মশা কেন রক্ত খায়?
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১২৩ প্রজাতির মশা শনাক্ত হয়েছে। বিগত কয়েক বছরের গবেষণায় আমরা ঢাকা শহরে পেয়েছি ১৪ প্রজাতির মশা, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় কিউলেক্স প্রজাতি। ঢাকা শহরের মশার ৮০ ভাগেরও বেশি পাওয়া যায় কিউলেক্স মশা। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে এডিস মশা, যেটি ডেঙ্গু রোগের বাহক। কিউলেক্স মশা এবং এডিস মশার চরিত্র এবং আচরণ ভিন্ন।
কিউলেক্স মশা নোংরা পানি বিশেষ করে ড্রেন, ডোবা, নর্দমা এবং পচা জলাধারে হয়ে থাকে। সারাবছর এদের পাওয়া গেলেও শুষ্ক মৌসুমে এদের প্রাদুর্ভাব চরমে পৌঁছায়। শুষ্ক মৌসুমে যখন বৃষ্টিপাত থাকে না তখন ড্রেন, ডোবা, নর্দমার পানি পচে যায় এবং পানি আটকে যায়। পচে যাওয়া বদ্ধ পানিতে কিউলেক্স মশার প্রজনন হয় সবচেয়ে বেশি। তাই বাংলাদেশে ডিসেম্বর-মার্চ পর্যন্ত এ মশার প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।
ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা জন্মায় পাত্রে জমে থাকা পরিষ্কার পানিতে। শুষ্ক মৌসুমে এদের খুব কম পাওয়া গেলেও বর্ষাকাল বিশেষ করে জুন-অক্টোবর পর্যন্ত এদের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়। এ সময়টায় বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগ বেশি হয়।
অনেকেই মনে করে থাকেন মশার মূল খাবার রক্ত, আসলে বিষয়টি তা নয়। শুধুমাত্র স্ত্রী মশাই রক্ত পান করে, যখন তার পেটে ডিম আসে। রক্তে থাকা প্রোটিন তার ডিম থেকে ফুটে লার্ভা বের হতে সহায়তা করে। মশা যদি রক্ত পান না করে তাহলে তার ডিম থেকে বাচ্চা তৈরি হয় না। পুরুষ মশা রক্ত পান করে না।
কিউলেক্স এবং এডিস এ দুটি মশার চরিত্র আচরণ এবং প্রজনন স্থান যেহেতু ভিন্ন, তাই এদের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও ভিন্ন। দুটি মশার ক্ষেত্রে বছরব্যাপী সমন্বিত পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা পরিচালনা করা প্রয়োজন।
মশার আচরণের কিছু মজার তথ্য হলো, অনেকেই মনে করে থাকেন মশার মূল খাবার রক্ত, আসলে বিষয়টি তা নয়। শুধুমাত্র স্ত্রী মশাই রক্ত পান করে, যখন তার পেটে ডিম আসে। রক্তে থাকা প্রোটিন তার ডিম থেকে ফুটে লার্ভা বের হতে সহায়তা করে। মশা যদি রক্ত পান না করে তাহলে তার ডিম থেকে বাচ্চা তৈরি হয় না। পুরুষ মশা রক্ত পান করে না। পুরুষ এবং স্ত্রী মশার মূল খাবার উদ্ভিদ এবং ফলের রস।
একটি পূর্ণাঙ্গ স্ত্রী মশা পুরুষের সঙ্গে মিলিত হওয়ার এবং রক্ত খাওয়ার দুই থেকে চার দিনের মাথায় পানি এবং পানির পাত্রে ডিম পাড়ে। ডিমগুলো পানিতে পড়ার তিন থেকে চার দিনের মধ্যে ফুটে লার্ভা বের হয়। লার্ভা পানিতে ছোট্ট পোকার মতো দেখতে এবং চঞ্চলভাবে ঘুরে বেড়ায়। তাপমাত্রা ভেদে লার্ভা অবস্থায় এরা ৭-১০ দিন থাকে। লার্ভা থেকে মশাটি পিউপা’তে রূপান্তরিত হয়। পিউপা এক থেকে দুই দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ মশাতে রূপান্তরিত হয়।
পূর্ণাঙ্গ মশা পিউপা থেকে বেরিয়ে পানির ওপরে বসে বিশ্রাম নেয় এবং তার পাখা দুটি পূর্ণাঙ্গতা লাভ করে। এ সময় তার পাখা দুটি ওড়ার জন্য সক্ষম কি না পরীক্ষা করে নেয়। তারপর তারা উড়ে যায়। পূর্ণাঙ্গ মশা তাপমাত্রা ভেদে ১০-১৫ দিন বাঁচে। মশার জীবনকাল তাপমাত্রা ভেদে ৩০-৪০ দিন হয়ে থাকে।
সব ধরনের মশা রোগ বহন করে না। ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির মশা ভিন্ন ভিন্ন রোগ বহন করে। তবে এডিস মশা ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ছড়ানোর প্রমাণ বাংলাদেশ মিলেছে। কিউলেক্স মশার একটি প্রজাতি বাংলাদেশের কিছু জেলাতে ফাইলেরিয়াসিস (Filariasis) বা গোদ রোগ ছড়ায়। এই মশার দেহে এক ধরনের কৃমি থাকে, যার নাম ইউচেরিয়া বানক্রফটি (Wuchereria bancrofti)। এই কৃমি বহন করা কিউলেক্স মশা ফাইলেরিয়া বা গোদ রোগ ছড়াতে পারে।
পূর্ণাঙ্গ মশা তাপমাত্রা ভেদে ১০-১৫ দিন বাঁচে। মশার জীবনকাল তাপমাত্রা ভেদে ৩০-৪০ দিন হয়ে থাকে।
এই রোগটি কোনো মানুষের দেহে হতে হলে ওই কৃমির স্ত্রী এবং পুরুষ দুটোই একজন মানুষের দেহে প্রবেশ করতে হবে। আর এটি হতে গেলে মশা একবার কামড়ালে স্ত্রী এবং পুরুষ কৃমি মানুষের দেহে প্রবেশের সম্ভাবনা খুবই কম থাকে। তাই এই রোগ সংক্রমণ ঝুঁকি কম।
মশাটি ঢাকা শহরে এই সময়ে নব্বই ভাগ থাকলেও ঢাকাতে এই রোগ ছড়ানোর কোনো প্রমাণ আমরা এখন পর্যন্ত পাইনি। ফাইলেরিয়া রোগ দমনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ করে থাকে, যার কারণে ফাইলেরিয়া রোগ এখন নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে চলে এসেছে। জনসাধারণের সচেতনতা এবং বছরে এক থেকে দু’বার কৃমির ওষুধ সেবনে এ রোগ বিস্তার রোধে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে।
মশা দমনে সরকারি সংস্থাগুলোর পাশাপাশি জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। মশা নিয়ন্ত্রণের সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার যে চারটি পিলার রয়েছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে জনসম্পৃক্ততা। কিউলেক্স মশা দমনে সিটি করপোরেশনের মূল দায়িত্ব থাকলেও এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে নগরবাসীর ভূমিকাই মুখ্য।
এডিস মশা মানুষের বাড়ি এবং বাড়ির আশেপাশে পাত্রে জমে থাকা পানিতে হয়। বাড়ির ভেতর এবং বাইরে কোথাও যেন পানি জমা না থাকে, সেই ব্যাপারে নগরবাসী মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। যেসব এলাকায় পানির স্বল্পতা রয়েছে এবং গ্রামে বালতিতে পানি জমিয়ে রাখার প্রয়োজন পড়ে, তারা সপ্তাহে একদিন পাত্রটি সম্পূর্ণ খালি করে ব্লিচিং পাউডার অথবা ডিটারজেন্ট দিয়ে পাত্রটি ভালো করে ধুয়ে আবার পানি পূর্ণ করে রাখতে পারেন। নির্মাণাধীন ভবনের লিফটের গর্ত, ইট ভেজানোর চৌবাচ্চা এবং বেজমেন্টে যেন পানি জমে না থাকে, সেই ব্যাপারটি খেয়াল রাখতে হবে। এসব কার্যক্রম অব্যাহত রাখলে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশাকে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
ড. কবিরুল বাশার ।। কীটতত্ত্ববিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়