একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি : জয়যাত্রার জয়োল্লাস
স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের দশকটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিচিত্র কারণে উল্লেখ্য। ঐ আন্দোলনের কাল পরিধিতে পঁচাত্তর পরবর্তী বিধ্বস্ত আওয়ামী লীগ জাতীয় রাজনীতিতে আপন অবস্থান সুদৃঢ় করার কাজটি গন্তব্য অভিমুখী দ্রোহীরূপে আত্মপ্রকাশ করে।
ছাত্র আন্দোলনেও সেই সময় জনপ্রণয় লাভ করে। শ্রমিক শ্রেণিও অংশীজনে পরিণত হয়। এসব ইতিবাচক ফলাফলের পাশাপাশি মারাত্মক নেতিবাচক ফলাফলও প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে। আর তা হলো স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত-জঙ্গিদের অস্বাভাবিক উত্থান।
মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধ পক্ষ জামায়াত-মুসলিম লীগ এবং সশস্ত্র প্রতিপক্ষ রাজাকার-আলবদররা স্বাধীনতা উত্তরকালে গা ঢাকা দেয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক সরকার জিয়াউর রহমানের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ঐ সব পরাজিত প্রতিপক্ষ রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ পায়।
আরও পড়ুন >>> ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি : আগামীর দৃঢ়তা
এরাই এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের যুগপৎ লড়াইয়ের কর্মসূচিতে প্রতিক্রিয়াশীল স্বাধীনতা বিরোধীরা সক্রিয় ও সমবেত হয়। পুরো নব্বইয়ের দশক তারা শক্তি সঞ্চয় করে এবং তাদের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ সমৃদ্ধ করে।
পাড়া, মহল্লা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেই সঞ্চিত শক্তিবলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়। যেখানে তারা আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছে সেখানেই তারা নৃশংস ও সশস্ত্ররূপে আবির্ভূত হয়েছে। একেবারেই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যেমনটি করেছিল।
সেই সময়ে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে একাত্তরের ঘাতক দালাল বিরোধী দুর্বার আন্দোলন। গঠিত হয় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।
জামায়াত-শিবির-জঙ্গি-যুদ্ধাপরাধীরা আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক শক্তিবলে বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজকে নিয়ন্ত্রণের অপচেষ্টা গ্রহণ করে। তারা মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের প্রকাশ্যে অপমান করে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অস্বীকার করে বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ভাবাদর্শে পরিচালনার প্রচেষ্টা নেয়।
আরও পড়ুন >>> শুভ জন্মদিন, নির্মূল কমিটি
এই সময় স্বৈরাচারী এরশাদের পতন হলে তারা মূলধারার রাজনৈতিক তৃতীয় শক্তি হিসেবে নিজেদের ঘোষণা করে এবং দেশের সর্বত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা সফলও হয়।
তাদের আপাত দৃশ্যমান সাফল্যে উৎসাহী হয়ে অনেক রাজনৈতিক দল তাদের সঙ্গে ঐক্য-সখ্য গড়ে তোলে। দেখা যায়, তাদের আমির একাত্তরের ঘৃণিত খুনি গোলাম আযমের কাছে কোনো রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী দোয়াও চায়।
আর ওরা তখন দম্ভে-দাপটে বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ করতলগত করার স্বপ্ন-সন্ত্রাসে ব্যস্ত। এই একাত্তরের ঘাতক দালালদের উদ্ধত আস্ফালনে, দাম্ভিক আগ্রাসনে ও দাপুটে আক্রমণে পিছু হটতে থাকে স্বাধীনতার পক্ষের মানুষেরা। কারণ ঐ রকম অবিনীত সময়ে স্বাধীনতার পক্ষাবিলম্বীরা নেতৃত্ব শূন্য, কর্মসূচিহীন ও হতবিহ্বল।
সেই সময়ে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে একাত্তরের ঘাতক দালাল বিরোধী দুর্বার আন্দোলন। গঠিত হয় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।
আরও পড়ুন >>> আমরা কি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের পথে?
এরপর থেকে শুরু হয় একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিচার-বিতারণ, যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তিবিধান ও মানবতা বিরোধী জঙ্গি জানোয়ারদের প্রতিহত ও প্রতিরোধের সর্বাত্মক সংগ্রামে আন্দোলন-সংগ্রামের সর্বাগ্রে থাকেন অসম সাহসী নারী শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। তার পাশে এসে দাঁড়ান সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ সবাই। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হন।
একাত্তরের ঘাতক দালালদের প্রতিরোধ করার সাহসী উচ্চারণে সমবেত হয় জনসাধারণ। তারা সবাই সাহসিকা জাহানারা ইমামের সুদক্ষ নেতৃত্বে দেশব্যাপী গড়ে তোলেন অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন।
যুদ্ধাপরাধীদের দল হিসেবে জামায়াতকে নিবন্ধহীন করা সম্ভব হয়েছে। আর এসব করা গেছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অসংকোচ আন্দোলনের মাধ্যমে।
একাত্তরের খুনের প্রধান হুকুম দাতা জামায়াত নেতা গোলাম আযমের বিচারের প্রতীকী গণআদালত গঠন, বিচার ও মৃত্যুদণ্ড যোগ্য অপরাধী ঘোষণার মাধ্যমে শুরু হয় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূলের সর্বাত্মক সংগ্রাম।
দেশের প্রত্যেক জেলা, উপজেলা, ইউনিয়নে গড়ে ওঠে আন্দোলন। প্রবাসী বাঙালিরাও সোচ্চার হলেন সামর্থ্যের সবটুকু নিয়ে। সৃষ্টি হয় গণজোয়ার। সেই জোয়ারের প্রতি সম্মান জানিয়ে গঠিত হয় বৈচারিক আদালত। শুরু হয় বিচার। ফাঁসি হয় অনেক অপরাধীর। এখনো অব্যাহত আছে বিচার কার্য।
আজ নির্মোহ বিশ্লেষণে একথাই সত্য যে, জাতির কলঙ্ক মোচন হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্যের মাধ্যমে। জামায়াত-জঙ্গি-জানোয়ারদের সামাজিকভাবে ঘৃণ্য হিসেবে চিহ্নিত করা গেছে।
আরও পড়ুন >>> সম্প্রীতি ফিরে আসার প্রত্যাশায়
যুদ্ধাপরাধীদের দল হিসেবে জামায়াতকে নিবন্ধহীন করা সম্ভব হয়েছে। আর এসব করা গেছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অসংকোচ আন্দোলনের মাধ্যমে।
আবার একথাও সত্য যে, এখনো অনেক অপরাধী ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। এখনো স্বাধীনতা বিরোধীরা অর্থনৈতিক শক্তি-সামর্থ্যে দেশের বাজার-বাণিজ্য, শিল্প-সাহিত্যে কোথাও কোথাও কর্তৃত্ব করে। তাদের নগ্ন আস্ফালনে অসম্মানিত হয় আমাদের স্বাধীনতা, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও শহীদ এবং বীরাঙ্গনারা।
তাই সুস্পষ্ট হয় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আবশ্যিকতা। অনিবার্য হয়, তাদের নিখাঁত আন্দোলন-সংগ্রাম। আর সেই কারণেই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সশ্রদ্ধায় ধ্বনিত হয় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অবিরাম জয়যাত্রার জয়োল্লাস।
অধ্যাপক ড. রতন সিদ্দিকী ।। শিক্ষাবিদ ও নাট্যকার