর্তমানে বাংলা ভাষায় কথা বলে।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা আমাদের মাতৃভাষাকে যথাযথ মর্যাদা দিতে পারছি না। ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলার ব্যবহার ও প্রয়োগ এখনো সর্বজনীন নয়। বিদেশি ভাষার সংমিশ্রণে বাংলা আজ অন্য রূপ নিচ্ছে। এ জন্য আমরা শিক্ষিত সমাজই দায়ী। আমাদের মাধ্যমেই প্রভাবিত হয়ে অন্যরাও বিকৃত ভাষায় মনযোগী হচ্ছে। এদিকে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধিতে বাংলিশ নামের কথিত একটি ভাষার জন্ম হয়েছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, এই প্রযুক্তি আছে বলেই এক ঝাঁক উদ্যমী মানুষ বাংলা ভাষা রক্ষায় অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। আজ তাদের প্রতিও আমি শ্রদ্ধা-জ্ঞাপন করছি।
প্রথমে আপনাদের একটি কৌতুক বলে মূল পর্ব শুরু করতে চাই। কয়েকজন বন্ধু মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা এখন থেকে শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলবে। বাংলায় অন্য কোনো ভাষার সংমিশ্রণ করবেন না। তবে কেউ যদি ভুল করেও বাংলা বলার সময় ইংরেজি বা অন্য কোনো ভাষা ব্যবহার করেন, তাহলে বন্ধুরা তাকে শাস্তি হিসেবে কিল ঘুষি মারবেন। তো এই সিদ্ধান্ত বন্ধুদের জানাতে ঘোষণা দেওয়ার জন্য একজনকে বলা হলো। সবার উপস্থিতিতে তিনি বললেন, প্রিয় বন্ধুরা! আজ থেকে আমরা বাংলা ভাষায় ইংরেজি শব্দ ইউজ করব না, করলে তাকে কিল-ঘুষি... বলা শেষ করার আগেই বন্ধুরা তাকে কিল-ঘুষি দেওয়া শুরু করল। মূলত ব্যবহারের স্থানে ‘ইউজ’ শব্দ ভুলবশত সংমিশ্রণ করার কারণে তিনি শাস্তির মুখে পড়েছেন।
বাংলা ভাষা আমাদের কাছে যতটা প্রাণের, ততটাই আবেগেরও। ফরাসি, তুর্কি, পর্তুগিজ, ইংরেজ এবং সর্বশেষ পাকিস্তানিদের হাত থেকে আমরা এই প্রাণের ভাষাকে উদ্ধার করেছি রক্ত-ত্যাগের বিনিময়ে
আসলে এটা গল্প হলেও বাস্তবতা হচ্ছে আমরা সংমিশ্রণ থেকে বের হতে পারছি না। স্বয়ং রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে শুরু করে প্রান্তিক পর্যায়ে সকল ক্ষেত্রে একই অবস্থা। ধরুন যদি প্রশ্ন করা হয়, বাংলা ভাষা রক্ষায় আমাদের শহীদরা কবে নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন? আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস কবে? উত্তরে সবাই এক বাক্যে বলবেন ২১ ফেব্রুয়ারি। আসলেই কি ২১ ফেব্রুয়ারি নাকি ৮ ফাল্গুন? অবাক হলেও সত্য, আমরা বহু বছর ৯ ফাল্গুন মাতৃভাষা দিবস পালন করেছি। যেমনটা আমাদের দেশের কিছু মানুষ এখনো ১৩ ফেব্রুয়ারি পহেলা ফাল্গুন হিসেবে পালন করেন।
অনেকেই বলবেন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই দিবসটি পালন করার জন্য বাংলার পরিবর্তে ইংরেজি ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু এটা নিতান্তই খোঁড়া যুক্তি। কারণ, পৃথিবীজুড়ে এমন অসংখ্য দিবস রয়েছে যেগুলো নির্দিষ্ট তারিখেও হয় না। যেমন জানুয়ারি মাসের শেষ রোববার কুষ্ঠরোগ প্রতিরোধ দিবস, মে মাসের দ্বিতীয় রোববার মা দিবস, মে মাসের প্রথম শনিবার বিনামূল্যে কমিক বই দিবস ইত্যাদি সুনির্দিষ্ট তারিখ বিবেচনায় পালন করা হয় না। তাহলে আমরাও চাইলে ৮ ফাল্গুনকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে প্রচার করতে পারতাম। কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠেনি।
বাংলা ভাষার ইতিহাস ও স্বীকৃতি
বাংলা ভাষা আমাদের কাছে যতটা প্রাণের, ততটাই আবেগেরও। ফরাসি, তুর্কি, পর্তুগিজ, ইংরেজ এবং সর্বশেষ পাকিস্তানিদের হাত থেকে আমরা এই প্রাণের ভাষাকে উদ্ধার করেছি রক্ত-ত্যাগের বিনিময়ে। বঙ্গীয় সমাজে বাংলা ভাষার অবস্থান নিয়ে বাঙালি মুসলমানের আত্ম-অম্বেষায় যে ভাষা-চেতনার উন্মেষ ঘটে, তারই সূত্র ধরে বিভাগোত্তর পূর্ববঙ্গের রাজধানী ঢাকায় ১৯৪৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে ভাষা-বিক্ষোভ শুরু হয়। ১৯৪৮ সালের মার্চে এ নিয়ে সীমিত পর্যায়ে আন্দোলন হয় এবং ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে তার চরম প্রকাশ ঘটে (৮ ফাল্গুন, ১৩৫৯)।
কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরে বসবাসরত দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম প্রাথমিক উদ্যোক্তা হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে।
সেই প্রস্তাবের ভিত্তিকেই প্যারিসে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর ৩০তম সাধারণ সভায় ভাষার জন্য এই বিশাল আত্মত্যাগের ঘটনাটিকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেয় এবং ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এর ফলে পরের বছর থেকে বিশ্বের ১৮৮টি দেশ একযোগে ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে থাকে
সে সময় সেক্রেটারি জেনারেলের প্রধান তথ্য কর্মচারী হিসেবে কর্মরত হাসান ফেরদৌসের নজরে এ চিঠিটি আসে। তিনি ১৯৯৮ সালের ২০ জানুয়ারি রফিককে অনুরোধ করেন তিনি যেন জাতিসংঘের অন্য কোন সদস্য রাষ্ট্রের কারো কাছ থেকে একই ধরনের প্রস্তাব আনার ব্যবস্থা করেন। পরে রফিক, আব্দুস সালামকে সাথে নিয়ে ‘মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভার্স অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড’ নামে একটি সংগঠন দাঁড় করান। এতে একজন ইংরেজিভাষী, একজন জার্মানভাষী, একজন ক্যান্টোনিভাষী, একজন কাচ্চিভাষী সদস্য ছিলেন। তারা আবারো কফি আনানকে ‘এ গ্রুপ অব মাদার ল্যাংগুয়েজ অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড’-এর পক্ষ থেকে একটি চিঠি লেখেন, এবং চিঠির একটি কপি ইউএনওর কানাডীয় দূত ডেভিড ফাওলারের কাছেও প্রেরণ করা হয়। ১৯৯৯ সালে তারা জোশেফের সাথে ও পরে ইউনেস্কোর আনা মারিয়ার সাথে দেখা করেন, আনা মারিয়া পরামর্শ দেন তাদের প্রস্তাব ৫টি সদস্য দেশ – কানাডা, ভারত, হাঙ্গেরি, ফিনল্যান্ড এবং বাংলাদেশ দ্বারা আনীত হতে হবে। তারপর বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রস্তাবের পক্ষে সমর্থন দানে ২৯টি দেশ অনুরোধ জানাতে কাজ করেন।
সেই প্রস্তাবের ভিত্তিকেই প্যারিসে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর ৩০তম সাধারণ সভায় ভাষার জন্য এই বিশাল আত্মত্যাগের ঘটনাটিকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেয় এবং ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এর ফলে পরের বছর থেকে বিশ্বের ১৮৮টি দেশ একযোগে ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে থাকে।
ফলে আমাদের নিজেদের কাছেই এই ভাষার ব্যবহার এবং গুরুত্ব দিন দিন কমে যাচ্ছে এবং একইসঙ্গে ৩৫ কোটি মানুষের এই ভাষা সর্বজনীন হয়ে উঠছে না। আমরা নিজেরাই বিভিন্ন কাজে ইংরেজির মতো প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত ভাষাগুলোর প্রতি আগ্রহী হচ্ছি
তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা অন্তর্ভুক্ত করতে ২০১০ সালের ৩০ জুন ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামের ইন্সটিটিউশনাল সদস্যপদ পায় বাংলাদেশ। ইউনিকোড পৃথিবীর প্রতিটি ভাষার প্রতিটি অক্ষরের জন্য একটি একক সংখ্যা বা নম্বর বরাদ্দ করে, সেটা যে প্লাটফর্মের জন্যই হোক, যে প্রোগ্রামের জন্যই হোক, আর যে ভাষার জন্যই হোক। ইউনিকোডে বিশাল লিপি-সংকেতের সমর্থন থাকায় ক্লায়েন্ট সার্ভার বা বহুমুখী অ্যাপ্লিকেশন এবং ওয়েবের গঠনে পুরনো লিপিমালার ব্যবহার না করে ইউনিকোডের ব্যবহার অনেক খরচ কমিয়ে আনতে পারে। ইউনিকোড কোনো বাড়তি প্রকৌশল ছাড়াই একটি সফটওয়্যার বা ওয়েবসাইটকে বিভিন্ন প্লাটফর্ম, ভাষা এবং দেশে ব্যবহারযোগ্যতা দেয়। এটা ব্যবহারের ফলে ডাটা বিভিন্ন সিস্টেমের মধ্যে দিয়ে আনাগোনা করতে পারে কোনো রকম বিকৃতি ছাড়াই।
ভাষা নিয়ে পরিসংখ্যান
বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৩৫ কোটি মানুষ বাংলা ভাষাকে প্রথম ভাষা হিসেবে ব্যবহার করছেন, সেদিক থেকে আমাদের এই ভাষা পৃথিবীতে সপ্তম। ১৯৫২ সালে যারা আত্মত্যাগের বিনিময়ে ভাষার যে স্বাধীনতা আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন, ২০২৩ সালে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রক্ষা করাটা আমাদের প্রযুক্তিবিদদের এক প্রকার দায়িত্ব হয়ে পরেছে। একবিংশ শতাব্দীতে একটি ভাষাকে সম্মানের সঙ্গে টিকিয়ে রাখতে ইন্টারনেটে ওই ভাষায় বিষয়বস্তুর সহজলভ্যতা, প্রয়োজনীয় ভাষা প্রক্রিয়াজাতকরণের সরঞ্জাম ও কৌশল প্রস্তুতি এবং সেই সম্পর্কিত বিস্তর গবেষণা নিশ্চিতকরণ যথাকর্তব্য।
বিশ্বের প্রায় ৭০০০ ভাষা রয়েছে। কিন্তু সবেমাত্র কয়েকটি ভাষা রয়েছে যেগুলো সর্ব দিক বিবেচনা করে উন্নত ভাষা হিসেবে ধরা হয়। সেগুলো হলো- ইংরেজি, চায়নিজ, জার্মান, ফার্সি, আরবি, ফ্রেঞ্চ এবং স্প্যানিশ। এমনকি সর্বোচ্চ প্রযুক্তিগত উন্নয়নও ইংরেজির সঙ্গে এই ভাষাগুলোরই সমন্বয় ঘটেছে। এজন্য এসব ভাষার প্রতি অন্যরাও আকৃষ্ট হয় সহজেই। তাদের সভ্যতা, ঐতিহ্য, কৃষ্টি-কালচার এবং অস্তিত্ব সম্পর্কে বিস্তর মানুষ অবহিত।
অন্যদিকে, বাংলা ভাষা এদিক দিয়ে যথেষ্ট পিছিয়ে রয়েছে। আধুনিক সময়ের অতি প্রয়োজনীয় কিছু টুলস, যেমন- স্বয়ংক্রিয় চ্যাটবট, ভার্চুয়াল সহকারী (গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট), ওসিআর (স্বয়ংক্রিয় পাঠক), স্বয়ংক্রিয় অনুবাদক, কথা থেকে লেখা (স্পিচ টু টেক্সট), লেখা থেকে কথা (টেক্সট টু স্পিচ), এগুলো এখন পর্যন্ত বাংলা ভাষার জন্য ভালো মানের পাওয়া যায় না। ফলে আমাদের নিজেদের কাছেই এই ভাষার ব্যবহার এবং গুরুত্ব দিন দিন কমে যাচ্ছে এবং একইসঙ্গে ৩৫ কোটি মানুষের এই ভাষা সর্বজনীন হয়ে উঠছে না। আমরা নিজেরাই বিভিন্ন কাজে ইংরেজির মতো প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত ভাষাগুলোর প্রতি আগ্রহী হচ্ছি।
ওয়েবে বাংলার ব্যবহার বাড়াতে এবং বাংলাকে আধিপত্যশীল ভাষা হিসেবে স্থান করে দিতে ১৬টি টুলস উন্নয়নের কাজ করছে সরকার। সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের অধীন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল এই টুলসগুলো উন্নয়নে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ‘গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণ’ নামের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হলে ব্যবহার করা যাবে এসব টুলস
বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তির অনেক শাখাকেই নতুনভাবে ভাবতে শিখিয়েছে, অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করে চিন্তার পরিধিকে কয়েক গুণ বড় করে দিয়েছে। তারই একটা ছোট্ট শাখা হলো 'ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং' বা ভাষা প্রক্রিয়াজাতকরণ। যেখানে মেশিনকে একটা ভাষা শেখানোর যাবতীয় পদক্ষেপ নিয়ে কাজ করা হয়। আর মেশিন একটা ভাষাকে যতটা ভালো বুঝতে পারে, সেই ভাষাকে ততটাই আধুনিক বলা যায়। ফলশ্রুতিতে ওই ভাষা ব্যবহার করে মেশিনকে দিয়ে আমাদের অনেক কঠিন কাজগুলো খুব সহজেই করিয়ে নিতে পারি। যেমন : হাতে টাইপ না করেই দূর থেকে কথা বলে একটা যন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করা, রাস্তাঘাটের ব্যানার-সাইনবোর্ডের লেখা না পড়েই ডিজিটালে রূপান্তর করা, অন্য ভাষা না বুঝেও সেগুলো বাংলায় রূপান্তর করে বুঝতে পারা, অন্যের কথা বা লেখার আবেগ যন্ত্র দ্বারা পরিমাপ করা, ভিনদেশি মানুষের সঙ্গে বাংলা ভাষায় যোগাযোগ করা এবং এমন আরও অনেক কিছু রয়েছে।
তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলার ব্যবহার বাড়াতে ১৫৯ কোটি টাকার প্রকল্প
২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি একনেক সভায় অনুমোদন পায় ‘গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে তথ্য-প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণ’ নামের এক প্রকল্প; যেটির বাস্তবায়নের দায়িত্ব পেয়েছে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি)। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয় ১৫৯ কোটি দুই লাখ টাকা। ওয়েবে বাংলার ব্যবহার বাড়াতে এবং বাংলাকে আধিপত্যশীল ভাষা হিসেবে স্থান করে দিতে ১৬টি টুলস উন্নয়নের কাজ করছে সরকার। সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের অধীন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল এই টুলসগুলো উন্নয়নে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ‘গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণ’ নামের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হলে ব্যবহার করা যাবে এসব টুলস।
এ প্রকল্পের আওতায় মোট ১৬টি টুলস উন্নয়ন করা হবে। এগুলো হচ্ছে— বাংলা করপাস বা ভাষাংশ, বহুভাষা করপাস, বাংলা ওসিআর, বাংলা স্পিচ টু টেক্সট এবং টেক্সট টু স্পিচ, জাতীয় কিবোর্ডের আধুনিকায়ন, বাংলা স্টাইল গাইড উন্নয়ন, বাংলা বানান ও ব্যাকরণ সংশোধন, বাংলা থেকে আইপিএ কনভার্টার (আন্তর্জাতিক ধ্বনিমূলক বর্ণমালা), বাংলা মেশিন ট্রান্সলেটর ডেভেলপমেন্ট, দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য স্ক্রিন রিডার সফটওয়্যার, বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য ইশারা ভাষা, বাংলাদেশের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী ভাষার কিবোর্ড ও শব্দ ভাণ্ডার, সেন্টিমেন্ট অ্যানালাইসিস টুলস উন্নয়ন, বাংলা ফন্ট কনভার্টার, বাংলা ইউনিকোড, ভাষা প্রযুক্তির সমন্বিত প্লাটফর্ম।
এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আন্তর্জাতিক পরিসরে নেতৃস্থানীয় ভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করা। বিশেষ করে কম্পিউটিং ও আইটিসিতে বাংলা ভাষাকে খাপ খাইয়ে নেওয়া। এ জন্য তথ্যপ্রযুক্তিকে বাংলা ভাষাসমৃদ্ধকরণ করে বিভিন্ন প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্যবহারযোগ্য সফটওয়্যার, টুলসের উন্নয়ন করা, যাতে করে বাংলা ভাষায় কম্পিউটার ও ওয়েব ব্যবহারে কোনো অসুবিধা না হয়। প্রকল্পটির মাধ্যমে মোট ১৬টি টুলস বা সফটওয়্যার উন্নয়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া।
তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলার ব্যবহার : যে ১৬ টুলস উন্নয়ন করা হচ্ছে
১. বাংলা করপাস বা ভাষাংশ : বিশ্বের অন্যতম একটি ভাষা হলেও বাংলা এখনো তথ্যপ্রযুক্তির বিবেচনায় সমৃদ্ধশালী ভাষা হয়ে ওঠেনি। আর এ জন্য দরকার ভাষাংশ বা করপাস তৈরি করা। যেটি হবে প্রতিনিধিত্বমূলক ও ব্যালেন্সড। এটি তৈরিতে নানান প্রক্রিয়া জড়িত। সেগুলো করার কাজ চলছে।
২. বাংলা ওসিআর : কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে মুদ্রিত বা হাতে লেখা বর্ণমালা শনাক্ত করা যায়। এই পদ্ধতিতে পিডিএফ থাকা বর্ণগুলোকে কম্পিউটারের মাধ্যমে দ্রুত শনাক্ত করা ও সেগুলোকে টেক্সটে রূপান্তর করার কাজও করা হবে।
৩. বাংলা স্পিচ টু টেক্সট এবং টেক্সট টু স্পিচ : এই কম্পোনেন্টের মাধ্যমে বাংলা কথাকে লেখায় এবং লেখাকে কথায় রূপান্তরের কাজ করা যাবে। রেকর্ড বা কারও কথাকে তাৎক্ষণিক লেখায় রূপান্তর করা যাবে। আবার কোন লেখাকে ডিজিটাল স্পিসে রূপান্তর করা যাবে। ফলে অনেক কাজ সময় কমে আসবে কোন কিছু লিখতে গিয়ে।
৪. জাতীয় কিবোর্ডের আধুনিকায়ন : কম্পিউটারে কম্পোজ আরও সহজ করতে জাতীয় কিবোর্ডকে আরও সহজ করা হবে এই প্রকল্পের মাধ্যমে। এর ফলে বিভিন্ন অপারেটিং সিস্টেম যেমন উইন্ডোজ, ম্যাক, অ্যান্ড্রয়েড, আইওএসে একই ধরনের কিবোর্ড ব্যবহার করা হবে।
৫. বাংলা স্টাইল গাইড : প্রযুক্তির সঙ্গে ভাষার সম্মিলনের প্রথম শর্ত হলো ভাষার রীতি এবং ভাষা ব্যবহারের মান ও নীতি ঠিক করা। ভাষার এই মান ও নীতির সংগ্রহ হলো স্টাইল গাইড। এটিও তৈরি করার কাজ করা হবে। যেখানে বর্ণ, প্রমিত বাংলা সর্টিং অর্ডার প্রমিতকরণ, সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ প্রমিতকরণ, বিরাম চিহ্ন প্রয়োগ নীতিমালা ঠিক করা হবে।
৬. বাংলা বানান ও ব্যাকরণ সংশোধন : এতে যে সফটওয়্যার তৈরি হবে তার মাধ্যমে বাংলা ভাষার শব্দ, বানান, বাক্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পাদনা করা যাবে। এটি যে শুধু ভুল বানান ধরবে তা নয়, বরং তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংশোধন করার পরামর্শ দেবে। এটি দিয়ে মোবাইল, কম্পিউটার ও অন্যান্য মাধ্যমে বাংলা বানান সংশোধন করা সম্ভব হবে।
৭. বহুভাষা করপাস : মেশিন ট্রান্সলেশনের জন্য বাংলার সঙ্গে বিভিন্ন ভাষার সমান্তরাল অনূদিত করপাস প্রয়োজন রয়েছে। এই কম্পোনেন্টের মাধ্যমে বাংলার সঙ্গে দশটি ভাষার সমান্তরাল করপাস উন্নয়ন করা হবে।
৮. বাংলা থেকে আইপিএ কনভার্টার : বাংলা ইউনিকোড টেক্সটকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আইপিএতে প্রকাশ করবে এই কম্পোনেন্ট। সাধারণত এই কনভার্টার সূক্ষ্ম লিপান্তর রীতি অনুসরণ করে তৈরি হবে। আইপিএ আন্তর্জাতিক ধ্বনিমূলক বর্ণমালা মানুষের দ্বারা উচ্চারিত প্রায় সব ধ্বনি লিখিত রূপকে প্রকাশ করা যায়। সাধারণত অভিধান রচয়িতা, বিদেশি ভাষার শিক্ষার্থী-শিক্ষক, ভাষাবিদ, গায়ক, অনুবাদক এই বর্ণমালা ব্যবহার করে থাকে। এটি তৈরি হলে বাংলা ভাষার উচ্চারিত রূপকে আন্তর্জাতিক মান অনুসারে লেখা যাবে।
৯. বাংলা মেশিন ট্রান্সলেটর ডেভেলপমেন্ট : যান্ত্রিক অনুবাদের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে বিভিন্ন ভাষায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনুবাদ করা। এর অনুবাদকের মাধ্যমে তথ্যমূলক বাংলা, দৈনন্দিন বাংলা, প্রাতিষ্ঠানিক রচনা, সংবাদ বিজ্ঞপ্তি, আবহাওয়া সংবাদসহ আরও অনেককিছু দ্রুত নির্ভুলভাবে অনুবাদ করা সম্ভব হবে।
১০. দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য স্ক্রিন রিডার সফটওয়্যার : এর উন্নয়নের মাধ্যমে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বা স্বল্প দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিরা কম্পিউটার বা মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবে। স্ক্রিনে ভেসে ওঠা প্যারাগ্রাফ পড়ে শোনাবে এই সফটওয়্যার।
১১. বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য ইশারা ভাষা : এটি মূলত সাইট টু স্পিচ সফটওয়্যার। এর মাধ্যমে কোন কম্পিউটার বা মোবাইলের ক্যামেরার সামনে হাত-পা নাড়িয়ে বা সাইন ল্যাংগুয়েজ বললে সেটি স্পিচ হিসেবে অনুবাদ হয়ে বলে দেবে। এটি এমনকি ইউনিকোড টেক্সটে রূপান্তর হবে।
১২. সেন্টিমেন্ট অ্যানালাইসিস টুলস উন্নয়ন : এর মাধ্যমে কোন ডকুমেন্ট বা প্যারাগ্রাফের টেক্সট বিশ্লেষণ করে বলে দিতে পারবে সেটি ইতিবাচক, নেতিবাচক নাকি নিরপেক্ষ। এর মাধ্যমে ওয়েবসাইটের মন্তব্য বিশ্লেষণ করা যাবে। যা যেকোনো ধরনের জরিপের কাজে ব্যবহার করা যাবে।
কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কাজ নিয়েও যথা সময়ে শেষ করতে পারেনি। অথচ এই ছয় বছরে প্রযুক্তির অনেক রূপরেখা বদলে গেছে। বাংলা ভাষা রক্ষায় ও মেশিন লার্নিং বাংলা ভাষার সক্ষমতা তৈরি করতে সরকারের উদ্যোগ নেওয়া ১৬টি টুলসের বেশ কিছু বিষয়বস্তু আগে ও পরে গুগল, অমিল্যাব (অভ্রর মূল প্রতিষ্ঠান), উইকিপিডিয়া, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই ডেভেলপমেন্ট ভিত্তিক অনেক প্রতিষ্ঠান বিনামূল্যে করে ফেলেছে
১৩. বাংলা ফন্ট কনভার্টার : অনেক সময় আমরা বাংলা ফন্ট বিভিন্ন অপারেটিং সিস্টেমে স্থানান্তরের সময় ভেঙে যায়। এমনকি কখনো একটি অ্যাপ্লিকেশন থেকে অন্য অ্যাপ্লিকেশনে নিলেও ফন্ট ভেঙে যায়। সেটা থেকে মুক্তি দেবে এই সফটওয়্যার।
১৪. ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী ভাষার কিবোর্ড ও শব্দ ভাণ্ডার : দেশে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর ভাষাগুলো তথ্যপ্রযুক্তিক্ষেত্রে খুব একটা ব্যবহার হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভাষার মানসম্মত ডকুমেন্টেশন, রিসোর্স বা ম্যাটেরিয়াল নেই। আবার এদের মধ্যে কিছু বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে। অনেক ভাষার পর্যাপ্ত ডেটা নেই, ফন্ট এনকোডিং নেই। সেগুলোকে লিপিতে রূপ দেয়া থেকে শুরু করে নানান ধরনের কাজ করা হবে।
১৫. বাংলা ইউনিকোড : ইউনিকোড লিপি কম্পিউটারে লিখন পদ্ধতির একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মান। বিশ্বের প্রায় সকল প্রধান ভাষায় কম্পিউটার লিপির জন্য কম্পিউটার ইন্ডাস্ট্রির বিজ্ঞানী, বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি ও বিজ্ঞানীদের সমন্বয়ে গঠিত কনসোর্টিয়াম এই মান নির্ধারণ করেন। এই কম্পোনেন্টের মাধ্যমে বাংলাদেশের পক্ষে বাংলা ও অন্যান্য ভাষার ইউনিকোড মান নির্ধারণে সকল প্রকার সমর্থন প্রদান করা হবে।
১৬. ভাষা প্রযুক্তির সমন্বিত প্লাটফর্ম : এই কম্পোনেন্টটি প্রকল্পের সবগুলো সার্ভিসের মিলনবিন্দু হিসেবে কাজ করবে। এখানে ওসিআর, হাতের লেখা শনাক্তকরণ, যান্ত্রিক অনুবাদসহ অন্যান্য সব সার্ভিস একসঙ্গে থাকবে। একজন ব্যবহারকারী ব্রাউজারের মধ্যমে এই প্লাটফর্মে প্রবেশ করে উল্লিখিত সার্ভিস ব্যবহার করতে পারবেন। এছাড়াও এখানে থাকবে প্রোডাক্ট শোকেস, যা থেকে সার্ভিস ছাড়াও ডকুমেন্ট ডাউনলোড করা যাবে।
তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলার ব্যবহার : সরকারি প্রকল্পে দরকারি কিছু নেই
২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি একনেকে প্রকল্পটি অনুমোদনের এক মাস পর ৪ ফেব্রুয়ারি প্রশাসনিক অনুমোদন পায়। ১৫ মে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি প্রথম সভা করে। স্টিয়ারিং কমিটি সভা করে ২৪ মে। এরপর ২০১৭ সালের জুন থেকে বাস্তবায়ন মেয়াদ দুই বছর ধরে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৯ সালের জুন মাসে। তবে দুই বছর শেষে শতকরা হিসেবে মাত্র পাঁচ শতাংশের মতো কাজ হওয়াতে প্রকল্পের মেয়াদ আরও দুই বছর বৃদ্ধি করে ২০২১ সালের জুন মাস পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। তবে অবাক হলেও সত্য ছয় বছর পার হলেও এই প্রকল্প এখনো গবেষণা পর্যায়ে রয়েছে।
কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কাজ নিয়েও যথা সময়ে শেষ করতে পারেনি। অথচ এই ছয় বছরে প্রযুক্তির অনেক রূপরেখা বদলে গেছে। বাংলা ভাষা রক্ষায় ও মেশিন লার্নিং বাংলা ভাষার সক্ষমতা তৈরি করতে সরকারের উদ্যোগ নেওয়া ১৬টি টুলসের বেশ কিছু বিষয়বস্তু আগে ও পরে গুগল, অমিল্যাব (অভ্রর মূল প্রতিষ্ঠান), উইকিপিডিয়া, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই ডেভেলপমেন্ট ভিত্তিক অনেক প্রতিষ্ঠান বিনামূল্যে করে ফেলেছে।
‘প্রকল্প পরিচিতি’ অপশনটি কাজ করলেও সেখানে প্রকল্প সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য নেই। কত বাজেট, কবে শুরু হয়েছিল এবং কবেই বা এই ১৬টি টুল উন্মুক্ত করা হবে সে বিষয়ে কোনো কিছুই লেখা নেই। কিছু জাগায় লিংকে ক্লিক করলে একই পেজে ওপেন না হয়ে ভিন্ন একটা পেজে নিয়ে যাচ্ছে যা একেবারেই ইউজার ফ্রেন্ডলি নয়
‘গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণ’ প্রকল্পের জন্য একটি অসম্পূর্ণ ওয়েবসাইট করা হয়েছে। ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ১৮ মে ‘ডেভেলপমেন্ট অব বাংলা ভার্চুয়াল প্রাইভেট অ্যাসিস্ট্যান্ট’ ও ১০ আগস্ট ‘ডেভেলপমেন্ট অব বাংলা মেশিন ট্রান্সলেটর সিস্টেম ফর বাংলা টু ইংলিশ অ্যান্ড ইংলিশ টু বাংলা অ্যান্ড ৯ আদার ইমপেক্টফুল ল্যাঙ্গুয়েজ’ এর জন্য টেন্ডার ডাকা হয়েছে। তার মানে কাজটি কোন পর্যায়ে রয়েছে সেগুলো সহজেই অনুমান করা যায়।
এ প্রকল্পের জন্য বানানো ওয়েবসাইটটি (http://www.eblict.gov.bd/) বাংলা ও ইংরেজি ভাষার সংমিশ্রণে ভরা। ওয়েবসাইটে আইকন ভেঙে গেছে। অনেক ক্যাটাগরিতে ক্লিক করলে কাজ করে না। ওয়েবসাইটে ‘প্রকল্পের বিস্তারিত’ ও ‘প্রকল্পের মূল কার্যক্রম’-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ অপশনটিও কাজ করছে না। কাজ করছে না ওয়েবসাইটের মূল ক্যাটাগরির আমাদের সেবা, আদেশ/বিজ্ঞপ্তি, প্রকাশনা (প্রকল্প পরিচিতি), ডাউনলোড, গ্যালারি, ফটো গ্যালারি, যোগাযোগ অপশনগুলোও। তবে ‘প্রকল্প পরিচিতি’ অপশনটি কাজ করলেও সেখানে প্রকল্প সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য নেই। কত বাজেট, কবে শুরু হয়েছিল ও কবে এই ১৬টি টুল উন্মুক্ত করা হবে সে বিষয়ে কিছুই লেখা নেই। কিছু জাগায় লিংকে ক্লিক করলে একই পেজে ওপেন না হয়ে ভিন্ন একটা পেজে নিয়ে যাচ্ছে যা একেবারেই ইউজার ফ্রেন্ডলি নয়।
এদিকে একই প্রকল্পের বিষয়বস্তু নিয়ে https://bangla.gov.bd/ নামেও একটা ওয়েবসাইট রয়েছে। যেখানে লোগো ছাড়া বাংলায় কিছু লেখা নেই। শুধুমাত্র অ্যাবাউট আস বিভাগে কিছুটা কথিত বাংলিশ রয়েছে। https://spell.bangla.gov.bd ঠিকানা থেকে বানান চেক করা যায়। তবে এটার জন্য কোথাও কোনো লিংক নেই। একটা ছবিতে লিংক যেটা দেখে আমি ব্রাউজারে লিখে ঢুকলাম। সেখানে আজকের প্রেজেন্টেশনের একটি ছোট্ট লেখা পেস্ট করাতে ‘শুধুমাত্র’ শব্দটি ভুল উল্লেখ করে সঠিক শব্দ লিখেছে ‘শুধু’ আর ওয়েবসাইটে ‘আইকন’ শব্দটি ভুল উল্লেখ করে সঠিক লিখেছে ‘তালা’! তার মানে ২০০ কোটি টাকা মূল্যের এই বানান চেক করার সফটওয়্যারটি মূলত সঠিক বানানকে ভুল হিসেবে দেখায়।
বাংলা ভাষাকে বিশ্বের নেতৃত্বস্থানীয় ভাষায় প্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়ক প্রযুক্তির প্ল্যাটফর্ম বাংলা ডট গভ ডট বিডি এবং বাংলা থেকে আইপিএতে রূপান্তরের সফটওয়্যার ‘ধ্বনি’র পরীক্ষামূলক সংস্করণ ২০২১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি উন্মুক্ত করে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ। আইপিএ বা ইন্টারন্যাশনাল ফোনেটিক অ্যালফাবেট হলো আন্তর্জাতিক ধ্বনিভিত্তিক প্রতিবর্ণীকরণ পদ্ধতি বা আন্তর্জাতিক ধ্বনিলিপি, যার উদ্দেশ্য হলো বিশ্বের সব ভাষার সব ধ্বনিকে এক লিপিতে প্রমিতভাবে উপস্থাপন করা। https://ipa.bangla.gov.bd লিংক থেকে বাংলা লেখা পেস্ট করলে সেটা ইংরেজি হরফে লেখা দেখা গেলেও এটা শুনতে কেমন তা কোথাও উল্লেখ করা নেই। এটার আসলে কাজ কী তা দেখে বোঝার উপায় নেই।
সরকারের বড় বাজেটের ধীর গতি প্রকল্প আদৌ আমাদের কোনো উপকারে আসবে কিনা সে ব্যাপারে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আপনাদের অবগতির জন্য জানিয়ে রাখি, ২০১৪ সালেও বাংলা ভাষায় হাতে লেখা, টাইপ করা ও ছাপার অক্ষরের লেখাকে যন্ত্রে পাঠযোগ্য লেখায় রূপান্তর এবং বাংলা প্রকাশনাকে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করার জন্য সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকা খরচ করে 'টিম ইঞ্জিন' নামের একটি প্রতিষ্ঠান দিয়ে বাংলা অপটিক্যাল ক্যারেক্টার রিকগনিশন বা ওসিআর তৈরি করেছিল। অথচ সেই ওসিআর কোন রকম ব্যবহার হচ্ছে না
এই প্রকল্পের সেবা নিয়ে ‘তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা’ নামের একটি ফেসবুক পেজ (https://www.facebook.com/EBLICT) রয়েছে। পেজটিতে গত ২৯ জানুয়ারি লেখা হয়েছে, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ‘গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে তথ্য প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণ’ প্রকল্পের আওতায় বাক, শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজীকরণ ও প্রযুক্তিবান্ধব করার লক্ষ্যে নির্মাণাধীন সফটওয়্যার সম্পর্কে ধারণা প্রদান ও পরামর্শ গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও অংশীজনদের নিয়ে একটি কর্মশালা গত ১০ জানুয়ারি আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত হয়। সাড়ে পাঁচ বছর আগের প্রকল্প, তিন বছর অতিরিক্ত সময় পার হওয়ার পর এখনো যদি ‘নির্মাণাধীন’ থাকে তাহলে মানুষ এর সুবিধা ভোগ করবে কবে?
এদিকে পেজটিতে গত ১১ ফেব্রুয়ারি লেখা হয়েছে, অমর একুশে বইমেলায় বাংলা ভাষাপ্রযুক্তির বিভিন্ন সেবা প্রদর্শিত হচ্ছে 'গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণ' প্রকল্পের স্টলে। এবারের মেলায় দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে প্রকল্পের তৈরিকৃত বাংলা বানান পরীক্ষক সফটওয়্যার 'সঠিক' ও বাংলা ওসিআর সফটওয়্যার 'বর্ণ' এর পরীক্ষামূলক সংস্করণ। ছয় বছর পরে এই পরীক্ষামূলক সংস্করণ নিয়ে জাতি কী করবে?
সরকারের বড় বাজেটের ধীর গতি প্রকল্প আদৌ আমাদের কোনো উপকারে আসবে কিনা সে ব্যাপারে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আপনাদের অবগতির জন্য জানিয়ে রাখি, ২০১৪ সালেও বাংলা ভাষায় হাতে লেখা, টাইপ করা ও ছাপার অক্ষরের লেখাকে যন্ত্রে পাঠযোগ্য লেখায় রূপান্তর এবং বাংলা প্রকাশনাকে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করার জন্য সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকা খরচ করে 'টিম ইঞ্জিন' নামের একটি প্রতিষ্ঠান দিয়ে বাংলা অপটিক্যাল ক্যারেক্টার রিকগনিশন বা ওসিআর তৈরি করেছিল। অথচ সেই ওসিআর কোনো রকম ব্যবহার হচ্ছে না। এর পরিবর্তে নতুন করে আরও বেশি টাকা খরচ করে ছয় বছর সময় নিয়ে সবেমাত্র পরীক্ষামূলক ওসিআর এলো। কিন্তু সে সম্পর্কে কতজন মানুষ জানে? সেটার ব্যবহার কারা করছে? আদৌও কি এই প্রকল্প আলোর মুখ দেখবে? এমন হাজার প্রশ্ন করা হলেও নেতিবাচক উত্তর ছাড়া ইতিবাচক কিছুই পাওয়া যাবে না। ফলে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলার ব্যবহারে সরকারি প্রকল্পে দরকারি কিছু নেই!
প্রযুক্তিতে বাংলার ব্যবহার বাড়াতে করণীয় কী?
আইন করে বাংলা ভাষার ব্যবহার বৃদ্ধি করার সুযোগ দেখছি না। যদিও দেশের সর্বত্র বাংলা ভাষার প্রচলন নিশ্চিত করতে ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এক আদেশে দেশের সব সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার, গাড়ির নম্বর-প্লেট, সরকারি দপ্তরের নাম-ফলক এবং গণমাধ্যমে ইংরেজি বিজ্ঞাপন ও মিশ্র ভাষার ব্যবহার বন্ধ করতে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে বলেন।
এই স্রোত থেকে বের হয়ে আসতে হলে আমাদের ভাষাকে সমৃদ্ধ করে আধুনিক সমাজের উপযোগী করতে হবে। এ জন্য প্রযুক্তির আশ্রয় নিয়ে ভাষার ‘কম্পিউটেশনাল রিপ্রেজেন্টেশন’ বর্ধিতকরণ বা যন্ত্র বোঝার উপযোগী করার বিকল্প নেই। উন্নত ভাষাগুলোর মতো বাংলাকে বিশ্বব্যাপী সর্বজনীনভাবে টিকিয়ে রাখতে হলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যাগুলোর প্রয়োগ প্রতিনিয়ত বাড়াতে হবে
সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। এছাড়া বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭-এর ৩ ধারায়ও সরকারি অফিস, আদালত, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে চিঠিপত্র, আইন-আদালতের প্রশ্ন-উত্তর এবং অন্য কাজে বাংলার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
রাজধানীতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স দেওয়া সংস্থা সিটি করপোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স (ব্যবসার অনুমতি) নেওয়ার সময়ও সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সাইনবোর্ডে বাংলা ব্যবহারের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়। অতিরিক্ত একটি সিল দিয়ে ট্রেড লাইসেন্সে লেখা থাকে, ‘সাইনবোর্ড বা ব্যানার বাংলায় লিখতে হবে’। কিন্তু এসব আইন বা আদেশ মানছে কত জন? এ জন্য আমাদের আরও বেশি সচেতন হতে হবে। নিজের মাতৃভাষার প্রতি যত্নশীল হতে হবে। আর সুযোগ থাকলে আমাদের ভাষাকে আরও শত সহস্র বছর বাঁচিয়ে রাখতে প্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে হবে।
বিশেষত গুগল আমাদের বাংলা ভাষার উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য বহু সেবা বিনামূল্যে দিচ্ছে, সেগুলোতে অংশগ্রহণ করতে পারি। যেমন- ট্রান্সলেটরে ইংরেজি শব্দের বাংলা অর্থ যোগ করা, গুগলসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের রিভিউ বাংলায় লেখা, সামাজিক মাধ্যমে বাংলায় স্ট্যাটাস দেওয়া, ওয়েবসাইটে তথ্যবহুল বাংলা লেখা বাড়াতে উইকিপিডিয়ায় অংশগ্রহণ, প্রশ্ন-উত্তরের আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইট কোরার বাংলা বিভাগে প্রশ্ন ও উত্তর সংযোজন করা যেতে পারে। এর ফলে বৈশ্বিক পর্যায়ে বাংলার ব্যবহার বাড়বে, বাংলা ভাষা সংরক্ষণ হবে, বাংলা ভাষা গ্রহণযোগ্যতা পাবে।
পর্যাপ্ত প্রযুক্তিগত উন্নয়ন না হওয়ার কারণে আমাদের অর্জিত এই ভাষা আমাদের কাছে আজ ক্রমেই সেকেলে হয়ে যাচ্ছে। আমাদের আধুনিক সমাজ ইদানিং বিদেশি ভাষার সংস্কৃতি, বিনোদন ও সেসব ভাষা ব্যবহারের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এই স্রোত থেকে বের হয়ে আসতে হলে আমাদের ভাষাকে সমৃদ্ধ করে আধুনিক সমাজের উপযোগী করতে হবে। এ জন্য প্রযুক্তির আশ্রয় নিয়ে ভাষার ‘কম্পিউটেশনাল রিপ্রেজেন্টেশন’ বর্ধিতকরণ বা যন্ত্র বোঝার উপযোগী করার বিকল্প নেই। উন্নত ভাষাগুলোর মতো বাংলাকে বিশ্বব্যাপী সর্বজনীনভাবে টিকিয়ে রাখতে হলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যাগুলোর প্রয়োগ প্রতিনিয়ত বাড়াতে হবে। এই প্রযুক্তির মূল চালিকাশক্তি হলো ডাটা। তাই বাংলা ভাষার জন্যও প্রয়োজনীয় ডাটা সেট সংগ্রহ ও সেগুলোর ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য সরকার, গবেষক, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ও ভাষাবিদদের একযোগে কাজ করতে হবে।
লেখক: এম. মিজানুর রহমান সোহেল ।। সাংবাদিক ও তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্লেষক