শিক্ষাক্রম : বৈষম্য ও বিবর্তনবাদ বিতর্ক
শিক্ষার সংকট সুদূরপ্রসারী। এই সংকট একদিনে তৈরি হয়নি। বরং নতুন শিক্ষাক্রমে তা আরও সুস্পষ্ট হয়েছে। একদিকে গুগুল ট্রান্সলেটের মাধ্যমে অনুবাদ, বৈষম্য তৈরি করা এবং বিবর্তনবাদ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা এখন তুঙ্গে। এই লেখায় সেই বিষয়ে আলোকপাত করেছি।
গুগুলের মাধ্যমে অনুবাদ
নতুন শিক্ষাক্রমের মৌলিক নীতিতেই গলদ। সেই গলদ নিয়ে প্রতিবাদ না করে গলদের ভিত্তিতে গৃহীত কর্মের প্রতিবাদ চলছে। একটি বইয়ে একজন শিক্ষক ওপেন সোর্সের কিছু অংশ অনুবাদ (গুগল ট্রান্সলেট) করে বইয়ে ছাপিয়ে দিয়েছেন। এই কন্টেন্টে কি কোনো ভুল আছে? একদম না। শিক্ষার্থীরা এটা পড়ে কোনো ক্ষতির সম্মুখীন হবে না।
আরও পড়ুন >>> নতুন শিক্ষাক্রমের সমস্যা কোথায়?
জুনিয়র লেভেলের স্কুলের টেক্সট বই কোনো গবেষণা প্রবন্ধ না তাই কখনোই রেফারেন্স দেওয়া হয় না। কোথাও না। তাহলে রেফারেন্সের কথা আসলো কেন। এটা লেখকের দায়িত্ব। ধরে নেওয়া হয় স্কুলের বইয়ের লেখক যিনি হবেন তিনি নৈতিকতার দিক থেকে অনন্য।
এই লেভেলের লেখকের কাছ থেকে তার নতুন আবিষ্কারের জিনিস বইয়ে লেখা হবে এই আশা নিশ্চয়ই করি না। এই লেভেলের বইয়ে একদম সর্বজন গৃহীত বহুল ব্যবহৃত বিষয়কে লেখক তার নিজের ভাষায় সাবলীল করে লিখবেন বলে ধরে নেওয়া হয়। ওই একই কনটেন্ট যদি একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সুন্দর ও সাবলীল করে লিখতেন কেউ প্রশ্ন তুলতে পারতো না।
নবম ও দশম শ্রেণি থেকে উচ্চতর গণিত একদম উঠিয়ে দিয়ে, পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান ও রসায়নের সাথে প্রযুক্তি ঢুকিয়ে বিজ্ঞান নামক একটি বিষয় পড়ালে আমাদের সন্তানেরা কি একুশ শতকের বিজ্ঞানের চ্যালেঞ্জ নিতে সক্ষম হবে?
লেখক গুগলের অনুবাদকেই যথেষ্ট মনে করেছিলেন আর এইখানেই ভুল। এইটা ঠিক হয়নি। তবে আমাদের জোরালো প্রতিবাদ হওয়া উচিত কারিকুলামের দর্শন ও আদর্শ নিয়ে।
শিক্ষাক্রমে বৈষম্য
নতুন শিক্ষাক্রমে যে আমরা বিজ্ঞানকে বামন বানিয়ে ফেলতে যাচ্ছি তার সুদূরপ্রসারী ক্ষতি কি আমরা অনুধাবন করতে পারছি? নবম ও দশম শ্রেণি থেকে উচ্চতর গণিত একদম উঠিয়ে দিয়ে, পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান ও রসায়নের সাথে প্রযুক্তি ঢুকিয়ে বিজ্ঞান নামক একটি বিষয় পড়ালে আমাদের সন্তানেরা কি একুশ শতকের বিজ্ঞানের চ্যালেঞ্জ নিতে সক্ষম হবে?
আরও পড়ুন >>> জিপিএ-৫ তৈরির কারখানা!
পাশাপাশি একই দেশে ইংরেজি মাধ্যমে যারা পড়বে তারা সব বিষয়ে অধিক পড়বে এবং অধিক জানবে। ফলে এক দেশে দুই মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের দূরত্ব বৃদ্ধির মাধ্যমে আমরা ধনী গরিবের বৈষম্য আরও কি বাড়িয়ে দিচ্ছি না? এইটা নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত বেশি, সেই জায়গায় আমরা আলোচনা করছি ভিন্ন বিষয়ে।
বিবর্তনবাদ
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখানে আলোকপাত করতে চাই। বইয়ের অনুবাদ কীভাবে হলো তার চেয়েও অধিক ক্ষতিকর বিষয় যে পাঠ্যবইয়ে ঢুকে যাচ্ছে বা বই থেকে বাদ পড়ছে কিংবা ভুলভাবে যাচ্ছে তা নিয়ে কি আলোচনা হচ্ছে? এই শতকে দাঁড়িয়ে বিবর্তনবাদ না পড়া বা ভুল পড়া কিংবা বিবর্তনের বিপক্ষে পড়া অমার্জনীয়।
বইয়ে বিবর্তনের পক্ষে লিখলে হইচই আর বিপক্ষে ভুল লিখলে চুপচাপ থাকা অমার্জনীয় অন্যায়। এই অন্যায় আমাদের দেশে হচ্ছে।
একুশ শতকের বিজ্ঞানের ছাত্র তৈরি করতে হলে বিবর্তন পড়াতেই হবে। কীভাবে এলাম আমরা, কেন ভিন্ন ভিন্ন প্রাইমেট একই রোগ জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়, এত এত ট্রানজিশনাল ফসিলের লজিক্যাল যোগসূত্র কীসের ইঙ্গিত করে, কেন ব্যাকটেরিয়ার মিউটেশন ঘটে এবং আরও বেশি রেজিস্টান্ট হয় ইত্যাদি ইউনিভার্সাল জ্ঞান এখন স্কুলের শিক্ষার্থীদেরই শেখাতে হয়।
আরও পড়ুন : সৃজনশীল ও শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষাব্যবস্থা কেন জরুরি?
এইসব মৌলিক ধারণাগুলো পোক্তভাবে না শিখলে ভবিষ্যতে বিজ্ঞানী হওয়া সম্ভব না। বইয়ে বিবর্তনের পক্ষে লিখলে হইচই আর বিপক্ষে ভুল লিখলে চুপচাপ থাকা অমার্জনীয় অন্যায়। এই অন্যায় আমাদের দেশে হচ্ছে।
এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা পর্যন্ত গর্বের সাথে বলেন, ‘আমি নিজেও বিবর্তনবাদ বিশ্বাস করি না!’ অনেকেই এর বিপক্ষে লেখালেখি করেন বা অন্যের লেখার সাথে সহমত পোষণ করেন।
আইজাক নিউটন বলেছিলেন, ‘আমি অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পাই কারণ আমি জায়ান্টের ঘাড়ে দাঁড়িয়ে আছি।’ এই জায়ান্ট মানে বর্তমানের জ্ঞান।
১০০ বছরে জ্ঞানের বিস্ফোরণ ঘটেছে। এত এত নতুন জ্ঞান আমরা কীভাবে অর্জন করব যদি বিবর্তনবাদ নিয়ে বিতর্কেই আটকে থাকি? যদি বিজ্ঞানকে সঠিকভাবে না জানি?
আরও পড়ুন >>> শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন : বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ
আলোচনা হওয়া উচিত বিবর্তবাদের তথ্যে যেন বিন্দু পরিমাণও ভুল না থাকে। সামান্য ভুল যা আপাত ক্ষতিকর সেটা নিয়ে আমাদের প্রচণ্ড মাথাব্যথা আর যেটা অসামান্য ক্ষতি করবে তা নিয়ে চুপচাপ থাকা দেখে আমি খুবই আশ্চর্য হই।
এতেই বোঝা যাচ্ছে, আমাদের ভবিষ্যৎ আসলে কোনদিকে? আমাদের তরুণরা আসলে কোনদিকে ধাবিত হচ্ছে। এর থেকে পরিত্রাণে পথ বের করতে না পারলে সঙ্কট আরও বাড়বে।
ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়